আকাশের মেঘ নেমে আসে
বৃষ্টি তবু আসে না
প্রায় আমি একটি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন না বলে মৃত্যুর সাথে লড়াই বলা ঢের ভালো। কোনো কিছুতেই আমার ঘুম ভাঙ্গে না। আমি স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে বোঝাতে থাকি এ কেবলি স্বপ্ন। কিন্তু মৃত্যু আমাকে গ্রাস করে। কোনোভাবেই আমি মুক্তি পাইনা। দেখি একজন আরবের বিশাল লক লকে জিহব্বা। জিহব্বা যেনো চৈত্র মাসের বাতাসের মত হুল ফুটাচ্ছে। লক লকে সেই জিহব্বা নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে সে। হাতে রুপালি জোসনার রঙের মত তলোয়ার। ঘুমের মধ্য আমার ভারি তৃষ্ণা পেয়ে যায়। কোনোমতেই ঘুম ভাঙে না। এইভাবে মৃত্যু আমাকে উনত্রিশ বছর দাঁবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া মানেই আমার আবার বেঁচে উঠা। উনত্রিশ বছর এইভাবে আমি মৃত্যুকে পরাজিত করে বেঁচে আছি।
বিষয়টি নিয়ে প্রথম আমি আলোচনা করি ফারিয়া আফসানা মুনমুনের সাথে। ফারিয়া আফসানা মুনমুন ইংরজি সাহিত্যের ছাত্রী। দেশের সব থেকে খ্যাতিমান এবং একই সাথে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিদ্যার সব থেকে দামী বিষয়ের ছাত্রী। কারণ এ কালে মানববিদ্যা নিয়ে মানুষ তেমন মাথা ঘামায় না অথবা এমন বললেই সত্যের খানিকটা কাছাকাছি পৌছানো সম্ভব হবে যে বাংলাদেশের মানুষের কাছে মানব বিদ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। ইংরেজি সাহিত্যের দাম থাকলেও বাংলা সাহিত্যের কিন্তু কোনো দাম নেই। সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে যতখানি নয় তার থেকে বেশি কদর হবার কারণ ভাষাটি ভালো করে আমাদের দেশের কম মানুষই জানে। আর এই ভাষায় কথা বলা বা লিখতে পারা বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে সমাজে সম্মানেরও খানিকটা উন্নতি ঘটে। তবে যতোটা না সম্মানের তার চেয়ে বেশি মাত্রায় গুরুত্বপূর্ন এই যে বর্তমানা যারা দুনিয়ার তাবত সম্পদের মালিক, তারা এই ভাষায় তাদের তাবত কার্যকর্ম করে। যতোটি না ভাষাটির মাধুর্য্যরে গুনে এতো কদর তার চেয়ে বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপাত্যের জোর। যদিও এই ভূখণ্ডের জনগণ রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার কৌলিন্য বজায় রেখেছিলো। সেই ঘটনার অর্ধ শতাব্দি পার হতে না হতেই বাংলা অপাঙতেয় হয়ে গেছে। কারণ বিদেশী কোম্পানীগুলির কনিষ্ট কেরানী হতে গেলে বাংলা জানাটাই বরং চাকরি না পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। ইংরেজি সেখানে বড্ড চলে। সাহিত্যের কারনে নয়, ভাষাটা ইংরেজি হওয়ায় তার দাম বেড়েছে শেষ এক দশকে আরও বেশি। তো সেই ফারিয়া আফসানা মুনমুন আবার দেশের দণি পশ্চিমাঞ্চল থেকে এসেছিলো। যে অঞ্চলে সশস্ত্র কমিউনিস্টরা চার দশকব্যপী শ্রেণীশত্র“ খতমের নামে চারু মজুমদারের লাইন ফলো করতো। তবে শেষ পর্যন্ত শ্রেণীসংগ্রাম গিয়ে ব্যক্তিগত লাভ তি বৃদ্ধির সংগ্রামে গিয়ে ঠেকেছিলো। ফলে একদিকে সেখানে যেমন বামপন্থা কমিউনিজমের প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিলো