রেমাক্রিখুমে ছোট একটা টিলার উপর, চেয়ারম্যানের বাংলোর বারান্দায় বসে আছি।নীচ থেকে ভেসে আসছে ঝর্ণার শো শো আওয়াজ। সারাদিন সারারাত ধরে এই আওয়াজ চলতেই থাকে।
সামনে, নীচে সাঙ্গু নদী শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে আছে। এত উপর থেকেও নদীর তলের পাথর দেখা যায়। নদীটি সেই আরাকান পবর্ত থেকে শুরু হয়েছে। থানচি থেকে এটার বুকে ভেসেই আমরা রেমাক্রি এসেছি। আরো উপরের দিকে এই নদী বড় মাদক, ছোট মাদক হয়ে, রিজার্ভ ফরেস্ট হয়ে গভীর জঙ্গলে হারিয়ে গেছে।
আমাদের মাঝি বলল, একসময় নদীটা যেতে যেতে এমন ছোট হয়ে গেছে, যেখানে নৌকা ঘোরানো যায়না। ট্রেনের মতো গিয়ে, আবার সেভাবে পেছন ফিরে আসতে হবে।
নদীর দুইপাশে সমুদ্র সৈকতের মতো বালুর সৈকত তৈরি হয়েছে। নাফাখুমের পানি বয়ে নিয়ে এসে আরেকটি নদী রেমাক্রিখুম দিয়ে সাঙ্গু নদীর উপর পড়ছে। এটার কোন নাম আছে কিনা জানি না। সেখানে একটা ধাপে ধাপে ঝর্ণা তৈরি হয়েছে, আর তার শো শো আওয়াজ এখানে বসেও পাওয়া যাচ্ছে।
পাহাড়ে বিকেল বেশ তাড়াতাড়ি নেমে আসে। সূর্যটা পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলেও তার আলো এখনো বেশ রয়েছে।
আমাদের বাংলোটা একটা ছোটখাট টিলার উপর। টিনের চালা, আর কাঠের ছোট বাংলো। দুইটা রুম। কোন খাট নাই। কাঠের মেঝেতে তোষক বিছানো আছে। তার উপর কম্বল আর কাথা। আরেকটি রুমে একটি ছোট তাবু।
টিলাটার নীচে মারমাদের শীতকালীন একটি বসতি। পর্যটকদের উদ্দেশ্য করেই বলা চলে এই বাজারটা গড়ে উঠেছে। মৌসুমে, অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত, এখানে অনেক পর্যটক আসে। তাদের খাবার, থাকার কথা চিন্তা করেই এই বাজারটি গড়ে উঠেছে। কেউ যদি এখানে তিনবেলা খায়, তাহলে মারমা বাড়িতে বিনা পয়সায় থাকা যাবে। তিনবেলা খেতে দুইশ করে টাকা লাগবে।
টিলার উপরে, বাংলোর বারান্দায় বসে দেখছি, নীচে মারমা মেয়েরা থালাবাসন ধুচ্ছে, কেউ কেউ এই বিকেলে গোছল করছে। পাহাড় আর প্রকৃতির সাথে এই মেয়েরা, নীচের বাড়িঘর, দুরের আকাশ সব মিলে মিশে গেছে।
বহুদিন এমন নির্জনতায় থাকিনি। এখানে টেলিভিশন নেই, মোবাইল নেই, ল্যাপটপ, ফেসবুক নেই। মানুষের মধ্যে তাড়াহুড়ো নেই। তবে এর আগে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে যতটা সরলতা দেখেছি, তার বেশ পরিবর্তন এসেছে। সমতলের মানুষের সাথে মিশে মিশে ওরাও এখন পাল্টে যেতে শুরু করেছে।
নীচের এই বাড়িঘরগুলোর একটিতেই দুপুরে আমরা খেয়েছি। মেন্যু ছিল জঙ্ঘল থেকে মেরে আনা হরিনের মাংস, সাঙ্গু নদীর বেশ বড় আকারের রুই মাছ, ডাল আর ভাত। মাংস দিয়ে ভাত নব্বুই টাকা করে নিল, মাছ দিয়ে সত্তুর টাকা।
রান্না যে খুব ভালো তা বলা যাবে না। আমরা যতটা মসলা খাই, তার তিনভাগের একভাগ মসলাও নেই। তবে ডালটা সত্যিই চমৎকার। জুমের চালগুলো ছোট ছোট, বেশ ভালো লাগে।
আজ দুপুরেই আমরা থানচি থেকে এখানে এসে পৌছলাম। নৌকার পেছনে শ্যালো ইঞ্জিন বসানো, তার শক্তিতে প্রায় নদীর তল ছুয়ে ছুয়ে দেড়টার দিকে রেমাক্রিমুখ এসে নামলাম। আর দুইশ গজ গেলেই রেমাক্রি বাজার। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম্ এখানেই থাকব।
