জয়ীদের বাড়িটা চারতালা, একটা পুরোনো পাড়ায় … ওরা থাকে সেকেন্ড ফ্লোরে। জয়ীর পৃথিবী বলতে ওর সাজানো গোছানো শোবার ঘরটা… ছোট থেকেই বেশ পরিপাটি মেয়েটা। রুমের উত্তর দিকে একটা জানালা আছে, তার ছিটকানিতে মোটামুটি মরিচা পড়ে গেছে, ওটা ঠিক খোলা হয়না আর। বাড়ীটা পুরোনো পাড়ায় হবার কারনে আশেপাশে বস্তির সংখ্যাই বেশি, আর জয়ীর রুমের জানালা দিয়ে বস্তিগুলো বড্ড উলংগ অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। এই বাড়িতে ওঠার প্রথম দিকে জয়ী জানালা দিয়ে নিচটা প্রায় দেখত … কিন্তু দৃশ্যটা ওর ভালো লাগত না। ক্ষুধা, দারিদ্র, অভাব, টিকে থাকার লড়াই – সবকিছু একটি ফ্রেমে ভেসে আসতে একটুও সময় নিতনা। মন খারাপ হয়ে যেত মেয়েটির । হয়ত ওর মা ব্যাপারটি খেয়াল করেছিলেন, বুঝতে পেরেছিলেন জানালাটা মেয়ের চিন্তা-ধারার উপরে বেশ প্রভাব ফেলছে। ব্যাস … তারপর থেকে জানালাটা খোলা নিষেধ ছিল।
জানালা যে জীবনযাপনের একটা অংশ হতে পারে এটা কখনো জয়ীর মাথায় আসেনি …অন্তত যতদিন দ্বীপ ওর পাশে ছিল । পারিবারিক কড়া শাসনের মধ্য দিয়ে মানুষ হলেও মেয়েটা ছিল বড্ড বেশি নিরীহ … ওর মাঝে মাঝে এটা ভেবে হাসি পায় যে যখন ও মা হবে তখন কিভাবে শাসন করবে ওর ছেলে মেয়েদের !! ওর ভয় ছিল বকা দিতে গিয়ে ও হেসে ফেলবে। হয়ত এমন সপ্নের কারন হিসেবে দ্বীপও খানিকটা জড়িত ছিল। দ্বীপের সাথে জয়ীর আলাপ ও যখন ক্লাসে এইটে পড়ে … সাইকেল নিয়ে ছেলেটা রোজ় ফলো করত জয়ীকে কোচিং এ যাবার পথে । জয়ী ব্যাপারটা খেয়াল করলেও কোন কেয়ার করেনি। কিন্তু একদিন দ্বীপ সাইকেল থামিইয়ে সরাসরি জয়ীকে বলে ফেলে “আমি তোমাকে ভালোবাসি” !!! জয়ী অবাক হয়েছিল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলাটা এতো সহজ ?? সে প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছিল … কিন্তু এভয়েড করতে করতে একদিন কিভাবে যেন ও দ্বীপকে মিস করতে শুরু করে। তারপর দ্বীপকে সামান্য প্রশ্রয় দিল ও … শর্ত ছিল কোচিং এ যাবার পথে শুধু ঐ সময় টুকুই কথা বলবে ওরা। কোন ফোন নয়, ডেটিং নয়। কিন্ত এই শর্তে বেশিদিন সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি দ্বীপ। সে প্রায়ই জয়ীকে একটু দূরে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইত … এমন জায়গার নাম বলত যেগুলো জয়ী কখনো শোনেনি। দ্বীপকে অনেক ভালোবাসত ও, ওর ছোট্ট পৃথিবীর অনেকখানি নিয়ে নিয়েছিল সে … কিন্তু জয়ীর কাছে যে ভালোবাসার সংগাটা ছিল তাতে স্পর্শ, গায়ের গন্ধ কিংবা নিঃশ্বাসের গাড় উষ্ণতা কখনোই প্রভাবক ছিল না। না করে দেয় সে