ওয়ান টু না পড়েই এক্কেবারে ক্লাস থ্রীতে ভর্তি হওয়ায় ক্লাসের অল্প ক'জনকেই চিনতাম বন্ধু হিসেবে। ভাবার কোনো কারণ নেই যে আমি স্কুল পাল্টে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বরং এক স্কুলেই প্রাইমারী শেষ করে বেরিয়ে এসেছি। অর্থাৎ আমার এই দুই ক্লাস পড়াই হয়নি কখনো।
স্কুলে যেতাম মোটামুটি আড়াই-তিন মাস পরপর। মফস্বলের স্কুল। নিয়মকানুন যা ছিল তা আমার জন্য ঠিক কী কারনে একটু শিথিল ছিল বুঝতাম না। মাথাও ঘামাতাম না। পড়াও ধরত না স্যারেরা। তার বদলে কী একটা দরদাপ্লুত স্নেহমাখা মনোভাব ঠিকই লক্ষ্য করতাম ওঁদের মাঝে।
নিজেকে খুব ইমপর্টেন্ট মনে করতাম ছোটবেলা থেকেই কেনো জানি। হয়ত এটার শক্ত বীজ বুনে দিয়েছেন আমার মা'ই। যেদিন(!) স্কুলে যেতাম, আশপাশের সবাই সেদিন অপেক্ষা করে থাকত একসাথে যাওয়ার জন্য। সাড়ে আটটা থেকে শুরু হত স্কুলে যাবার প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতি জটলা পাকিয়ে দেখতো একসাথে যাবার জন্য অপেক্ষমান যারা। এই না হল স্কুল যাওয়া!
অবশ্য স্কুলে যাওয়াটা কোনদিনই উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি আমার কাছে। কারনটা 'আইনুল'। আমার ক্লাসমেট।
বসতে হত একেবারে সামনের বেঞ্চে। ইচ্ছে হল একদিন, পেছনের বেঞ্চে বসলাম। হেডস্যার এনে বসিয়ে দিলেন সামনে আবার। এই ইচ্ছেটা অবশ্য এমনি এমনি চেগে উঠত না। কাহাতক আর সহ্য হয় পেছনের বেঞ্চ থেকে কলমের গুতা খেতে! স্যারকে একই নালিশ আর কত করা যায়!
ক্ষান্তি দিলাম। আইনুল, তুই কত গুতাবি গুতা। এই একদিন'ই ত গুতাবি। এরপর আরো তিনমাস ইসখুস করে থাকতে হবে জেনে রাখিস!
বাবুল ছিল প্রিয় বন্ধু। সবসময় পাশেই বসত।আমাকে এই গুতাগুতি থেকে অনেকটা রেহাই দেয়ায় কীনা ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা ক্রমেই গাঢ় হয়ে উঠল। টিফিনে আমরা স্কুলমাঠের একপাশে ডালপালা মেলে দেয়া সুবিশাল বটগাছের তলায় একসাথে বসে খেলা দেখতাম। হাডুডু। আইনুল হাডুডু খেলায় তুখোঢ়। আমি বরাবর ওর এন্ট্রিতে থাকলেও খেলাটা দারুন উপভোগ করতাম ওর।অসাধারণ সব স্লিপ আর জাম্প করে ও যেভাবে নাস্তানাবুদ করত বিপক্ষের দলকে তা আজও মনে পড়ে পস্ট।
বান্ধবী জরিনা, এখন হয়েছে মামী। আমার ছোট মামার বউ। নাম পালটে হয়ে গেছে জেরিন।চেহারাও পাল্টে গেছে অনেকটা। আমার মামাত বোনের মা কীনা! তবে সম্পর্কটা আগের মতই এখনো। তুমি'তেই আছে(ছোট থেকেই কাউকে 'তুই' বলতাম না)।
ক্লাস ফাইভে ওঠার পর অভাবণীয় কিছু ঘটে গেল বোধ হয়। দুইজন নতুন ম্যাডাম জয়েন করলেন আমাদের এই মফস্বল স্কুলটাতে। হাসনা আপা আর লুনা আপা। হাসনা আপার গায়ের রং কালো। আর সবই ভাল। লুনা আপা সেই তুলনায় অনিন্দ্যসুন্দর। টকটকে ফর্সা চেহারায় ঘাড় হেলিয়ে যখন কথা বলেন, চোখ বেঁধে যায় অনিচ্ছায় অবলীলায়। অসম্ভব লাল রংয়ের ঠোঁটে পানের লালচে পীক যেনো আরো বেশি মোহনীয় করে তোলে তাঁকে। সরাসরি মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে কেমন জানি আড়ষ্ঠের মত হয়ে যাই। লজ্জা লাগে কীসের, বুঝতে পারিনা কোনমতেই।
