somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দশ টাকায় ছ’টা

১০ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম যেদিন ওরা এসেছিল, সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি পড়ছিল। সময়টা ছিল বর্ষাকালের মাঝামাঝি। তখন প্রায় প্রত্যেকদিনই বৃষ্টি পড়ত। এর আগে সতেরোবার কলকাতার বর্ষাকাল দেখেছে ন্যাপা। তার মধ্যে শেষ দশ-বারো বারের কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। বৃষ্টি দেখতে ন্যাপা খুব ভালবাসে। কী সুন্দর অনেকগুলো জলের ফোঁটা একসঙ্গে মাটিতে এসে পড়ে! গায়ে পড়লে কী ভাল লাগে! বৃষ্টিতে ভিজতেও খুব ভালবাসে ন্যাপা। ন্যাপার জ্বর হয় না। আজ ন্যাপার খুব মনে পড়ছে সেদিনের কথা। গত বেশ কিছুদিন ধরেই তার মনে পড়ছে ওদের কথা। গত বেশ কিছুদিন ধরেই ওরা আর আসছে না। সেদিন সারাদিন ধরেই তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। সিটি সেন্টারের পিছন দিকে রাস্তার একপাশে প্লাস্টিকের টুলে চুপ করে বসেছিল ন্যাপা। কত রকম রংচঙে মানুষ! কতরকম তাদের পোশাক! কতরকম তাদের ভাষা! কিছু ন্যাপা বোঝে। কিছু বুঝতেই পারে না। ন্যাপা শুধু বোঝে ওরা ইংরেজি বা অন্য কোনও ভাষা বলে। ন্যাপা ইংরেজি জানে না। শেখার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শেখা আর হল কই? বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গোধূলির আবছায়ায় ওরা এসে আশ্রয় নিয়েছিল ন্যাপার দোকানের বড় ছাতার নীচে। একজন আর-একজনের হাত ধরে ছিল ওরা।
“কত করে ভাই?” প্রশ্ন করেছিল ছেলেটা।
“দশ টাকায় ছ’টা স্যার…” ন্যাপা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিল।
“আমি বারোটা খাব কম করে…” মেয়েটা উত্তেজিতভাবে বলেছিল। ন্যাপা মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিল। ঠিক যেন পুতুল। কী ফরসা গায়ের রং! কী সুন্দর দেখতে! নিশ্চয়ই খুব ভাল মানুষ। নিশ্চয়ই ইংরেজি জানে।
“ছ’টার বেশি খেয়ো না…পেট ছুটবে…” ছেলেটা বলেছিল।
“আমি খাবই…”
“না, খাবে না…”
“আলবাত খাব…”
“বলছি খাবে না…”
“আমার পেট… আমি বুঝব…
আমি খাবই…”
“ও আচ্ছা! আমি যে বারণ করছি তার কোনও ভ্যালুই নেই?”
“না নেই, যাও… প্রতি পদে ওঁর কথা শুনে চলতে হবে…”
“অ্যাই শোনো… তুমি ওকে ছ’টার বেশি একটাও দেবে না এই বলে দিলাম…” ন্যাপাকে আদেশ করেছিল ছেলেটা।
“স্যার, আগে খেতে তো শুরু করুন…” ন্যাপা হেসে ফেলেছিল।
“এই তো! এ ছেলেটার সেন্স আছে…নাও, শুরু করো তো…” মেয়েটা তাকিয়েছিল ন্যাপার দিকে। ন্যাপার শরীর শিরশির করে উঠেছিল। একটু লজ্জাও পেয়েছিল সে। লজ্জা পেয়েছিল তার নিজের পোশাকের জন্য। তার পোশাক বলতে একটা কমলা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি, যার বুকে একটা বেশ বড় ফুটো আর একটা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ধূসর হাফপ্যান্ট। আরও কত মেয়ে তো এখানে এসে দাঁড়ায়, এরকম করে কেউ কখনও ন্যাপার দিকে তাকিয়েছে কি?
