somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কয়লা কালো রাজনীতি

২৩ শে অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কয়লা কালো রাজনীতি
বাংলাদেশের সম্পদ দেশীয় অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যবহার করে দেশকে আরো সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু বেশির ভাগ সময় রাজনৈতিক দলগুলো 'দেশ' ও 'জনগণের' উন্নয়ন শব্দগুচ্ছ ভুলে যায়। দেশের সার্বিক উন্নয়ন অনেকটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের ওপর। অথচ এ সম্পদ নিজের দেশে রাখার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়, জীবনও দিতে হয় মাঝেমধ্যে।

গত এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের গ্যাসের ৫০ ভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বহুজাতিক কম্পানির দখলে। গ্যাসের পর এবার তাদের দৃষ্টি পড়েছে কয়লার ওপর। বিদেশি বহুজাতিক কম্পানি জীবন ও পরিবেশ ধ্বংসকারী উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার ক্ষেত্রে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু চলমান কয়লানীতি খোলামুখ বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলে আমাদের লাভ নয়, বরং ক্ষতির সীমা থাকবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বিদেশি অর্থায়নে রপ্তানির বিধান রেখে খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করে ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে ফুলবাড়ী অভিমুখে লংমার্চের কর্মসূচি দিয়েছে।

দেশের বিস্তীর্ণ উত্তরাঞ্চলে কয়লা খনি পাওয়া গেছে। যার মধ্যে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী অন্যতম। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এ জেলায় খোলামুখ পদ্ধতিতে খনি উত্তোলনের চেষ্টা চালিয়েছিল এশিয়া এনার্জি নামের একটি ব্রিটিশ কম্পানি। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার বিদেশি কম্পানির পক্ষে, তাদের সুরেই কথা বলেছিল। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট দিনাজপুরে উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ ঠেকাতে বিডিআর-এর গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার পর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি করা হবে না বলে সেই সময় সরকার ঘোষণা দেয়। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দিনাজপুরের জনগণের সঙ্গে একটি লিখিত চুক্তি করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা থেকে বিরত থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে এশিয়া এনার্জি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করলেও কম্পানিটির কার্যক্রম স্থায়ীভাবে গুটিয়ে নেয়নি। ফুলবাড়ী কয়লাখনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা নিয়ে নানা রকম বিতর্ক রয়েছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কোনো নজির নেই পৃথিবীতে। আর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেওয়ার লোকও আছেন অনেক।
কয়লা অনবায়নযোগ্য জ্বালানি। লাখ লাখ বছর ধরে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাছপালা, জীবজন্তু ইত্যাদি মাটির নিচে থাকায় (ভূগর্ভ কিংবা ভূপৃষ্ঠের ওপর পাহাড়ি অঞ্চলে) বিশেষ মাত্রার তাপ, চাপ ইত্যাদির ফলে এক ধরনের দাহ্যতা তৈরি হয়। দাহ্য এই পদার্থই কয়লা। এই দাহ্য কয়লায় সালফার ও কার্বনের মাত্রা থাকে অনেক বেশি। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে বাংলাদেশের কয়লা খনিগুলো তৈরি হয়েছে। কয়লার নানামুখী ব্যবহার রয়েছে। তবে যেসব খাতে কয়লা জ্বালানি হিসেবে অধিক ব্যবহার হয়, তার মধ্যে স্টিল কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র অন্যতম। এ ছাড়াও ইটের ভাটা এবং ঘরের কাজে স্বল্পমাত্রায় কয়লা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি
এ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলনের দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়_উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি ও ভূগর্ভস্থ পদ্ধতি। এর মধ্যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন বেশি লাভজনক হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে বেশি আগ্রহ দেখায়। তবে এ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন অতিমাত্রায় বিপজ্জনক ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি এলাকার সব গাছপালা, ঘরবাড়ি, নদী-নালা, পুকুর, মানুষ ইত্যাদি সরিয়ে গভীর গর্ত করে কয়লা তোলা হয়। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে হলে কোনোভাবেই খনিতে পানি জমতে দেওয়া হয় না। খনি সব সময় শুষ্ক রাখার জন্য শত শত গভীর নলকূপ দিয়ে অনবরত পানি তুলতে হয়। পানির স্তরকে কয়লার সর্বনিম্ন স্তরেরও নিচে নিয়ে যেতে হয়। উন্মুক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করে খনির প্রায় সম্পূর্ণ কয়লা উত্তোলন করা যায়।
উন্মুক্ত পদ্ধতি ছাড়া আরেকটি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হয়, এর নাম আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতি। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে সুড়ঙ্গ কেটে কয়লা তোলা হয়। যে সুড়ঙ্গগুলো তৈরি করা হয়, সেগুলো যাতে ধসে না পড়ে সে জন্য সুরক্ষিত করা হয়। কয়লার স্তরের মুখে বসানো হয় কাটার যন্ত্র বা স্যাফট। এই যন্ত্র এবং এর সঙ্গের মানুষগুলোকে রক্ষার জন্য থাকে শক্ত ধাতুর তৈরি বাটি আকৃতির বিশাল ঢাল। কাটার যন্ত্র কিছু দূর কয়লা কাটার পর ঢালটি সব কিছুসহ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর এর পেছনের ফাঁকা অংশটা ধসে পড়ে। এই ধস মাটির ওপর বা ভূপৃষ্ঠেও দেখা দেয়। সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা স্তরের তিন থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত কেটে উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়ায় এ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করছে চীনের এসএমসি নামের একটি কম্পানি।

