সবুজে ঘেরা নিবিড় পরিবেশ। রেস্ট হাউসের সামনে বিশাল লন জুড়ে সাজানো ফুল বাগান। বাগানে কাজ করে এক মালি। মূলতঃ তার পরিচর্যায় এ বাগান টি সবসময় পুস্প-পল্লবে শোভিত থাকতো। কচি কচি সবুজের ফাঁকেফাঁকে ফুটে থাকতো হরেক রকমের, হরেক রং এর আর হরেক সুবাসের ফুল। মাঝে মাঝে এখানে বসে ফুল, পাখি, ভ্রমর, মৌমাছি, প্রজাপতি আর সবুজের মেলা। যেন জীবনের রংধনু রং ছড়ায় চারপাশে। সুবাসে সুবাসে নীরব আত্মশুদ্ধির চেষ্টা..।
১৯ মার্চ, ২০১৪। সকাল বেলায় প্রথম অফিসের জন্য বের হয়ে গাড়িতে উঠতেই পাশ থেকেই একটি লোক দৌড়ে আসল। কালো বর্ণের লোকটার বাঁ হাতে একটি কাস্তে, ডান হাতে একজোড়া বড় তাজা লাল গোলাপ, হাতে ও পায়ের কাপড় অনেক টা গুটানো। মাঝ মার্চের এ গরমে, ঘামে তার শরীর ভেজা। একটা সরল হাসি হেসে আমাকে বললেন-
- স্যার, আপনেরে স্বাগতম। শুনছি, আপনি কাল এসেছেন। থাকবেন অনেকদিন।
কথাগুলো বলতে বলতে লোকটি হাঁপাচ্ছিল আর ঘামছিল। আমি তার আন্তরিকতা দেখে অবাক হই। খুব খুশি হয়ে হাসিমুখে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়িতে উঠি। অফিসে যেতে যেতে ভাবলাম - এক জোড়া তাজা লাল গোলাপ পেয়ে কুমিল্লার প্রথম অফিস, নিশ্চয়ই ভালো কাটবে কুমিল্লার পুরোটা সময়। যে সকালের শুরু এমন, সেদিন ও হয়তো ভালই যাবে। মনের পটে তার ঘর্মাক্ত মুক্তোঝরা আর ভালোবাসা মিশ্রিত হাসিটা বার বার ভেসে উঠছিল।
এরপর থেকেই লোকটি আসতে-যেতে সালাম দিয়ে খোঁজখবর নিত। আমিও হাসিমুখে জবাব দিতাম আর তার ও খোঁজখবর নিতাম। মাঝে মাঝে দেখতাম আমার টেবিলে ফুলদানি তে তাজা ফুল রাখা। প্রায়ই আমাকে জোড়া লাল গোলাপ দিতেন। আমি মাঝে মাঝে ভাবি- বাগানে এত রকমের ফুল থাকতে গোলাপ কেন, আবার সবসময় জোড়ায় জোড়ায় কেন?!!! কিন্তু কোন অর্থ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হই। তাকে জিজ্ঞাসা করব করব বলে আর করা হয়ে উঠেনি। জোড়া গোলাপের রহস্য রহস্যই থেকে গেল।
অন্য একদিন খুব ব্যস্ততার মাঝে ফুলহাতে হাজির সে । ফুলগুলো রেখেই সে একটু ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল-
- স্যার, কি ব্যস্ত আছেন? একডা কথা কইতাম।
- একটু ব্যস্ত। আপনি পরে আসেন। সব শুনব।
দেরি না করে সে দ্রুত হাসিমুখে চলে গেল। আরেকদিন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি-
- সেদিন আপনি কি বলতে চাইলেন?