লুনা আপা প্রথম ক্লাসেই ঘোষনা দিলেন, "স্কুলে আসতে হবে নিয়মিত। হোম ওয়ার্ক মাস্ট বি ডান। বাড়ির কাজ ফেলে রাখা যাবে না। পড়াশোনা করতে হবে প্রচুর।" তারপর একটা বই উঁচু করে ধরে আমাদের বললেন,"আমাদের সময় বইগুলো এরকম ভাল কাগজের ছিল না। নিউজপ্রিন্ট কাগজ দিয়ে ছিল।ক্লাস ফাইভে আমরা পড়তাম কালাম স্যারের কাছে।"
বইটা উচু করে ধরে রাখায় তাঁর ছিপছিপে হাতটার দিকেই আমি তাকিয়ে আছি।অনভ্যস্ত শাড়ী একটু পরপরই তিনি ঠিকঠাক গুছিয়ে নিচ্ছেন। আর এই গুছিয়ে নেয়ার আর্টটাই আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে কেন জানি বারবার।
"কালাম স্যারের কাছে পড়ার সময় আমাদের বইগুলোর কী হাল হয়েছিল জানো?"
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি। কেউ কথা বলছি না।
"প্রত্যেকটা পাতার এমন অবস্থা হয়েছিল যেন একটু টান দিলেই ছিড়ে যেতো।খুব সাবধানে পাতা ওল্টাতে হত যেনো ছিঁড়ে না যায়। বেশ কয়েকবার বই পাল্টাতেও হয়েছে।"
এরপর আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার বইটা হাতে তুলে নিলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? রোল কত? আমি নাম, রোল বললাম।
দেখে শুনে তিনি বললেন, "তোমার বইয়ে তো দেখি একটা দাগও নেই। পড়ার সময় আন্ডারলাইন কর না কেনো?"
আমি বললাম, "আপা, আমি এম্নি পড়ি। বইয়ে দাগাই না। খারাপ লাগে।"
লুনা আপা এবার টেবিলের কাছে ফিরে এলেন। বললেন,"তোমরা আর আপা বলে ডাকবে না, কেমন?এবার থেকে ম্যাডাম বলে ডাকবে।"
সেই থেকে আমাদের 'লুনা(আ)পা' হয়ে গেলেন 'লুনা ম্যাডাম'।
লুনা ম্যাডামের ক্লাসে মার হজম করে না এমন কেউ নেই। দিন সাতেক পরই আমার কেন জানি লুনা ম্যাডামের কথা মনে পড়ল। মা'কে বললাম, স্কুলে যাব।
ক্লাসে লুনা ম্যাডামের জন্য প্রস্তুতি চলছে ব্যাপক। এতদিনের হেডস্যারও যেন পিছিয়ে পড়েছেন ম্যাডামের জনপ্রিয়তার কাছে। একটু বাদেই জানলাম, জনপ্রিয়তা নয় আসলে ভয়। মারের ভয়। পড়া না পারার লজ্জা নয়।
লুনা ম্যাডাম যখন মারেন তখন তা ঠেসে ঠেসে দেন। হাতের তালুতে যে আড়াআড়ি বেতের চিহ্নটা বসে, তার দিকে তাকালেই কেমন যেন কান্না চলে আসে। স্কুল জীবনে কখনই মার খাওয়াটা হয়ে ওঠেনি। লুনা ম্যাডাম কী আমাকেও মারবে?
যাঃ, তাই কি হয়! মার তো খায় পড়া না পারার কারনে। আমার তো মার খাওয়ার কোনো কারন নেই তাহলে।
ম্যাডাম ক্লাসে এলেন যথারীতি। রোল কল করতে গিয়ে "এক" বলেই থেমে গেলেন। ভ্রু কুচকে দেখতে লাগলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কি হয়েছিল তোমার?"
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
"গতকাল আসোনি?"
"জি না ম্যাডাম"
"'জি না' মানে কি?"
"না,মানে আসিনি কাল।"
"জি না একসাথে বলবে না, হয় জি অথবা না।"
"আচ্ছা, বলব।"
"পরশু?"
"না ম্যাডাম"
"তার আগের দিন?"
"না"
"হুম। গত এক সপ্তাহ থেকে অনুপস্থিত। কেন?"