অন্যদিকে ভয়ঙ্কর উগ্র ডানডন্থাও দিনে দিনে মাথা শক্ত করে উঠে দাঁড়াচ্ছিলো। আমার চেনা অনেক অধ্যাপক বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলো যে, চরম বামপন্থার বিকাশ এবং ব্যর্থতাই চরম ডানপন্থার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। বিষয়টির মধ্য তত্বের এক ধরণের উন্মসিকতা থাকলেও এই তত্বটিই সবাই প্রায় বিনাবাক্য মেনে নিয়েছিলো। যদিও আমার কাছে বিষয়টি ওরকম ছিলো না মোটেও। তবু আমি কাউকে সাহস করে বলতে যাইনি। আমি অনেক কিছুই সাহস করে বলেনি। আমার চরিত্র গড় পড়তা মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের পর্যায় পড়ে।
আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ফারিয়া আফসানা মুনমুনের বাড়ির দূরাত্ব ছিলো সর্বসাকুল্যে উন পঞ্চাস দশমিক আট কিলোমিটার। তাদের বাড়ির দোতলার দিকে যতোবারই আমার চোখ গেছে সেখানে একটি কালো রঙের ব্রা ঝুলতে দেখেছি। বিষয়টি নিয়ে ফারিয়া আফসানা মুনমুনের সাথে আমার কথা হয়েছে। সে কোনো উত্তর দেয়নি। কারণ সে ঐ বাড়িতে বছরে সর্বোচ্চ দুবার যায়। তাও আবার দুই ঈদে। তাই এ বিষয়টি পরিস্কার যে কালো ঝুলন্ত ব্রা তার নয়। বিষয়টি আরও পরে নিশ্চিত হয়েছি যে আদৌতেই কালো ব্রাটি ফারিয়া আফসানা মুনমুনের নয়। যখন সে আমার সাথে ঢাকা শহর থেকে চার শ পচাঁনব্বই কিলোমিটার পূর্বে যে সাগর সৈকত রয়েছে সেখানে যাবার পর।
রাখাইন পল্লিতে বানানো সস্তা মদ স্থানীয়রা যাকে মহুয়া বলতে বেশি পছন্দ করে; তিব্র ঝাঝালো সেই পানীয় আমরা দু’জন গলা পর্যন্ত গিলেছিলাম। তার সাথে আমার বাজি ছিলো সে এক পেগ নিলে আমাকে দু পেগ নিতে হবে। আমরা কত সময় সাগর পারে বসে বসে পানীয় পান করেছিলাম তা মনে নেই। তবে ঢাকা ফেরার পথে সে আমাকে জানিয়েছিলো আমাদের গাইড সাজু যে পেগের হিসেবের বাইরে গ্লাসভর্তি করে পানীয় দিচ্ছিলো সে ফারিয়া আফসানা মুনমুনের মুখে বাদাম আর চানাচুর তুলে দিতে চেয়েছিলো। সাজুর ধারণা ছিলো সে মাতাল হয়ে গেছে এই ফাকে তাকে স্পর্শ করা যাবে। কিন্তু ফারিয়া আফসানা মুনমুন তা প্রত্যাখান করে দেয়। আরও পরে যখন উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঝড়ে সব তচনচ করে দিয়েছিলো তখন শেষবারের মত গিয়েছিলাম কুয়াকাটা। সাজুকে খুজছিলাম। স্থানীয়রা জানালো সে এক টুরিস্টকে খুন করে। সেই অপরাধে সাজু এখন জেলে। তখন আমার ফারিয়া আফাসানা মুনমুনের কথা মনে পড়ে গেলো। যদি সে রাতে তার মুখে চানাচুর বাদাম তুলে দেয়ার ছলে আরও বেশি কিছু দাবী করতো তাহলে খুনী সাজু না হয়ে আমার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিলো। সে রাতে হোটেলে ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত পেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিলো। কোনোমতে টলতে টলতে আমরা যখন হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন হোটেলের গেটে ঝুলছে বড় তালা। সেই মাতাল অবস্থায় ফারিয়া আফাসানা মুনমুনের কণ্ঠে প্রথম অশ্রাব্য গালাগালি শুনতে পেলাম। আমার মধ্যবিত্ত রাবিন্দ্রীক সত্তা একটু কেঁপে ওঠেনি, বরং তার কণ্ঠে ওরকম গালাগালি শুনে আমার নেশা আরও তিব্র হোলো।
