গতরাতে খুব একটা ভাল ঘুম হয়নি। একটু প্রশান্তির আশায় নিদ্রাদেবীর আরাধনা করেছি একরকম। সারারাত এপাশ-ওপাশ করেছি দু’চোখের পাতা এক করার জন্য। কতশত চিন্তা-ভাবনা মস্তিষ্কের মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছিল। মা’র মুখখানা মনে পড়ছিল খু-উ-ব। বাবার সেই মায়ামাখা কথাগুলোও যেন কানে বাজছিল। গতরাতে আমার একবন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আমার পরিবারে আমার সবচেয়ে প্রিয়মানুষ কে। একটু সময় নিয়েই বলেছিলাম- আমার বাবা। ঠিক সেই মূহূর্তে মনেই হয়েছিল আমার বাবা এখনো আমাদের মাঝেই আছেন। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় পাঁচ বছর আগে বাবা আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। পরক্ষণেই আবার বোল পাল্টিয়ে বললাম-বাবার অবর্তমানে এখন মা-ই আমার প্রিয়। আবার একটু পরেই বললাম দু’জনই আমার প্রিয়। যেহেতু সে একজনের কথা জানতে চেয়েছিল, তাই বুঝতে পারছিলাম না কার কথা বলব। কারণ মা ও বাবা দু’জনকেই যে আমি খুব ভালোবাসি। এখন আমার মা-ই আমার এক সুবিশাল জগৎ। মা’র মাঝেই বাবাকেও খুঁজে পাই। অবশেষে শেষরাতের দিকে নিদ্রাদেবীর মায়া হয়েছিল আমার উপর।
কিন্তু প্রতিদিনের নীরস রুটিনের নির্দয় ধারাবাহিকতা রক্ষায় ভোর ৫.২০ এ ঠিকই আমাকে উঠতে হয়েছিল ঘুম থেকে অ্যালার্ম ঘড়ির কর্কশ ডাকাডাকিতে। ঐ সময় মনে হয়েছিল- পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টে থাকা মানুষ বোধ হয় আমি। মন ও শরীর কোনটাই সাপোর্ট না দিলেও ঢুলুঢুলু ভাব নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম কাজে (!)।এরপর পরপর কতগুলো বিরক্তিকর ও একঘেয়েমিপূর্ণ (অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণও) ধাপের মাধ্যমে কোন রকমে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। সারাদিন একটা গুমোট গুমোট ও বিমর্ষ ভাবের সাথে মনটাও ভীষণ খারাপ ছিল আরো কয়েকটা কারণে। মনে মনে কষ্টও পাচ্ছিলাম। সবার সাথে মনটা একটু ভালো করার চেষ্টা করেছিলাম…..
দুপুরের খাবারের পর বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে বেডে শুয়ে পড়তেই নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়লাম এবং অঘোরে ঘুমাচ্ছিলাম। গভীর ঘুমের এক পর্যায়ে একটা দুঃস্বপ্ন আমাকে ভয়ার্ত করে তুলেছিল। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। একসময় চিৎকার করতে চাইলাম। ঠিক সেসময় একটা ফোনকল…. ভ্রাইব্রেশন থাকায় মোবাইল ফোনটা গুম গুম শব্দ করছিল বালিশের পাশেই। আমার দুঃস্বপ্নে ছেদ পড়ল। হঠাৎ আধঘুম অবস্থায় ফোনটা হাতড়ে নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরলাম। কে কল করল সেটাও ভালোমত খেয়াল করলাম না বা করার চিন্তা করলাম না।ঘুম-বিরক্তি-ভয় এই তিনের সংমিশ্রণে খুব কষ্ট ও অদ্ভুত এক উচ্চারণে –বললাম-
-হ্যা…লো..।
ফোনের ওপাশ থেকে কোমল, মায়া, দরদ আর উদ্বেগ মাখা কণ্ঠ-
-তোর কি অইছেরে বাবা? হুম… তোর কি অইছে?
বুঝতে আর বাকি থাকলো না আমার মায়ের কণ্ঠ। এপাশ থেকে উত্তর দিলাম, আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম…
-কই, কিছু না মা.. কিছু হইনি।
-হুম… কইলে অইবো, তোর কণ্ঠ জানি কেরকম লাইগতেছে। মন মনে অয় খুব খারাপ, না শরীর খারাপ? কি অইছে তোর?
-কই না, কিছুনা তো মা। একটু ঘুমাইছিলাম সেজন্য..
মা’র মধ্যে একটা দুঃশ্চিন্তা লক্ষ্য করলাম। আমার দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে দিয়ে মা যখন আমাকে বললো, “তোর কি অইছেরে বাবা?” তখন কখন যে মনের অজান্তে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। গাল, ফোন বেয়ে সে অশ্রু বালিশ ভিজিয়ে পড়ছিল। এমন করে কেন কাঁদলাম বুঝতে পারলাম না। কোন এক অদৃশ্য মায়াময় শক্তি, ভালোবাসা, দরদ যেন আমার ভয়, কষ্টগুলোকে তরল করে বের করে দিচ্ছিল অশ্রুরুপে। মনটা যেন ভালো হয়ে যাচ্ছিল কোন এক স্বর্গীয় শান্তিময় মন্ত্রতে। একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম। মা’র শরীরের খোঁজখবর নিলাম। আর একটা অপরাধবোধও কাজ করছিল কারণ গত দু’দিন মাকে ফোন দিইনি। অশ্রুবর্ষণ কমে আসলেও পুরোপুরি কমেনি। মা বার বার বলছিল, আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, কবে বাড়ি যাব, কয়দিন ছুটি!! আমারও যে মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কতদিন দেখিনা সে পবিত্র মায়ামাখা মুখখানি! কবে আমার ছুটি হবে??! ফোনটা রেখে উঠে বসলাম। খোলা জানালা দিয়ে দুরের পথের দিকে তাকিয়ে শিশুরমতই কাঁদলাম কিছুক্ষণ। আমারও যে মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কতদিন দেখিনা সে পবিত্র মায়ামাখা মুখখানি! কবে আমার ছুটি হবে??! এখানে আসার পর মাকে এভাবে ফিল করিনি কোনদিন। ব্যাপারটা কাকতালীয় কিনা জানিনা!! কোন এক অদৃশ্য শক্তিশালী যোগাযোগ ঠিকই আছে। প্রাণপ্রিয় সন্তান কষ্টে থাকলে মা ঠিকই বুঝতে পারেন। তোমায় ভালোবাসি মা…. অনেক ভালোবাসি।