দ্বীপকে … যতটুকু জয়ীর মনে আছে কয়েকদিন না করবার পরে দ্বীপ ওকে “আনকালচারড” বলে কোচিং এর ঐ রাস্তাটাতেই ফেলে রেখে যায়। তারপর জয়ীকে দেখিয়ে দেখিয়ে পালাক্রমে কয়েকটি মেয়েকে নিয়ে ঘুরেছে দ্বীপ … হয়ত মেয়েটিকে কালচার শেখাবার জন্য। দুই মাস হতে চলল … দ্বীপ আর জয়ীকে ফেলে গেছে। সাজানো, গোছানো লক্ষী মেয়েটা এখন অনেকটাই শেকড়হীন অনুভব করে। ওর মা-বাবা চাকুরিজীবি হওয়ায় মেয়ের এই ভেংগে পড়াটা তারাও টের পায়নি।
হঠাৎ একদিন জয়ীদের পাশের বাড়ির বস্তিটাকে অনেক শোরগোল শোনা যায় … খুব কৌতুহল হয় ওর । মায়ের নিষেধ থাকলেও তিনি এখন বাড়ী নেই, জানালা খুলে দিল সে। জয়ী কিছুক্ষন খেয়াল করবার পর বুঝতে পারল কেউ একজন মারা গেছে ওখানে … একজন ওর মায়ের মত বয়ষ্ক মহিলা মাটি চাপড়ে চাপড়ে কাদছে। আর এক বছরের একটা নেংটা ছেলে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে… পিচ্চিটা কাদছিল কিনা অনেক খেয়ালের পরও জয়ী বুঝতে পারেনি। আচ্ছা … পরিবারটার কি হবে !! বাচ্চা ছেলেটা কি বুঝেছে ওর বাবা মারা গেছে !!! এমন অনেক প্রশ্ন নিয়ে সে আস্তে আস্তে জানালাটা বন্ধ করে দিল।
পরদিন খুব সকালে কৌতুহল বশত আবার জানালা খুলে সে … কিন্তু অবাক হয়ে যায়। কালকের শোকের লেশমাত্র সেখানে নেই। সে দেখল কিছু বাদাম ওয়ালা ঝোলা, বাশি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে … কারো কারো হাতে ঝুড়ি কোদাল। বস্তির কিছু ছেলে বাড়ির পাশে একটা ফাকা জাগায় মার্বেল খেলছে। বাড়ির বউরা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে, কেঊ কেঊ কয়লা দিয়ে দাত মেজে কল পাড়টায় লাইন দিয়েছে মুখ ধোবার জন্য। তাদের ভিতর জয়ী সেই মহিলাটাকে দেখল যার স্বামী কাল মারা গেছে। মহিলাটা ভাংগা চুলার কিছু কিছু জায়গা মাটি দিয়ে লেপে দিচ্ছে। আর বাচ্চাটা পাশেই একটা বস্তার উপরে বসে খেলা করছে … । জয়ী একটা অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করল… এত অভাবে থাকবার পরেও এদের চেহারায় কেমন যেন একটা তৃপ্তির ছাপ আছে। ওরা কেন জানি সুখে আছে। মানুষের ব্যাক্তিগত জীবন যাপন এতটা কাছ থেকে আগে কখনো দেখেনি জয়ী। এই মানুষগুলো সারা পৃথিবীর ভেংচি থেকে মুখ ফিরিয়ে দিব্যি বেচে আছে… আর ও কিনা আজ শুধু দ্বীপের জন্য থেমে আছে যার কাছে ভালোবাসা মানে স্পর্শ ?? একটা অদ্ভুত জীবনবোধের সাথে পরিচিত হয় জয়ী… পায় উঠে দাড়াবার কিছু অনুপ্রেরনা। তারপর থেকে ওর ঘরের উত্তরের ঐ জানালাটা আর কখনো বন্ধ হয়নি। শীত … গ্রীষ্ম … বর্ষা … কখনোই না।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:০৫