খনি অঞ্চল ও সম্ভাব্য মজুদ
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় কয়লা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলটিকে ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা কয়লা জোন বা কয়লা অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করছেন। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কয়েকটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে_দিনাজপুরের (তিনটি) ফুলবাড়ী, বড়পুকুরিয়া ও দীঘিপাড়া, রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর, জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ এবং বগুড়ার কুশমা। তা ছাড়া নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এবং নওগাঁ জেলাগুলোয় উত্তোলনযোগ্য কয়লা পাওয়ার সম্ভাবনার রয়েছে বলে মনে করছেন ভূতাত্তি্বকরা। উত্তরের এই বিশাল অঞ্চলটিকে কয়লা জোন হিসেবে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশে আবিষ্কৃত কয়লা খনিগুলোর মধ্যে ফুলবাড়ীতে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টন, বড়পুকুরিয়ায় ৩৯ কোটি টন, দীঘিপাড়ায় ৪০ কোটি টন, খালাসপীরে ১৪ কোটি ৩০ লাখ টন এবং জামালগঞ্জে ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টন কয়লা মজুদ আছে বলে ধারণা করা হয়।

বহুল আলোচিত ফুলবাড়ী কয়লা খনি

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়ায় ফুলবাড়ী কয়লা খনিটি দেশের সর্বাধিক আলোচিত খনি প্রকল্প। এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওই এলাকায় মানুষের প্রবল প্রতিরোধ রয়েছে। খোলা পদ্ধতির খনি করতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের আন্দোলনের মুখে পড়ে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এক সমাবেশে বিডিআর গুলি চালালে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট নিহত হন তিন আন্দোলনকর্মী। আহত হন শতাধিকের ওপর। ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্পটি ১৯৯৭ সালে বিএইচপি নামের একটি ব্রিটিশ কম্পানি আবিষ্কার করে। অধিক ঘনবসতিপূর্ণ ও উৎপাদনশীল আবাদি জমি থাকায় সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব নয় বলে ব্রিটিশ কম্পানি বিএইচপি মতামত দেয়। এ কারণে ১৯৯৮ সালে বিএইচপি এ প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। বিএইচপি প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেও ওই একই বছরে তারা 'এশিয়া এনার্জি করপোরেশন বাংলাদেশ' নামের একটি নবিশ কম্পানির কাছে চুক্তি এবং দুটি লাইসেন্সের স্বত্ব হস্তান্তর করে। এরপর ২০০০ সালে 'এশিয়া এনার্জি' আবার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সমীক্ষা পরিচালনা করে। তবে এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনকে লাভজনক দেখায়।
ফুলবাড়ী উপজেলার নামে কয়লা খনিটি ব্যাপক পরিচিতি পেলেও মূলত কয়লা খনির আয়তন দিনাজপুরের চারটি উপজেলায় অবস্থিত। বিশেষজ্ঞদের মতে এর মধ্যে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর ৪৫ শতাংশ, বিরামপুরের ১৫ শতাংশ, নবাবগঞ্জের ৩৫ শতাংশ এবং পার্বতীপুরের পাঁচ শতাংশ এলাকাজুড়ে খনিটি অবস্থিত। এ চারটি উপজেলার ফুলবাড়ী শহর ও পৌরসভাসহ হামিদপুর, খানপুর, জয়পুর, খয়েরবাড়ি, শিববাড়ি, দৌলতপুর, আলাদিপুর ও গোপালগঞ্জ ইউনিয়নগুলোও খনির ওপর অবস্থিত।
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে খনির শুরুতেই ভূ-পৃষ্ঠের সব গাছপালা, ঘরবাড়িসহ যাবতীয় স্থাপনা সরাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নষ্ট হবে শত শত বছরের আবাসস্থলসহ অসংখ্য প্রাণী। ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য।
এশিয়া এনার্জির জরিপ ও কৃষক সংগঠক আমিনুল ইসলাম বাবুলের গবেষণায় দেখা গেছে, ফুলবাড়ীতে জীববৈচিত্র্যের ছয়টি ধরন (বাস্তুসংস্থান) রয়েছে, গাছপালা রয়েছে ৫১২ প্রজাতির, স্থলচর মেরুদণ্ডি প্রজাতি ১৫৮টি, অমেরুদণ্ডির হিসাব নেই, মাছ রয়েছে ৮৯ প্রজাতির। এ ছাড়া খনি অঞ্চলে মসজিদ রয়েছে ২১৩টি, মন্দির ১৭৪টি, ৭৮৫টি কবরস্থান ও শ্মশান, ১৯টি গির্জা, কলেজ রয়েছে ছয়টি, হাই স্কুল ৪৩টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪০টি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬২টি, মাদ্রাসা ১৮টি, হাঁস-মুরগির খামার ৮০টি, গরু-ছাগলের খামার ১২৫টি এবং বাজার ৪৮টি। এর বাইরে রয়েছে সরকারি অফিস-আদালত, স্টেশন ইত্যাদি। শুধু জীববৈচিত্র্যই নয়, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে সরাতে হবে খনি এলাকায় বসবাসরত প্রায় দুই লাখ মানুষ।
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হলে খনিকে সব সময় শুষ্ক রাখতে হয়। খনিকে শুষ্ক রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি উত্তোলন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কয়লা উত্তোলনের পরিস্থিতি তৈরি করতে তাদের ওই অঞ্চলের পানির স্তর কয়লার সর্বনিম্ন স্তরেরও নিচে (অন্তত ১০০০ ফুট) নিয়ে যেতে হবে। তাঁরা বলছেন, এ জন্য তাদের প্রতিমিনিটে অন্তত আট লাখ লিটার পানি উত্তোলন করতে হবে। আর এ জন্য বেশ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক হাজার থেকে ১২০০ গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হবে। এতে তিনটি নদী (ছোট যমুনা, খাড়িপুল, নালসিশা), খাল-বিলসহ অসংখ্য জলাশয় ধ্বংস হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