- আমার জমি নিয়ে সমস্যা। যদি একটু হেল্প করতেন।
- আচ্ছা বলেন।
- স্যার, বিকালে কথা কমু আপনার লগে।
- আচ্ছা, ঠিক আছে।
বিকালে সে তার সমস্যার সপক্ষে কিছু দালিলিক প্রমাণ দেখায়। আমি খুব ভালো না বুঝলেও তার কথামত দুটো ফোন করলাম- একটা সমাজপতি কে আর একটা বাখরাবাদ গ্যাস এর জি এম কে। শুধু এই টুকুই বললাম- সে যেন ন্যায় বিচার পায়।
আবার আগেরমতই সব চলতে থাকে। দেখলাম তার আন্তরিকতা আরো যেন বেড়ে গেল। মাঝে মাঝে বলতেন- আপনে আমার অনেক উপকার করছেন। আমি কখনো অবশ্য জিজ্ঞাসা করিনি, কি উপকার।
১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪। আমি কুমিল্লা ছেড়ে চলে আসছিলাম তখন বিকাল ৪ টার উপর। একে একে সবার সাথেই দেখা করলাম। মনটাও কিছুটা খারাপ। সবাই আমার জিনিসগুলো গাড়িতে উঠাচ্ছিল। আমিও গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল।
হঠাৎ, পেছন দিক থেকে একজন ডাকছিল-
- স্যার, স্যার.....
অবাক হয়ে পেছন তাকিয়ে দেখি বাগানের মালি যার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই প্রথম দিনের বেশ, প্রথম দিনের পোশাকেই। হাতে সেই রকমই তাজা জোড়া লাল গোলাপ। সেই ঘর্মাক্ত মুক্তোঝরা ভালোবাসা মিশ্রিত সরল হাসিমুখ। তার কথা আমার মনেই ছিলনা। তবে চোখ জোড়া যেন ভেজা ভেজা। হাসি অথচ ধরে আসা গলায় বলল-
- স্যার, যাওনের বেলায় আর কি দিমু। এডাই আপনের জইন্য আমার উপহার। আপনে আমার অনেক উপকার করছেন। ওরা এখন আর আমারে ডিসটাব করেনা। আপনের কথা খুব মনে থাইকবো। ভালা থাইকেন স্যার। দোয়া কইরেন।
- আপনিও দোয়া কইরেন আমার জন্য। ভালো থাইকেন। কোন সমস্যা হলে বলবেন।
কথাগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে বলতে বলতে গাড়ি চলতে শুরু করল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি লোকটা তখনো হাত উঠিয়ে আছে। গাড়ি মোড় ঘোরা পর্যন্ত তার হাসিমাখা সজলচোখ দেখছিলাম। আমার চোখের সামনে যেন বাবার মুখটা ভেসে উঠেছে।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, প্রতিবার বাড়ি থেকে আসতেই চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত বাবা এভাবেই সজল নয়নে বিদায় জানাতেন আর বলতেন- ঠিকমতন খাওয়া-দাওয়া করিছ, শরীরেল দিকে লক্ষ্য রাকিচ।
গাড়ি মোড় ঘুরতেই আমার দু চোখে প্রবাহ নামল। বাবা যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসল তার অতি আদরের ধনের কাছে। আজ প্রায় ছয় বছর বাবা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
এভাবেই বাবা মাঝে মাঝে আমার আশেপাশে থাকেন অন্যকোন বেশে। হয়তো আমি তা বুঝতে পারিনা। হাতের জোড়া লাল গোলাপের দিকে তাকিয়ে মনটা আরও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। গোলাপগুলো বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসি। এই জোড়া লাল গোলাপের অর্থটাও আধরাই থাকল।
গোলাপগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে প্রায়। আজ কয়েকদিন হয়ে গেল। এখন আর কেউ আমায় জোড়া লাল গোলাপ দেয়না, হয়তো এইভাবে দেবেও না কোনদিন। আমি এতটাই স্বার্থপর যে আমায় ফুলেল মায়ায় জড়িয়ে রাখত, আমি তার নামটাও মনে রাখিনি। তাই বারবার লোকটা লোকটা বলছি।
কেন যেন তোমায় খুব মনে পড়ে বাবা। তোমায় সত্যি অনেক ভালোবাসি!! তা কাকে, কিভাবে বোঝাই বল?!!! এত কাছে আসো, কত রূপে তবু তোমায় ছুঁয়ে দেখতে পারিনা। তোমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। কতদিন তোমায় জড়িয়ে ধরিনা!!!