১১০০ টাকা মাইনে পেয়ে মিনিট পাচেক কিছু আবেগী প্রলাপ আর বিনিময়ে শুধু কিছুটা ফুপিয়ে কান্নার শব্দ - একটা আলোড়ন তুলেছিলেন অঞ্জন দত্ত এই বেলা বোসকে সামনে এনে । জানেন তো ? গানটা বের হবার পর অঞ্জন দত্তের নামে একটা মামলা হয়েছিল… মামলা করেছিলেন একটা পত্রিকার সম্পাদক যার ফোন নম্বর ছিল ২৪৪১১৩৯। কারন তাকে বাধ্য হয়ে সেই নম্বরটি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। আমরা অনেকেই হয়ত এমন ফাড়ি কাঠের জবাইয়ের সিচুয়েশানে পড়িনি তবুও ‘বেলা বোস’ কিংবা ‘২৪৪১১৯৩’ এখনো কিছু গভীর, চাপা কষ্টের ছবি আমাদের মনে আকতে সক্ষম। আজ ঘটনা পরিক্রমায় পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে … বদলেছে মানুষ, বদলেছে চাহিদা, বদলেছে সময় কিংবা রাজনীতি। কিন্তু এই বেলা বোস কিংবা ওমন ফোন নম্বরের সংখ্যা কিন্তু খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি, বরং আমি বলব বেড়েই চলেছে…
আমার দৃষ্টিতে পরিবর্তনের শুরুটা দেখতে হলে আমাদের কিছুটা পিছিয়ে দেখতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ , হিটলারের আগ্রাসন, চিনে মাও সে তুং এর কম্যুনিজমের গোড়াপত্তন - এগুলো কিন্তু মোটামুটি সল্প কিছু বিরতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। এবার আপনি বর্তমানের সাথে তুলনা করুন, যুদ্ধ বিগ্রহ খুব কম সারা পৃথিবীতে। হ্যা বিচ্ছিন্ন ভাবে সিরিয়া, আফগানস্থানে কিছু এজেন্ডা নিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে কিন্তু সেই হিসেবটা গত ১০০ বছরের তুলনায় কিন্তু খুবই কম। আমরা এখন শান্তি চাচ্ছি … এই আমূল পরিবর্তনের অন্যতম একটা চাবিকাঠি হল “ভালোবাসা”। আপনি বব ডেলানের লিরিক গুলো দেখেন, তার গান মানেই ছিল প্রোটেষ্ট মিউজিক… যেখানে Blowing in the wind এর মত প্রতিবাদী গানগুলো আসছে, সেই বব ডেলানই একটা সময়ে Rock n Roll মিউজিকে শিফট করলেন। যেখানে প্রেম, ভালোবাসা, পাওয়া-না পাওয়া কিংবা অনুভূতিকে অনেক বেশি প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে। ব্যাক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় সময় স্রোতে ভর করেই এই পরিবর্তন গুলো আসছে… ভবিষ্যতেও আসবে। বেলা বোসকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কেন যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা বব ডেলানকে টেনে আনলাম তার কিছু কারনও আছে। যেহেতু বর্তমানে যুদ্ধ-বিগ্রহ কমে গেছে তার মানে এই দাঁড়ায় যে আমাদের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধবোধ কিংবা সহনশীলতা বেড়ে গিয়েছে। আর ঠিক তাই ভালোবাসা সংক্রান্ত সমস্যা গুলোও এখন বেড়ে গেছে… ব্রেক-আপ, বিচ্ছেদ কিংবা বেলাবোসদের মত সিচুয়েশান, সে যাই বলুন না কেন আপনি। সমস্যা গুলো বেড়েই চলেছে।