কয়লার লাভ-ক্ষতির খতিয়ান
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মাটির নিচে কিংবা ওপরে যেকোনো খনিজ সম্পদের মালিক জনগণ। এ বিষয়ে খনিবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা আমিনুল ইসলাম বাবুল বলেন, 'খনিজ সম্পদের মালিকানা জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্বের স্বীকার করা হলেও বাস্তবে কিন্তু জনগণ সেই সার্বভৌমের খবর রাখে না।' এশিয়া এনার্জির দেওয়া তথ্য মতে, খনি থেকে রয়্যালিটি বাবদ মাত্র ছয় শতাংশ কয়লা পাবে বাংলাদেশ; এর সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত হবে। ৩৮ বছরে ছয় শতাংশ রয়্যালিটি ও ভ্যাটসহ সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাবে বাংলাদেশ। আর বিপরীতে এশিয়া এনার্জি এ খাত থেকে শুধু মুনাফাই করবে কমপক্ষে এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এশিয়া এনার্জির ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্যমতে, কম্পানিটি ৩৮ বছরে ক্রমান্বয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের আশা করছে।
স্থানীয় কৃষক সংগঠক ও ফুলবাড়ী কয়লা খনি আন্দোলনের নেতা বর্তমান ফুলবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়া এনার্জির মতো একটি বিদেশি কম্পানির দেড় লাখ কোটি টাকার মুনাফা গড়ে দিতে আমাদের ৩০ বছরে লাভ তো দূরে থাক, লোকসানই গুনতে হবে ৯ হাজার কোটি টাকা। তবে এই হিসেব ২০০৫ সালের বাজার দর ধরে করা হয়েছিলো। বর্তমান বাজার মূল্যে ক্ষতির পরিমান বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে খনি এলাকার কমপক্ষে ৬৫৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় উৎপাদন অন্তত আগামী ২০০ বছর অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর সম্ভাব্য মরুকরণ-প্রক্রিয়া শুরু হলে আরো বিস্তীর্ণ এলাকার উৎপাদন ধ্বংস হবে। উত্তোলিত বিশাল আয়তনের পানির রিজার্ভার, খনি এলাকার মানুষের পুনর্বাসন, তিনটি নদী, একটি রেল ও অন্তত একটি সংযোগ সড়কের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য ধ্বংস হবে বিশাল আয়তনের উচ্চ ফলনশীল আবাদি জমি। পক্ষান্তরে এ প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ১১০০ এবং স্বল্পমেয়াদি এক হাজার লোকের কাজ জুটবে। যার প্রায় সবই বিষাক্ত পরিবেশে নিবিড় শ্রমের বিনিময়ে নিম্নমজুরির কাজ। এসব বিবেচনায় এনে হিসাব করলে প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণই বহুগুণ বেড়ে যাবে। অন্যান্য পরোক্ষ অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ক্ষতি তো এই হিসাবের বাইরে।

খনির সামাজিক প্রভা
বছরের পর বছর ধরে একটি এলাকায় মানুষ বসবাস করার দরুন সেখানকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর পরিবেশ-প্রতিবেশের একটা বাস্তবিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ফুলবাড়ী কয়লা খনি উত্তরাঞ্চলের মানুষের সেই সামাজিক জীবনে বেশ বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন স্থানীয় জনগণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই খনির কারণে খনি এলাকার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার জায়গার মানুষজনসহ সব কিছু সরাতে হবে। ফলে খনি এলাকার ওপর বসবাসকারী প্রায় দুই লাখ মানুষ ভিটেছাড়া হবে। তবে এশিয়া এনার্জি করপোরেশন স্থানীয়ভাবে জানিয়েছে, খনির ওপরে যে ৪০ হাজার মানুষ রয়েছে, তাদের পুনর্বাসন করা হবে। পাকা ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি দেওয়া হবে।
খনির কারণে সরাসরি বেকার হবে লক্ষাধিক মানুষ। এ মানুষগুলো সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ পেলেও তা দিয়ে নতুন কিছু শুরু করার আগে নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে তা খরচ করতে হবে। মানুষের আবেগময় ও ঐতিহ্যের স্থানগুলো ধ্বংস করে ফেলায় দেখা দেবে এক নৃতাত্তি্বক ও সাংস্কৃতিক সংকট।