যদিও কুয়াকাটা নামের ঐ সাগর সৈকতে প্রচুর বালি আর নোংরা মাটি থাকে তবু সেই ছিলো আমার প্রথম কোনো সাগর সংগম।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ায় তার মধ্যে এক ধরনের গর্ব ছিলো। যদিও সে তা কখনো বলতো না। তবে ইংরেজি জ্ঞান তার ছিলো। আমরা যখন সাগরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন আমাদের সম বয়সি এক তরুনীর নিখুদ ব্রিটিশ উচ্চারণ শুনে সে খুব আফসোস করেছিলো। কারণ তার উচ্চারনের মধ্যে এশিয়দের তিব্র উপস্থিতি তাকে সব সময় বিচলিত করতো।
ফারিয়া আফসানা মুনমুন সাহিত্যের ছাত্রী হলেও সে সাহিত্যের কিছুই বুঝতো না। টিএস ইলিয়ট তার পাঠ্য ছিলো। অথচ ইলিয়ট নিয়ে সে যে আলোচনা করতো তা ছিলো অতি নিন্মমানের। বিশেষত রদ্দিমার্কা ভারতীয় কিছু সাহিত্য সমালোচকের নোটবই চলতি ভাষায় যাকে চটি বই বলা হয়, সে সেই সব মুখস্ত করতো। তবে এটা স্বীকার করতে দ্বীধা নেই যে তার মুখস্ত বিদ্যা যদি ইসলামের প্রথম যুগে পরিচয় দিতো তা হলে নারী হবার পরও পবিত্র আল কোরআন মুখস্তের কিছুটা দায়িত্ব তার উপরও পড়লেও পড়তে পারতো। ফারিয়া আফসানা মুনমুন যে পশ্চিমা সাহিত্য কিছু বোঝে না এ বিষয়টি আমি প্রথম ল করলাম আগস্টের শেষের দিকে। সে আমাকে টানা আটারো মাস ছত্রিশ দিন ঘুরিয়ে অবশেষে শহরের সাহিত্যপাড়া বলে খ্যাত আজিজ মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডের এক মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমার যে বিজয় হয়েছে সে সম্পর্কে সম্মতি জানালো। আমি তখন আবিষ্কার করলাম আমি পৃথিবীর সেরা সুখি মানুষ।
এই ঘটনার আরও পরে এক সন্ধায় তার হোস্টেলের সামনে যখন আমি কাঁদছি আর সে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করার ফরমান জারি করেছে তখন আমার এই মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের কথা মনে পড়ে গেলো। যদিও সে দিন মনে পড়ার কথা ছিলো কুয়াকাটার সমুদ্র পাড়ে সারা রাত মাতাল হয়ে আমি তাকে টিএস ইলিয়ট বোঝাচ্ছিলাম সে রাতের কথা।
চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমাদের পাসের টেবিলে বসেছিলো আমাদের মতই দুই তরুন তরুনী। তাদের আলাপের বিষয় ছিলো যে তারা অনেকদিন একত্রে মিলিত হয় না। এই কারণে নাকি মেয়েটার রাতে ঠিকমত ঘুম আসে না। আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে ফারিয়া আফসানা মুনমুন তার সেই ভূবনমোহনী হাসি দিয়ে বললো, ‘তুমিতো আমার থেকে বেশি লজ্জা পাচ্ছো।’ আমি আরও বেশি করে লজ্জায় আহত হবার পরে যখন ধাতস্ত হচ্ছি ঠিক তখন সে আমাকে জানালো যে সে আমাকে ভালোবাসে। সেই মূহুর্তে আমার মনে হলো ছেলে মেয়ে দুটো খুব স্বাভাবিক আলাপ করছে। যদিও এই ধরণের আলাপ শুরু করার ইচ্ছে আমার তখন ছিলো না। এই ঘটনার আরও পরে যখন শীত এলো তখন সে আমাকে একটি কালো বিশাল লম্বা চাদর কিনে দিয়েছিলো। কালো লম্বা চাদর কিনে দেয়ার পেছনে তার যুক্তি হলো একই সাথে লম্বা চাদরে আমার মত দীর্ঘদেহী পুরুষদের বেশি মানায়। আর দ্বিতীয় কারণ আমি যেহেতু বামপন্থি তাই বাঙালি বামপন্থিদের চাদরের ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য কালো লম্বা চাদর কিনে দিয়েছিলো সে আমাকে।