“ঝাল হবে?” জিজ্ঞেস করেছিল ন্যাপা।
“না না… একদম না…” ছেলেটা তত্‌ক্ষণাত্ জবাব দিয়েছিল।
“একদম…সুপার-ডুপার ঝাল হবে…” ছেলেটার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলেছিল মেয়েটা।
“তুমি ঝাল খাবে? জানো এগুলো কী হার্মফুল?” ছেলেটা বলেছিল।
“তুমি আলাদা করে মাখো তো… ওকে ঝাল ছাড়া দাও, আমাকে ঝাল দিয়ে দাও…” মেয়েটা আবার তাকিয়েছিল ন্যাপার দিকে। ছেলেটা মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিল করুণভাবে। কিন্তু কিছু বলতে পারেনি। খাওয়ায় মন দিয়েছিল দু’জনেই।
“ম্যাডাম, ছ’টা করে হয়ে গিয়েছে…” কিছুক্ষণ পর বলেছিল ন্যাপা।
“ব্যাস, আর না…থামাও…” ছেলেটা সঙ্গে-সঙ্গে বলেছিল।
“আঃ! বলেছি না কম করে বারোটা খাব? দাও তো, আমাকে দাও, ওকে দিতে হবে না…” মেয়েটা আবার আদেশ করল।
“না…আর দেবে না ওকে…আমি বলছি…” আদেশ এসেছিল ছেলেটার কাছ থেকে।
“তুমি দেবে কি না? না দিলে আমি অন্য দোকানে যাব…”
“আর খাবেন? না থামাব?” ন্যাপা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটাকে।
“আলবাত খাব… তুমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে
দেখছ কী? দাও বলছি…”
“জানি না আমি, যা প্রাণ চায় তাই করো…” ছেলেটা বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
“তোমার মা জিজ্ঞেস করবে না, তুমি
ভিজলে কী করে?” ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটা।
“করবে তো…” ছেলেটা উত্তর দিয়েছিল।
“কী বলবে তুমি?”
“কী আর বলব? বলব তুমি ছাতা খুলতে দাওনি।”
“আমার কথা তো তোমার মা জানেই না!!”
“জানিয়ে দেব… আজই!”
“খুব সাহস?”
“তুমি সঙ্গে থাকলে আমি সাহস পাই…”
“তার মানে সেটা তোমার নিজস্ব সাহস নয়! আমার থেকে ধার নেওয়া…এ রামোঃ…”
“দুর ভাল্লাগে না… ইয়ার্কি মেরো না…”
“তুমি মাকে কবে বলবে আমার কথা?”
“বলে দেব… আর ক’টা দিন যাক… মা-র শরীরটা একটু ঠিক হোক…”
“তুমি আগে বলবে… তারপর আমিও বলে দেব আমার বাড়িতে…”
“সে তো বলবেই… না হলে বিয়ে হবে কী করে! আর বিয়ে না হলে সেটা হবে কী করে, আর সেটা না হলে মা নাতি-নাতনির মুখ দেখবে কী করে?”
“অসভ্য ছেলে একটা…”
“আমি ভুল বলেছি?”
“থাক… আর দয়া করে বেশি ঠিক বলতে হবে না তোমাকে…”
“রাগ করলে?”