খনির পরিবেশগত প্রভাব
খনি এলাকার পরিবেশ দূষণ শুধু ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ কিংবা দিনাজপুরই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, পুরো উত্তরাঞ্চলই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। খনির কারণে ওই অঞ্চলের গাছপালা সব নিশ্চিহ্ন তো হবেই, সেই সঙ্গে গাছপালাকেন্দ্রিক পশুপাখি-কীটপতঙ্গ সব ধ্বংস হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ পেট্রোবাংলার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামসুদ্দী ১ জুন কালের কণ্ঠে তাঁর প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, 'এশিয়া এনার্জির মতে, প্রচুর পরিমাণ পানি সরাতে হবে এই খনি থেকে। এ জন্য প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মিলিয়ন থেকে ৮০০ মিলিয়ন লিটার করে পানি সরাতে হবে। এশিয়া এনার্জির পরিকল্পনা মোতাবেক এই উত্তোলন করা পানি থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ২৩০ মিলিয়ন লিটার পরিমাণ পানি সেচকাজে ব্যবহারের জন্য, কয়লা দ্বারা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এবং কিছু পানি নদীতে ছেড়ে দেওয়া হবে। উত্তোলিত চার হাজার ৪০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার ওভারবারডেন থেকে শতকরা ৭০ ভাগ পরিমাণ খনন করা এলাকায় ভরাট করা হবে এবং বাকি অংশ খনন করা এলাকার পাশে রাখা হবে। এশিয়া এনার্জির মতে, ১০০ গ্রামের ও ফুলবাড়ী শহরের কিছু অংশের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে সরাতে হবে এই খনি করার জন্য। খনি করার জন্য খনন করা এলাকাটিকে শুষ্ক রাখতে পানিবাহিত স্তর ও কম পানিবাহিত স্তরকে ডিপ্রেসারাইজড রাখতে হবে অর্থাৎ এই স্তরের পানির চাপ কমাতে হবে। খনি পানিশূন্য করার ফলে খনি এলাকার চারদিকে পানির স্তরও নেমে অসমভাবে উপবৃত্তাকার রূপ ধারণ করবে। যার প্রভাব পড়বে খনি এলাকার চারদিকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ভূগর্ভস্থ পানি কমার ফলে ফুলবাড়ী শহরসহ চারদিকের গ্রামগুলো পানি পাবে না এবং ওই অঞ্চলে চাষাবাদ করাও কঠিন হবে।

উন্মুক্ত কয়লা যেসব দেশে তোলা হয়
জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হয়। তবে ওইসব দেশে এমন এলাকা থেকে কয়লা তোলা হয়, যেখানে মানুষের কোনো বসবাস নেই। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার রয়েছে ৬.৪ জন, জার্মানিতে রয়েছে ৬০৯ জন। সেখানে বাংলাদেশে রয়েছে ২৮৫০ জন। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যেকোনোভাবেই কয়লা তোলা সম্ভব নয়_তা বুঝতে পেরেছিল ব্রিটিশ কম্পানি বিএইচপি। তাই কয়লা আবিষ্কার করলেও তারা উন্মুক্ত থেকে উত্তোলনের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় খনির দায়িত্ব হস্তান্তর করে এ দেশ থেকে চলে যায়।

কয়লাখনির দাবানল বিপর্যয়
যেকোনো ধরনের কয়লা খনি_উন্মুক্ত বা উন্মুক্ত কিংবা ভূ-গর্ভস্থ হোক না কেন, সেখানে থাকে দাবানলের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। বজ্রপাত বা অন্য কোনোভাবে খনিতে একবার দাবানলের সৃষ্টি হলে তা আর নেভানো সম্ভব নয়। শত শত বছর ধরে জ্বলতে থাকবে। পৃথিবীর কয়েক হাজার কয়লা খনিতে আগুন লেগেছে এবং তা যুগ যুগ ধরে আজও জ্বলছে। ওই দাবানল নেভানোর মতো কোনো প্রযুক্তি এখনো পৃথিবীতে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। খোদ আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার কয়লা খনিতে ১৯৬৭ সাল থেকে আজও আগুন জ্বলছে। টেকনিশিয়ানরা সব রকম চেষ্টা ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করে আজও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি সে আগুন।

গ্যাসের পর এবার কয়লা
বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে_এ রকম প্রচারণা ছিল। সে সময় গ্যাস ভারতে রপ্তানি করার জোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। সে সময় দেশের রাজনীতিবিদদের মুখে শোনা যেত_মাটির তলে গ্যাস রেখে লাভ কী? এ প্রচারণার এক দশক পার হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশ গ্যাস রপ্তানি তো দূরে থাক, উল্টো গ্যাস নিঃশেষ হওয়ার পথে। বর্তমান যে মজুদ রয়েছে, অচিরেই তা শেষ হয়ে যাবে। এখন একই কায়দায় গ্যাসের মতো কয়লার মজুদ নিয়ে নানামুখী প্রচারণা চলছে। বাংলাদেশে খনিজ জ্বালানি মজুদ নিয়ে বাস্তব অবস্থা থেকে বাড়িয়ে বলা হয়।