আমি হতভম্ভের মতো চেয় থাকি।যেই আমি তিন ত্রিশং নব্বই দিনের আগে স্কুলে আসিনা সেই আমিকে প্রশ্ন করা হল গত সাত দিন অনুপস্থিত কেন।
"এখন থেকে রেগুলার স্কুল আসতে হবে।"
আমার মুখ থেকে আহাম্মকের মত একটা প্রশ্ন ছুটে বেড়িয়ে গেল,"মানে?"
লুনা ম্যাডাম শান্ত চোখে চেয়ে বললেন, "মানে, আর সবাই যেমন প্রতিদিন ক্লাসে আসে, তোমাকেও আসতে হবে।"
শাড়ীর আঁচলটা টেনে নিয়ে সবার উদ্দেশে বললেন,"গতকাল কারা কারা আসনি উঠে দাঁড়াও।"
আর সকলের মত আমাকেও উঠে দাড়াতে হল(আমি ত দাঁড়ানোই ছিলাম!)। এরপর একপ্রান্ত থেকে তিনি শুরু করলেন। মিষ্টিমুখে আগে শুনে নেন- না আসার কারন। এরপর বেত্রাঘাত। উপযুক্ত কারন দর্শানো হলে বেত্রঘাতের ওজন কমে। কিন্তু মাফ হয়ে যায় না।
আমার সামনে এসে বললেন,"ডান হাত"
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত হাত বাড়িয়ে দিলাম। আর তার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল টুপ করে। স্কুল জীবনে এই প্রথম আমি মার খেলাম।
মার খাওয়ার পরও আমার কাছে ম্যাডামের নান্দনিকতা এতটুকুও কমে যায়নি। বরং একটা ব্যপার আরো বেশি করে লক্ষ্য করলাম। হঠাৎ করেই আমি আবিষ্কার করলাম, কেন জানি ম্যাডামের দিকে তাকাতে পারছিনা আর। ভেতরের লজ্জাবোধটা হুট করেই কয়েক গুন বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে।
এরপর গ্রামের বাড়ি থেকে বাসায় চলে আসাতে দীর্ঘদিন আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। ম্যাডামকে নিয়ে ঘটনার ডালপালাও তেমন ছড়িয়ে পড়েনি।
পরীক্ষাগুলো শেষ হলেই ক্লাস ফাইভ শেষ। স্কুল আর বাসার দুরত্বটা বেড়ে দাঁড়ালো সাড়ে চার মাইলে। লুনা ম্যডামও একই রাস্তা পেরিয়ে স্কুল পড়াতে যান। কী করে যেন নির্ধারিত হল আমাকে লিফট দেবেন লুনা ম্যাডাম। সময়মত ম্যাডামের সাথে বাসা থেকে রওনা হলাম।
রিক্সা এগিয়ে চলছে। লুনা ম্যাডামের গায়ে যেন স্পর্শ না লাগে সেই চিন্তাতেই আমি কীনা ঠিকমত বসতেও পারছি না। ম্যাডামই আমাকে এক প্রকার মৃদু ধমকে সব ঠিক করে দিলেন। আমি আবারও ভাললাগা লজ্জার সন্ধিক্ষনে ম্রিয়মান হয়ে গেলাম। এই প্রথম আমি দুটি জিনিস উপলব্ধি করলাম, আর তা হল খুব সুন্দর কিছু কাছে থেকে দেখতে নেই, আর নিবিড়ভাবে ভালবাসলে মানুষের লজ্জাবোধ প্রবল হয়ে ওঠে,আপসেট হয়ে পড়ে সহজেই।
ব্লগিং এ আমি সাদৃশ্য খুজে পাই আমার স্কুলের 'আইনুল' 'বাবুল' কিংবা লুনা ম্যাডামের।
মিস করি আইনুলকে- যে কীনা কেবল গুতাগুতি করার জন্যই আমার পেছনে বসত। সবসময়ই আমার দিকে তাক করা সেরা অস্ত্র কলম নিয়ে।
মিস করি বাবুলকে- যে কীনা আমাকে এই গুতাগুতি থেকে অনেকটা রেহাই দেয়ার অনন্ত প্রচেষ্টাই করে আসত বারবার(যখন কেউ আমার পক্ষে বিব্রতকর কমেন্টগুলোর সমুচিত জবাব দেয়)।অথবা
লুনা ম্যাডামকে...
--------------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------------
আমার ব্লগে স্বাগত সবাইকে।
এলে কৃতার্থ হব...
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:২১