থানচি থেকে আমাদের একজন গাইড ভাড়া করতে হয়েছে। প্রতিদিন পাঁচশ টাকা। যদিও আগেই চেয়ারম্যানের বাংলোর ব্যাপারে আমরা ফোনে কথা বলেছিলাম, গাইড আবার এখানে কথা বলে বাংলো ঠিক করে নিল। তবে সেখানে যেতে একটু সময় লাগবে। কারণ আগে যারা ছিল, তাদের চলে যেতে আরো একঘন্টা লাগবে।
সবাই বেশ ক্ষুধার্ত। সবাই বলল, বাংলোয় যাবার আগে খেয়ে নিতে চায়।
সেখানকারই একটা দোকানে ব্যাগ রেখে সাঙ্গুর পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। আমার যে দোকানে খাব, তার আইটেম ভাত আর হরিণের মাংস। জঙ্গল থেকে আজই নাকি মেরে আনা হয়েছে। তবে পাশের একটি দোকানে খোজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে নাকি সাঙ্গুর বড় রুই মাছ আছে। সেই দোকান থেকে কয়েকপিস মাছ আনা হলো।
আমরা যখন খাচ্ছি, তখনি দেখতে পেলাম, আগের দলটি ব্যাগ বোচকা নিয়ে নৌকায় উঠছে।
তাই আমরা খেয়ে দেয়ে বাংলোর দিকে উঠতে শুরু করলাম। টিলাটার এক কোনে বাংলোটা। তিনদিকে খাদ। অর্থাৎ পাশে আর কোন বাড়িটাড়ি নাই। একটু দুরেই আধাপাকা টয়লেট। পাশেই আরেকটি টিলা, সেটার উপর একটি বৌদ্ধ মন্দির, সেখানে বুদ্ধ আসন গেড়ে বসে আছেন, সেটা এখান থেকেও দেখা যায়।
ব্যাগ ট্যাগ রেখেই আমরা জামাকাপড় নিয়ে আবার নিচের দিকে রওনা হলাম। সামনেই নাফাখুম থেকে পানি এসে একটা খাল ধরে সাঙ্গুর সাথে মিশেছে। সেখানে বেশ ধাপে ধাপে একটা ঝর্ণার মতো হয়েছে। আজ সেখানেই গোছল করা হবে।
ঝর্ণায় দেখলাম স্রোত অনেক। সেই স্রোতের মধ্যে গা ভাসিয়ে বেশ হইচই করে গোছল করা হলো। মাথায় শ্যাম্পু মেখে ঝর্ণার নিচে বসলে এমনিতেই ধুয়ে যায়, এই রকম অবস্থা।
নদীতে নামার সময় মিরাজ দেখলো, একজন মহিলা বোচকা বুচকি নিয়ে যাচ্ছে। মিরাজের সাথে কিভাবে ভাব হলো কে জানে, উনি আমাদের তার বোচকা খুলে ঘরে বানানো চাল দিয়ে তৈরী মদ খেতে দিলেন। আমিও গিয়ে একটু ভাগ বসালাম। হেভি কড়া। এক ঢোক খেয়েই মাথা ঝিম ঝিম।
উনি আমার বাংলা বলতে পারেন না। সেখানেই আমাদের সাথে গোছল করছিল একটি মারমা ছেলে, রেমাক্রিতে স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। সে আমাদের অনুবাদক হিসাবে কাজ করল।
নানী পুরো মদটাই আমাদের বিক্রির প্রস্তাব দিলেন। একশ বিশ টাকা। কিন্তু এই হেভি ডোজের জিনিস আমাদের ক্ষমতার বাইরে বুঝতে পেরে আমাদের তাকে ফিরিয়ে দিতে হলো।
গোছল শেষ করে আমরা যে দোকানে দুপুরে খেয়েছিলাম, সেখানেই রাতের খাবারের অর্ডার দিতে এলাম। বিশাল দেখে একটা মুরগি পছন্দ হলো। এটাই রাতে রান্না করতে বললাম। কিন্তু মিরাজ একটা শর্ত দিল যে, মুরগিটা সে নিজে জবাই করে দেবে। রান্নার সময়েও আমরা থাকব।
দোকানদার দাদা হাসিমুখে মাথা ঝাকালেন।
বাংলোয় ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে আবার বের হলাম। এবার রেমাক্রি বাজারে যাবো। এখানে এসে বাজারটা না দেখার কোন মানে হয়না।
নীচে তাকিয়ে দেখি, আমাদের দেখানো মুরগিটা জবাই শেষে কাটাকুটি চলছে। দোকানদার আসলে আমাদের কথাই বুঝতে পারেনি। খামোখাই হ্যা হ্যা করেছে।