উন্মুক্ত খনির জন্য তৎপরতা
২৬ আগস্ট, ২০০৬ ফুলবাড়ীর জনগণ বুকের রক্ত দিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লা খনির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে প্রাণ দিয়েছে। তবে এশিয়া এনার্জির তৎপরতা গুটিয়ে যায়নি। উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লা খনির ব্যাপারে জনমত গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে কম্পানিটি। প্রচারণার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে এশিয়া এনার্জি তাদের অর্থায়নে জার্মানিতে নিয়ে যায়। সেখানে তারা জার্মানির উন্মুক্ত কয়লা তোলার বিষয়টি সরেজমিন ঘুরে দেখেন। সেখানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া গণমাধ্যম-কর্মীরা এশিয়া এনার্জির সহযোগী জার্মানির জঐঊ কম্পানির কর্মকর্তাদের ভাষ্য শুনেই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বাংলাদেশের সঙ্গে জার্মানির পরিবেশের একটা তুলনামূলক উপস্থাপন। তা না করে এশিয়া এনার্জি শুধু উন্মুক্ত কয়লা খনিগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে এনেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম-কর্মীদের। বাংলাদেশে যমুনা সেতু তৈরি করতে গিয়ে ৪৫ হাজার মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে, যাদের অধিকাংশেরই আর বাসস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। সেখানে পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষ যদি উচ্ছেদ হয়, তাহলে কী হবে আন্দাজ করা কঠিন। এর বাইরে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নজরে আনেনি বলে বাংলাদেশের খনি বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাংলাদেশের মটির গঠন, পানির গভীরতা, বৃষ্টি ও বন্যার ধরন_সব কিছুই জার্মানি থেকে ভিন্ন এবং তা কোনোভাবেই উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির উপযোগী নয়। বাংলাদেশের জনবসতির ঘনত্ব জার্মানির তুলনায় এত গুণ বেশি যে তা কোনোভাবেই তুলনীয় হতে পারে না। জার্মানিতে যেমন এক অঞ্চলের মানুষদের সরিয়ে অন্য অঞ্চলে নতুন জনবসতি স্থাপন করা যায়, বাংলাদেশে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল জালের মতো ছড়ানো; যা জার্মানিতে নয়। এক জায়গায় দূষণ ঘটলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বন্যায় যার তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে দূষণ তাই বাংলাদেশে যেভাবে ছড়াবে, জার্মানিতে ততটা হয় না। ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের যে প্রয়োজন বাংলাদেশে আছে, তাতে মরুকরণের যে বিস্তার ঘটবে; জার্মানিতে তার সম্ভাবনা কম। মাটির গঠনের কারণে বাংলাদেশে মাটির ধস যেভাবে ঘটে, জার্মানিতে তার সম্ভাবনা নেই। তার পরও জার্মানিতে এই খনির জন্য '২৪৪টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পানি চিরদিনের জন্য টলটলে দেখালেও বিষাক্ত।' তাহলে বাংলাদেশের কী অবস্থা ঘটতে পারে?