এবার ফিরে আসি ১৯ শতকের শেষের দিকের কলকাতায়… অনেকটা আমাদের ভাষায় সাদাকালো সময়। সেখানে প্রেমিক-প্রমিকার সর্বোচ্চ ঘনিষ্ট মুহুর্ত ছিল বোধহয় হাতের সবচেয়ে ছোট আংগুলটি দিয়ে দুজনে একটা বন্ড করে ঘুরে বেড়ানো। রুম ডেটিং পর্যায়ে তখনো ভালোবাসাটা পৌছায়নি… বিভিন্ন রেস্তোরার পর্দা টানানো কেবিনেই দুজন একান্ত ভাবে চাট্টিখানি কথা সারতে পারত। গানটা মূলত অঞ্জন দত্ত এমন একটা সময়কে সাক্ষী করেই লিখেছিলেন- যেখানে কলকাতার জয়েন্ট ফ্যামিলি গুলো ভেংগে যাচ্ছে, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ভয়ে ভয়ে প্রেম করছে, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বেকারদের সংসারের হাল তুলে নেবার পূর্ব মূহুর্তের কিছু দুশ্চিন্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রেমটা যতটা আবেগ দিয়ে হয় বাস্তবতা ততটা ওপথ মাড়ায় না। রেস্তোরার কেবিনে বসে হয়ত ওরা স্বপ্ন দেখেছিল একটা ছোট্ট সংসারের … এতটার ছোট যে সেটা স্বপ্ন কিংবা অলীক কল্পনাতেই বেশি মানায়। আসতে আসতে সময়ের স্রোত এগিয়ে যায়… মেয়েটি একান্ত ভাবে বুঝতে শিখে যে অতটা ছোট্ট সংসারে ওর চলবে না। ছেলেটা ও পিছিয়ে থাকে না, ও বুঝতে শিখে সে ঠিক কতটা দৌড়ুতে পারবে। একটা সময় ছেলেটা গ্রাজুয়েশান শেষ করে ফেলে… বয়েস বেড়ে যাবে ভয়ে মেয়েটার পরিবারও বিয়ের জন্য চাপ দেয়। আমার মনে হয় তখনকার মেয়েগুলো বোধহয় আজকের মত এতটা সাহসী ছিলনা বরং বেলাবোসের মত লক্ষী ছিল… পরিবারের সিদ্ধান্তটাই শেষমেশ বিনা বিচারে মেনে নিত ওদের অধিকাংশ। ফলে ফোনের ওপাশ থেকে অঞ্জন দত্তরা ফুপিয়ে কান্নার শব্দটা ছাড়া খুব একটা রেস্পন্স পেতেনও না।
তাহলে বেলাবোস দের কি হবে ? কেন কি আবার হবে … বেলাবোসরা কি সংসার করবে। বেলার থেকে বেলার বাবা-মায়ের বেশি যানেন সংসার করতে কি লাগে ভালোবাসা না তার সাথে যথেষ্ঠ স্বচ্ছলতা … তারা জানেন ১১০০ আর ৩১০০০ অংক দুটির পার্থক্য কত বেশি। সত্যি বলতে কি জানেন , বেলাবোসরা ভালই থাকবে … একটা সিকিউরড ভবিষ্যত যেখানে কোন টানা পোড়েন নেই, টিপে টিপে খরচার কোন চিন্তা নেই কিংবা নেই ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটা ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো নিয়ে দুশ্চিন্তা। ভালোবাসা ? সেটা তো সব ছেলেরাই বাসতে পারে… হয়ত একটা নতুন ধরনের ভালোবাসা পাবে বেলা। বিয়ের প্রথমে হয়ত ভালোবসার মানুষটা কিংবা ভালোবসাটা একটু অচেনা থাকবে , কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে ই হবে সবচেয়ে পরিচিত একটা মানুষ। তারপর ২৪৪১১৩৯ এ ফোন করে আর বেলাবোস দের পাওয়া যাবে না… আর শ্বশুর বাড়ির নম্বরটা হয়ত তার প্রমিকরা ম্যানেজ ও করতে পারবে না।
তারপরও বেলাবোসরা কোন বৃষ্টির এক রাতে নষ্টালজিক হয়ে যাবে। বারান্দার গ্রিল ধরে বৃষ্টি দেখবে… আর মনে পড়বে পুরোনো প্রমিকের কথা, মনে পড়বে দুজনের মিলে দেখা সস্তা কিছু স্বপ্নের কথা কিংবা বদ্ধ কেবিনের মধ্যকার কথোকথন গুলো। ঐ একই বৃষ্টির ফোটাগুলো বেলার স্বামীর মধ্যেও একটা চাহিদা তৈরী… গ্রিল ছেলে বিছানায় আসতে খুব করে আকর্ষন করবে সে বেলাকে। বেলা লক্ষী বাধ্য প্রকৃতির মেয়ে… স্বামীর আবেদনে সে না করবে না কখনোই, যেমনটি করেনি তার মা বাবার নেয়া সিদ্ধান্তে। তারপর একটা পরিণত আদিম ভালোবসার সাক্ষী হবে বেলা … মুহুর্তেই ভুলে যাবে পুরোনো প্রমিকের সাথে দেখা লাল নীল সংসারের স্বপ্নটা। রাতের বৃষ্টির সাথে ধুয়ে যাবে পুরোনো বস্তাপচা ঐ স্মৃতিগুলো। তারপর একটি নতুন সকাল, একটা নতুন সূর্য … আর কপালে সিদুর লাগিয়ে লাল শাড়ীতে স্বামীর ঘুম ভাংগানোয় চেষ্টারত একটি অত্যন্ত বাধ্যগত বেলা বোস।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৭