“না।”
“ঠিক আছে। আর বলব না। আর কিছু বলব না, আসল সময় যা করার করব একদম…”
মেয়েটা ছেলেটার কাঁধে ঠাস করে চড় মেরেছিল। ছেলেটা ‘উঃ’ বলে আরও কাছে টেনে নিয়েছিল মেয়েটাকে। বৃষ্টি হালকা হওয়ার পর ন্যাপার দোকানের ছাতার নীচ থেকে বেরিয়ে ওরা মিশে গিয়েছিল মানুষের ভিড়ে। তাকিয়ে দেখেছিল ন্যাপা। মেয়েটার সুন্দর আঙুলগুলো ছেলেটার হাতটাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিল যেন ঝড়ের মধ্যে কোনও আশ্রয় খঁুজে পেয়েছে। ততক্ষণে সন্ধে নেমে এসেছিল কলকাতার বুকে। জ্বলে উঠেছিল চারদিকের রাস্তার, দোকানের আলো।

প্রত্যেক সোম, বুধ আর শুক্রবার ওরা আসত নিয়ম করে। অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল ন্যাপার। নিয়ম করে অপেক্ষা করত ন্যাপা, কখন ওরা আসবে তার জন্য। কখন মেয়েটা ছেলেটার সঙ্গে আসবে তার জন্য। মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত ন্যাপা। বিভোর হয়ে ওদের কথা শুনত সে। গোটা ব্যাপারটা খুব ভাল লাগত ন্যাপার। কী সুন্দর ওরা দু’জন নিজেদের জীবনদুটো গুছিয়ে নিতে চাইছে! ন্যাপার কোনদিন এরকম গুছিয়ে নেওয়ার কিছু ছিল না, এখনও নেই। ওদের দেখতে-দেখতে, ওদের কথা শুনতে-শুনতে ন্যাপা কোনও এক অজানা স্বপ্নের দেশে হারিয়ে যেত, যেখানে সবকিছু সুন্দর, যেখানে কোনও অভাব নেই, কোনও দুঃখ নেই।
অনেকগুলো সোম-বুধ-শুক্র এইভাবে কেটে গিয়েছিল। বর্ষাকাল ক্রমশ সরে গিয়েছিল দূরে। ধূসর আকাশে লেগেছিল উজ্জ্বল নীলের ছোঁয়া। পুজোর সাজে সেজে উঠতে শুরু করেছিল কলকাতা। ওদের সোম-বুধ-শুক্রর কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। সপ্তমীর দিন ছিল শুক্রবার। সেদিনও ওরা এসেছিল। দুজনেই খুব সুন্দর সেজেছিল, নতুন জামা পরে। ন্যাপাও পুজোয় নতুন জামা পরেছিল। সেদিন ওরা এসেছিল রাতে, আটটা নাগাদ। সিটি সেন্টার তখন জমজমাট।
“দাও… ঝাল কিন্তু…” মেয়েটা ন্যাপার দিকে তাকিয়ে বলেছিল।
“জানি ম্যাডাম, আপনারা তো রেগুলার আসেন…” ন্যাপা হেসে কথা বলেছিল। সেদিন সে ভাল জামা পরেছিল, তাই কোনও লজ্জা ছিল না। মেয়েটা হেসেছিল ওর দিকে তাকিয়ে। কী সুন্দর হাসি!
“চলো আজ কম্পিটিশন করে খাই! মজা হবে…” মেয়েটা উত্তেজিতভাবে ছেলেটাকে বলেছিল।
“ওরে বাবা! আমি কি এত খেতে পারি? তার চেয়ে তুমি খাও, আমি দেখি…” ছেলেটা দুষ্টুমির দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিল।
“ভিতু কোথাকার!”
“কী আর বলি! তা একটু তো বটেই।”
“বুঝেছি, আমার কপালে কিছুই নেই! তুমি মাকে সাহস করে কিছু বলতেও পারবে না, আর আমাদের বিয়েও হবে না।”
“এরকম করে বোলো না প্লিজ়… তুমি তো জান সবই…”
“জানি, তাও ভয় করে আমার। একবার ধাক্কা খেয়ে সামলে নিয়েছি। আর-একবার আর সামলাতে পারব না…”
“পাগলি একটা…” ছেলেটা হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিয়েছিল মেয়েটার মাথার চুল।
“ম্যাডাম, ছ’টা হয়ে গিয়েছে, আর খাবেন?” ন্যাপা জিজ্ঞেস করেছিল।
“ও খাবে না, আমি খাব!” মেয়েটা বলেছিল।