উল্লেখ্য, জার্মানির এ উন্মুক্ত খনন-পদ্ধতি তার পরও প্রশ্নের ঊধর্ে্ব নয়। এর ক্ষয়ক্ষতির তালিকা দীর্ঘ। জার্মান রাষ্ট্রের অনেক দক্ষ তত্ত্বাবধান ও পরিবেশদূষণ রোধে ব্যয়বহুল ব্যবস্থা গ্রহণের পরও বিষাক্ত পানি, চাষের অনুপযোগী মাটির তথ্য_এসব স্পন্সরড রিপোর্টে উল্লেখ করা না হলেও সেসব তথ্য সুলভ।
জার্মানির দৃষ্টান্ত যাঁরা বাংলাদেশে হাজির করেছন তাঁদের দিকে সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ পেট্রোবাংলার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামসুদ্দীন, ১ জুন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধে। তিনি বলেছেন, 'জডঊ (জার্মানি) উন্মুক্ত খনির সঙ্গে ফুলবাড়ী (বাংলাদেশ) উন্মুক্ত খনি তুলনীয় নয় : এশিয়া এনার্জি জার্মানির জডঊ উন্মুক্ত খনির অভিজ্ঞতা ফুলবাড়ীতে ব্যবহার করবে বলেছে। কিন্তু ফুলবাড়ী এবং জডঊ (জার্মানির) প্রেক্ষাপট ভিন্নতর। জার্মানি পৃথিবীর একটি খুব উন্নত ও শিল্পপ্রধান জাতি বা দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর খুব ঘনবসতিপূর্ণ ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর একটি। ৫০ বছর ধরে জডঊ পুনর্বাসিত করেছে ৩০ হাজারের বেশি জনসাধারণকে একদম পতিত ও অব্যবহৃত জমিতে। অন্যদিকে ফুলবাড়ী এলাকার প্রায় দুই লাখ মানুষকে খনি করার ৩০ বছর পুনর্বাসিত করতে হবে বেশির ভাগ কৃষিজমিতে নতুবা ব্যবহৃত জমিতে। এ ধরনের জমি সহজেই পাওয়া যাবে না। জডঊ এক হাজার ৪০০টি কূপ স্থাপন করেছে, যাতে খনি থেকে উত্তোলিত পানি ১০০ শতাংশ রিইনজেকশনের মাধ্যমে ভূগর্ভে পাঠানো যায়। অন্যদিকে এশিয়া এনার্জির প্রস্তাব ৮০ থেকে ১০০টি নলকূপ স্থাপন করা, যার মাধ্যমে উত্তোলিত পানির মধ্যে ২৫ শতাংশ পানি রিইনজেকশনের মাধ্যমে ভূগর্ভে পাঠাবে। বাংলাদেশের ফুলবাড়ীর কয়লা বেসিনটি গবমধ, টহপড়হভরহবফ, গধংংরাব চড়ঃবহঃরধষ অয়ঁরভবৎ নিচে অবস্থান করছে। অন্যদিকে জার্মানির জডঊ-এর খনিটি এ ধরনের কোনো চড়ঃবহঃরধষ অয়ঁরভবৎ-এর নিচে অবস্থান করছে না। জডঊ রিইনজেক্ট করছে ১০০ শতাংশ পানি, অন্যদিকে এশিয়া এনার্জির প্রস্তাব ফুলবাড়ীতে তারা ২৫ শতাংশ পানি রিইনজেক্ট করবে। ফুলবাড়ী ভূতাত্তি্বক ও ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিবিষয়ক যে গঠন তা সর্বৈবভাবে জডঊ-এর গঠনের দিক থেকে ভিন্নতর। জডঊ খনিটি জার্মানির স্থানীয় বিশেষজ্ঞ দিয়ে উন্নয়ন করেছে, অন্যদিকে ফুলবাড়ী খনিটির উন্নয়ন করার জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞের প্রস্তাব করা হয়েছে। উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ফুলবাড়ীর উন্মুক্ত কয়লা খনির সঙ্গে জডঊ উন্মুক্ত কয়লা খনিতুল্য নয়। সুতরাং জডঊ-এর অভিজ্ঞতা ফুলবাড়ীর ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাবে না।' জার্মান খনি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে ঘোরাফেরা করছেন। কারণ একটাই, যদি উন্মুক্ত কয়লা খনি করা যায় তাহলে কনসালটেন্ট বা পরামর্শের কাজটা হয়তো তারাই পাবে।