বামপন্থিদের চাদর প্রিতির কারন যখন তাকে আমি খুলে বলেছিলাম তখন থেকে সে আমার চাদরের তলে মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দেখতো যে এর মধ্যে কোনো ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা। তবে শেষ দিকে অবশ্য এক চাদরের নিচে সে আর আমি বসে বসে লন্ডন শহরের তাপমাত্রা নিয়ে আলাপ করতাম। শীতে সেখানে আমরা কী বেশি করে মদ খাবো, নাকি গরম পোশাক পরে মার্কসের সমাধি দেখতে যাবো তা নিয়ে প্লান করতাম। আমরা নেটে ঢুকে লন্ডন শহরের তাপমাত্রা দেখতাম।
পিএইচডি করার পর দেশে ফেরার পরে আমরা পথ শিশুদের জন্য একটি স্কুল করার পরিকল্পনাও করেছিলাম। ফারিয়া আফসানা মুনমুনের বাবা ছিলো গোড়া ইসলামী রাজনীতির সমর্থক। বাড়িতে যাওয়ার পর তাকে বোরকা পরতে হতো এই কারণে আমরা দু’জন কত হেসেছি। তবে বাবার কোনো ছায়া তার মধ্যে ছিলো বলে আমার মনে হয়নি। বরং তাকে আমি একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসাবে ভাবতাম। আর আমার সাথে পরিচয়ের সূত্রটাও বেশ অভিনব।
আমিও বাংলাদেশের সব থেকে প্রাচীন গৌরবদীপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তবে ইংরেজি সাহিত্যের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শুরু থেকে যে চারটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো তার মধ্যে ছিলো ইতিহাস। যদিও রাজা বাদশাদের ইতিহাসের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ র্ছিলো না। আমার কাছে জীবিত মানুষ বেশি মূল্যবান মনে হতো। আমার কাসের সব থেকে রুপবতি মেয়ের জš§দিন উপল্েয বন্ধুরা সব থেকে কমদামী এক হোটেলে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কেক নিয়ে সবাই অপো করছে আমার জন্য। আমি আসছি না। কারণ আমি তখন যেখানে থাকতাম সেখান থেকে এই হোটেলর দূরাত্ব ছিলো কিলোমিটারে দশের উপরে। আমার কাছে টাকা না থাকায় হেটে হেটে দশ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে হয়েছিলো। তার উপর ছিলো আগের রাতে শ্রমিকদের সাথে ধর্মঘট নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক। চার চারটি সফল বৈঠক করার পরে আমি যখন ঘুমোতে গেলাম তখন প্রায় ভোর হচ্ছে।
মসজিদের ইমামের সামনে একটিও দাত ছিলো না। তিনি যখন আযান দিতেন, তখন আযানের যে সুরেলা একটা টোন পাওয়া যায় তার বদলে আমার শব্দ দুষনই মনে হতো। তো সেই ভুল উচ্চারনে শব্দ দুষনের আযানের সময় তেল চিটচিটে মজনু ভাইয়ের সাথে ছোট্র বিছানায় ভাগাভাগি করে ঘুমোতে গেলাম। সকালে মজনু ভাই রিকশা নিয়ে চলে যাওয়াতে আমাকে আর ডেকে দেবার মত কেউ ছিলো না। এই অবকাশে কত পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম তা বলতে পারবো না। পাসের বাসা থেকে তিব্র চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বস্তিতে এরকম চিৎকার চেচামেচি খুব সাধারণ ঘটনা। গত এক বছরে এই ব্যবস্থার সাথে আমার নিবিড় পরিচয় হয়েছে। ফলে আমি অবাক হইনা। তবে ঘুম ভেঙ্গে মায়ের দেয়া একমাত্র স্মৃতি চিহ্ন ঘড়িটা দেখে মন খারাপ হলো। আজতো সোমা জোয়াদ্দারের জš§দিন।
