ত্রিভুজের লিখা একটি পোস্টের জবাব এটি । উনি বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেন ঢাকা বিশ্ব: প্রতিষ্ঠার বিরোধীতাকারী রবীন্দ্রনাথকে সম্মান করবে, 'কোট' করবে । এরকম মন্তব্য আজকাল এই ব্লগে খুব চোখে পড়ে । বলা বাহুল্য, আমরা জানি এর গভীর অন্তর্নিহীত উদ্দেশ্য ।
আমাদের মনে আছে ১৯০৫ এ যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হয় তখন তা রদ করতেও একটি শক্তিশালী কোলাকাতা কেন্দ্রীক আন্দোলন হয় । এর ফলে ১৯১১-য় তা রদও হয় । ১৯০৫-এ যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হচ্ছে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদে, তখন আমাদের স্বপ্ন হলো আমাদের মত সরকারের, একটি রাজধানীর, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের । এই প্রেক্ষিতেই জন্ম হল মুসলিম লীগের, ১৯০৬-এ ঢাকায় ('৪৭ পরবর্তী প: পাকিস্তানে নয়) । অন্যদিকে কংগ্রেস তথা দিল্লী-কোলকাতার লোকজন এটাকে ব্রিটিশদের ডিভাইড এন্ড রুল-এর চিরাচরিত কৌশল হিসেবে বিবেচনা করল । রাজীনীতির দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে তাদের এ ধারনাকে পুরোপুরি অমুলক বলা যায়না । ব্রিটিশরা আমাদের জন্য অন্ত:প্রান ছিলেন এমন ভাবার কারন নেই ।
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ চাননি । তিনি এটাকে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ বলে মনে করতেন । নিজের জন্মভুমিকে তিনি মা হিসেবেই ভাবতেন, যেমনটি আমরাও ভাবি । এ মায়ের বুকের উপর ছুরি চালিয়ে দু'টুকরো করে বিবদমান দুই ভাইকে ভাগ করে দেয়া তিনি মানতে পারেননি । এজন্য প্রথাবদ্ধ রাজনীতি-বিমুখ হয়েও এসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন । বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তার এই অবস্থান তাৎক্ষনিকভাবে ঢাকা কেন্দ্রীক ব্রিটিশদের সব চিন্তার বিরোধী হয়ে উঠেছিল। তার এই অবস্থান আমাদের স্বার্থের পরিপন্থি ছিল । কিন্তু তাই বলে তার বাংলা মাকে বৃহত্তর-অখন্ড দেখতে চাওয়া আর ব্রিটিশদের ডিভাইড এন্ড রুল-এর বিরুদ্ধাচরন করা অমার্জনীয় অপরাধ হতে পারেনা । ব্যপারটি বিবেচনা করতে হবে সামগ্রীক প্রেক্ষাপটে ।
রবীন্দ্রনাথ প্রজাবৎসল ছিলেন বলে তার জমিদারীতে সেচ, কৃষি ঋন, সড়ক-নৌপথ নির্মাণ করেছিলেন । এসব তো পূর্ব বাংলায় । জীবনের বেশীর ভাগ সময় তিনি এই পূর্ব বাংলায় কাটিয়েছেন, অন্যান্য বিলাসী জমিদারদের মত কোলকাতায় নয় । নিজের অক্লান্ত প্রচেস্টায় গড়েছেন শান্তিনিকেতন । কখনও ভাবেননি মায়ের ভাষা বাংলা ফেলে হিন্দী বা ইংরেজীতে সাহিত্য রচনা করবেন (আজকাল অনেক বিলেতী শিক্ষিতরাই তা করছেন) । জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে উনি নাইট উপাধি ছুড়ে ফেললেন । শুধুমাত্র বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কারনেই তাকে আমাদের ত্যাজ্য করতে হবে? আমি কিন্তু আজও ভাবি, নজরুল যদি ১৯৪০-এ এসে অমন ভাষাহীন-চলৎশক্তিহীন হয়ে না পড়তেন, রবীন্দ্রনাথ যদি '৪১ থেকে '৪৭ মাত্র আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকতেন, বাংলার ইতিহাস আজ অন্যভাবে লিখা হতে পারত । বাংলা মায়ের জন্য অমন ভালবাসা, কোটি বাংগালীকে জাগিয়ে তোলার অমন ক্ষমতা তখন যে কেবল এদেরই ছিল ।
আজকাল দেখি কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ কে হিন্দু কবি আর এক সময়ের নাস্তিক নজরুলকে ইসলামি কবি হিসেবে মুখোমুখি দাঁড় করান । কি পরিহাস নজরুল, কি দু:খ তোমার ! বেচে থাকতে এরা তোমাকে মানবতাবাদী হতে দেয়নি, একটুও শান্তিতে থাকতে দেয়নি তোমায় ফতোয়ায় আর ফতোয়ায় । কমিউনিস্ট ছিলে বলে তোমাকে এল.এম.এ বানায়নি, প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করেছিলে বলে কোলকাতার মৌলভিরা তোমার বাসায় নেমন্তন্ন নেয়নি । আজ মরে গিয়েও তোমাকে মানবতাবাদী হতে দেবেনা এরা, তোমার রক্ষা নাই । তুমি মানুষের না, তুমি সর্বভারতীয়ের না,তুমি ধর্মের; তুমি সাম্যের না, ভ্রাত্ত্বের না, তুমি হিংসার, সাম্প্রদায়িক বিষ-বাস্পের । নজরুল, এই যাপিত জীবন কি তোমার ছিল, এই স্মৃতি? রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তোমরা কি মানুষ ছিলে? বাংগালী ছিলে? নাকি ছিলে হিন্দু আর মুসলিম?
.....হিন্দু না মুসলিম ওরে জিগ্গাসে কোন জন?
কান্ডারী, বল, ডুবিছে তরী
সন্তান মোর মা'র । (কাজী নজরুল ইসলাম)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১:৫০