পৃথিবীব্যাপী উন্মুক্ত কয়লা খনি

মাটি, পানি, জীববৈচিত্র্যসহ সামগ্রিক পরিবেশ এবং জনবসতি জীবন-জীবিকার ওপর উন্মুক্ত খনন-পদ্ধতির যে বিষফল, সে সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়ছে। কোনো কোনো দেশে এ পদ্ধতির বিরুদ্ধে আইন করে তা নিষিদ্ধ হচ্ছে। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া সীমান্তে উন্মুক্ত কয়লা খনি স্থাপনে বাধা দিয়েছে এই যুক্তিতে যে তা যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশের বিশেষত সীমান্তবর্তী লেকের চিরস্থায়ী ক্ষতি করবে। গত এক বছরের মধ্যে আর্জেন্টিনা ও কোস্টারিকা উন্মুক্ত খনন-পদ্ধতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পেরুতে জনবসতি, পরিবেশ এবং জীবন-জীবিকার ওপর ধ্বংসাত্মক ফল বিবেচনা করে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে স্বর্ণ উত্তোলনের কানাডীয় একটি প্রকল্প গণভোটের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে। লুটেরা ও দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠী থাকায় দুর্বল দেশগুলোতে বহুজাতিক কম্পানি এর পরও উচ্চ মুনাফার সন্ধানে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের নানা কূটচাল চালাচ্ছে। কিন্তু ক্রমে সর্বত্রই সৃষ্টি হচ্ছে জনপ্রতিরোধ। সম্প্রতি ভারতের বৃহৎ গ্রুপ মিত্তাল আফ্রিকার জায়ার থেকে তাদের ব্যবসাপাতি গুটিয়ে সরে পড়েছে। কারণ একটাই, উন্মুক্ত খনি তাদের পক্ষে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। মিত্তাল গ্রুপ জায়ারে উন্মুক্ত বঙ্াইট খনি তোলার কাজ হাতে নিয়েছিল। যদিও উন্মুক্ত যেকোনো খনিই অধিক লাভজনক, কিন্তু সুদূরপ্রসারী বিবেচনায় তা পরিণত হয় লসে। কারণ খনি কম্পানিগুলো শুধু তাৎক্ষণিক ক্ষতির পরিমাণের হিসাব কষে থাকে। কিন্তু পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে খনির দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশের ক্ষতিপূরণ যোগ হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, এ কারণে উন্মুক্ত যেকোনো প্রকার খনি উত্তোলন লসে পরিণত হয়েছে।