কিন্তু হালালভাবে জবাই না হওয়ায় মিরাজ আর খাবে না বলে জানালো।
একটু পরে রেমাক্রি বাজারের দিকে রওনা হলাম। টিলাটার অন্য পাশ দিয়ে আরেকটা পথ ধাপে ধাপে নীচে নেমে গেছে। সেখান দিয়ে নদী পাড় হয়েই ওপারে রেমাক্রি। সেটাও আবার একটা টিলার উপর। ছোট খাট পাহাড়ও বলা যেতে পারে।
একটা বড় উঠোনমত জায়গা, তার চারদিকে দোকান ঘর কাম বাড়ি। এটা একটা মারমা বসতি। মারমারা ব্যবসাপ্রবণ সম্প্রদায়। সব বাড়ির সাথেই দোকান আছে।
বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে গেলাম। বাজারটির বাইরের দিকে, নদীর কাছেই বিজিবি ক্যাম্প। সেটার আগেই আবার একটি সরকারি বাংলো আছে। সেখানেও থাকা যেত। (পরদিন এই বাংলোতে অনেক টুরিস্ট এসে থেকেছেন)। দুটি ঘর আছে। এটা বেশি নিরাপদ হলেও আমাদের বাংলোটা অনেক শান্ত আর নিরব। দৃশ্যও চমৎকার বেশী।
ক্যাম্পের লোকজন আমাদের অনেক খাতির করলেন। একজন হাবিলদার বললেন, এই দুরের পাহাড়িদের মধ্যে সারাবছর তাদের বলতে গেলে একাই থাকতে হয়। দুইএকজন টুরিস্ট এলেই তারা বাঙালীর দেখা পান। এখানে পত্রিকা বা টেলিভিশন নাই। এন্টেনা লাগিয়ে রেডিও যা একটু শোনা যায়।
বাড়ির সাথে কথা বলতে হলে, দুরের একটা পাহাড়ের চুড়ায় উঠতে হয়। সেখান থেকে মোবাইলের যা একটু নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
বাজারের একটি দোকানে চা খেলাম। কয়েক বোতল পানি কিনলাম। ত্রিশ টাকার পানির বোতল এখানে পঞ্চাশ টাকা।
সন্ধ্যার পরে নদীর পাড় ধরে হেটে হেটে আমাদের বাংলোর নীচের মারমা বসতিতে এলাম। দেখি মুরগি রান্না হয়ে গেছে। এবার তারা রাধুনি মসলা দিয়েছে নাকি।
মিরাজ মুরগি খেল না। ওর জন্যে ডিমভাজি করা হলো। মুরগিটা অনেকটা খাসির মতো। কিন্তু আমার কাছে মজাই লাগলো।
খেয়ে দেয়ে চা খেলাম। পাশের দোকানটা দেখি বার হয়ে গেছে। সেখানে বসে লোকজন গ্লাসে ঢেলে ঢেলে মদ খাচ্ছে। আমরা যে দোকালে খেলাম, সেখানেও মদ বিক্রি হয়। বোতল ষাট টাকা।
একটু পরে বাংলোয় ফিরে গিয়ে দুটি তোষক বের করে বারান্দায় বসলাম। ফেব্রুয়ারীর শেষ দিক। ঢাকায় গরম পড়ে গেছে। কিন্তু এখানে অনেক ঠান্ডা। সোয়েটার পরার পরেও কম্বল গায়ে দিতে হলো।
মেয়েরা খানিকক্ষণ বারান্দায় বসে ঘুমাতে চলে গেল।
বারান্দায় বসে আমি আর মিরাজ কর্ক মেপে মেপে একটু মদ খেলাম। কারণ গ্লাস নেই, আর জিনিসও কম আছে।
কাল সকালে নাফাখুম যেতে হবে। সকাল আটটায় বের হতে হবে। তাই একটু পরেই শুতে চলে গেলাম।
(পরের পর্বে ঢাকা থেকে নাফাখুম যাবার বর্ণনা লিখবো)
(ঢাকা থেকে নাফাখুম যেতে হলে প্রথমে বান্দরবান যেতে হবে। সেখান থেকে বাসে, চান্দেরগাড়ি বা জিপে করে থানচি যেতে হবে। বাস ভাড়া ১৮০ টাকা, জিপ ভাড়া রিজার্ভ ৫০০০ টাকা। থানচিতে থাকার জন্য উপজেলা পরিষদের বাংলো আছে। ভাড়া প্রতিরুম পাচশ টাকা্। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে রেমাক্রি যেতে হবে। আসা যাওয়া রিজার্ভ সাড়ে চার হাজার টাকা। একটি নৌকায় আটজন বসা যেতে পারে। রেমাক্রিতে থাকা জনপ্রতি দেড়শ টাকা)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৩ বিকাল ৪:৪০