এই ঘঠনার আরও বহুপরে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির বাড়ির সামনে দিয়ে হেটে যেতে যেতে ফারিয়া আফসানা মুনমুন আমাকে বলেছিলো, ‘তোমার এই ঘড়িটা আমার একদম পছন্দ নয়। এটা আর পরবে না।’ আমি সেই সময়ই ঘড়িটা খুলে ফেলেছিলাম। সেটা আমার আর পরা হয়নি। ঘড়িটা এখনও আছে। মাঝে মাঝে ঘড়িটার দিকে আমি তাকাই। ঘড়িটা এখন চলে না। নিশ্চল। তবু মনে হয় ওর মধ্যে কোনো একটা প্রাণ আছে।
শহরের সব থেকে সস্তা হোটেল থেকে আমার সাময়িক বাসস্থল ছিলো দশ কিলোমিটারের দূরাত্বে। আমি হাটা শুরু করলাম। যখন এসে পৌছলাম, দেখি আমার জন্য সবাই অপো করে আছে। চারদিক থেকে কমিউনিস্ট হওয়ার কারণে যেসব ভৎসনা আসছিলো আমি আগে থেকেই তৈরী ছিলাম বলে তেমন গায়ে মাখলাম না। কারন আমি আমার বন্ধুদের কাছে ইতোমধ্যে অসামাজিক হিসেবে যথেষ্ট দূর্নাম কুড়িয়েছিলাম। পরিচিতদের মধ্যে বামপন্থা নিয়ে বিশেষ কোনো আগ্রহ না থাকলেও বামপন্থিদের নিয়ে নানারকম ঠাট্রা, রসিকতা ছিলো দেখার মত।
সেই জন্মদিনের ছোট্র আয়োজনে আমার সাথে ফারিয়া আফসানা মুনমুনের পরিচয় হয়েছিলো। আরও একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো, সে হলো দ্বীপান্বিতা। দ্বীপান্বিতা পরে যার সাথে আমার যোগাযোগ রয়েছে। মাঝে মধ্যি সে আমাকে ফোন দেয়। আমিও তার সাথে যোগাযোগ রাখি।
তবে যে বিষয়টি আমার বেশি আশ্চায্যের মনে হয়েছিলো তা হলো পরিচয়ের প্রথমেই আমাকে সে বলেছিলো, ‘আমি জানি আপনার সম্পর্কে।’ ততোদিনে গ্রামের প্রেমের শোক কাটিয়ে আমি বাস্তবে তৈরী ছিলাম প্রেমের দ্বিতীয় যুদ্ধে নামার জন্য। এ বিয়ষটি আমি ভালো করে বুঝতাম। তবু দূরে দূরে থাকতাম। কারণ আমাদের নেতারা আমাকে আদর্শের ভুুরি ভুরি গল্প শোনাতেন আর সবাই প্রেম করতেন। সেই কারণে আমি এক প্রকার জোর করে প্রেমের বাস্তবিক যুদ্ধ মাঠ এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের ব্যক্তিগত প্রেমের মান অভিমানে যতো সমস্যা হতো বামপন্থি হিসেবে কুটুক্তি শুনলেও সমাধানের জন্য তারা আমাকে কেন বেছে নিতো তা আমার বোধগম্য হয়নি। হতে পারে এই অকালে কেউ কারোর কথা শোনার সময় পায় না। বা কারোর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কারোর তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না; হতে পারে এই কারণে আমাকে উভয়প শুনিয়ে তাদের দু:খ ভাগ করে নিতো। এই কারনে বন্ধুদের মাঝে একই সাথে আমি বেশ জনপ্রিয়ও ছিলাম।
ফারিয়া আফসানা মুনমুনের সাথে আমার প্রেম ভালোবাসার প্রথম রাতে যখন সে আমার ভেতর উগ্রপুরষটির অস্তিত্ব নিয়ে যে পরীায় আমাকে বসিয়েছিলো, যাতে আমি এক শ’র মধ্যে কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্ধ ছাড়াই পুরো মার্কস পেয়েছিলাম, সে রাতে ফারিয়া আফসানা মুনমুন আমাকে প্রথম গণসঙ্গিত গেয়ে শুনিয়েছিলো। একটা মাত্র বালিসে আমরা দু’জন ভাগাভাগি করে শুয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিকের বাসায়। তার শরীর থেকে শিশুদের গায়ের গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম (চলবে)