যাদের কথা মাথায় রেখে চূড়ান্ত করা
হচ্ছে কয়লানীতি

বিগত সরকারের সময় করা ৩৩ পৃষ্ঠার খসড়া কয়লানীতিকে ছয় পৃষ্ঠায় সংক্ষিপ্ত করেছে বর্তমান সরকার। বর্তমান সরকারের সঙ্গে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা ৩৩ পৃষ্ঠার খসড়া কয়লানীতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বর্তমান সরকারও বিদেশি বিনিয়োগ টার্গেট করে কয়লানীতি সম্পূর্ণ করছে। তবে বাড়তি যোগ করেছে এ সরকার_তা হলো, টেন্ডার ছাড়াই কয়লা খনি উন্নয়নের কাজ দেওয়া যাবে। টেন্ডার ছাড়াই কয়লা খনি কম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সুবিধা রেখে 'কয়লানীতি-২০১০' মন্ত্রিসভায় পেশের জন্য চূড়ান্ত করেছে। এ নীতিমালার ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে_'দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে ও পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কয়লা অনুসন্ধান, উন্নয়ন, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ এবং প্রত্যক্ষ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হবে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে দেশি বেসরকারি বা বিদেশি সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কয়লা অঞ্চল ও দেশের কয়লা খাত উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, খনি উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং খনি-ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তাকে স্বাগত জানানো হবে।'

তিন 'না'-এর ফুলবাড়ী অভিমুখে লংমার্চ
বিদেশি না, রপ্তানি না ও উন্মুক্ত না_এই তিন 'না' স্লোগান নিয়ে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ২৪ থেকে ৩০ সেপ্টম্বর ঢাকা থেকে ফুলবাড়ী অভিমুখে লংমার্চের আয়োজন করেছে। এ সময় জাতীয় কমিটি প্রায় আটটি জেলার ২৫টি থানায় পথসভা করবে। লংমার্চের মাধ্যমে জাতীয় কমিটি মানুষের মধ্যে বিদেশি রপ্তানি বন্ধ, উন্মুক্ত খনি না করা ও বিদেশি মালিকানায় খনি করার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবে বলে জানালেন জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
উন্নয়ন শব্দটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব থেকেও রাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের জায়গা করে জটিল রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ। এখানে উন্নয়ন আসে ভয়, আতঙ্ক আর কৃষক ও গরিব মানুষের উচ্ছেদের নাম নিয়ে। বাংলাদেশের ফুলবাড়ীও এর ব্যতিক্রম নয়। উন্নয়নের একটি সামগ্রিক দর্শন দাবি করে। যেখানে উন্নয়ন হলো মানবজাতির জন্য, কোনো বিশেষ কম্পানির মুনাফার তৈরির হাতিয়ার নয়। যেখানে মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়নের তত্ত্বও প্রয়োগ করা হবে। বাংলাদেশের জনগণও আশা করে, এখানকার শাসক শ্রেণী এই ভূখণ্ডের জনগণের সামগ্রিক উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কাজ করবেন, যেখানে জনগণের কথা মাথায় রেখে করা হবে।
মূল্ লেখাটি এই লিংকে দেখুন Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×