পুরো আঠেরোটা খেয়ে থেমেছিল মেয়েটা। তারপর রোজকার মতো ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়েছিল ওরা। রাতে দোকান বন্ধ করতে গিয়ে ন্যাপা আবিষ্কার করেছিল জিনিসটা। একটা মানিব্যাগ, খোলা বইয়ের মতো পড়ে ছিল ন্যাপার পায়ের কাছে। সে সেটা কুড়িয়ে নিয়েছিল। ব্যাগের ভিতর অনেক টাকা। ন্যাপার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। এত টাকা সে কোনদিনও দেখেনি। বাবার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল ন্যাপার। ন্যাপার যখন সাত বছর বয়স, তখন তার বাবা তাকে বলেছিল, “কখনও অন্যের জিনিস না বলে নিবি না, কুড়িয়ে পেলে ফেরত দিয়ে দিবি, নয়তো থানায় জমা দিয়ে আসবি…অন্যের জিনিস তাকে না বলে নিলে পাপ লাগে…” নরম মাটিতে এঁকে দেওয়া নকশার মতো ন্যাপার মনে গেঁথে গিয়েছিল কথাগুলো। সে কোনদিন অন্যের জিনিস তাকে না বলে নেয়নি, আর কুড়িয়েও পায়নি। সেদিনই প্রথম তার জীবনে এই ঘটনা ঘটেছিল। ব্যাগটা কী করে সে ফেরত দেবে? বুঝবে কী করে এটা কার ব্যাগ? এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে বইয়ের মতো খুলে ফেলেছিল ব্যাগটা। চোখ চলে গিয়েছিল বাঁদিকে। আরে! এটা তো সেই ম্যাডামের ফোটো! ন্যাপা বুঝেছিল এটা ফেরত দেওয়া তার কাছে খুবই সহজ একটা কাজ।
সোমবার ছিল দশমী। ওরা সেদিন আসেনি। বুধবার এসেছিল ওরা।
“বানাও, আজ আর ঝাল দিয়ো না,”
মেয়েটা বলেছিল।
“ম্যাডাম…” ন্যাপা আবার পুরনো ছেঁড়া পোশাকে ফিরে গিয়েছিল। কথায় অস্বস্তির ছোঁয়া।
“কী হয়েছে?”
“আমি একটা ব্যাগ পেয়েছি। এটা আপনাদের না?” ন্যাপা বের করেছিল ব্যাগটা।
“আরে! এটা তোমার কাছে!!” ওরা দু’জনই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একসঙ্গে।
“আপনারা আগের দিন ফেলে গেসিলেন।”
ছেলেটা ব্যাগটা নিয়ে টাকা আর অন্যান্য জিনিসপত্র মিলিয়ে দেখতে শুরু করেছিল। মেয়েটা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর তাকিয়েছিল ন্যাপার দিকে। ন্যাপা আবার গুটিয়ে গিয়েছিল লজ্জায়।
“কী নাম তোমার?” জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটা।
“ন্যা…ন্যাপা।”
“তুমি এত ভাল ছেলে? অন্য কেউ হলে তো ফেরত দিত না, এতগুলো টাকা!”
“আমি না বলে অন্যের জিনিস নিই না ম্যাডাম। বাবা মানা করেসিল!”
“করেছিল? বাবা এখন নেই?”
“না, মরে গেসে।”
“ও! তুমি পড়াশোনা জান?”
“না…”
“সব ঠিক আছে, ” ছেলেটা বলে উঠেছিল হঠাত্।
“ঠিক না থাকলে তুমি ব্যাগটাই পেতে না…”
“নাহ্, ছেলেটা ভাল। ওকে কিছু দিই?”
“কী দেবে?”
“মানে কিছু টাকা…”
“কেন?”
“এতগুলো টাকা! ও তো ঝেড়েও দিতে পারত।”
“কিন্তু ও তো ঝাড়েনি…”
“সেইজন্যই তো বলছি কিছু দেওয়া উচিত…”
“আচ্ছা, তুমি যদি রাস্তায় একটা ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়ে সেটা তার মালিকের কাছে ফেরত দিতে, আর তখন সেই ব্যাগের মালিক যদি তোমাকে কিছু টাকা দিতে চাইত… ফর দ্য সেম রিজ়ন… তোমার কেমন লাগত?”
“মানে?”
“থিঙ্ক অ্যাবাউট ইট… তারপরেও যদি ঠিক মনে হয়…দেন ডু অ্যাজ় ইউ উইশ…”
“আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না…”
“আমি বলতে চাইছি, ও এটা করেছে একটা শিক্ষার থেকে। সেই শিক্ষাটা ও বাড়িতে পেয়েছে। ঠিক আমি-তুমি যেমন পেয়েছি, তেমনই। তুমি এভাবে ওকে টাকা দিলে, ওকে, ওর এই শিক্ষাটাকে অপমান করা হবে… বোঝাতে পারলাম?”
“নো ম্যাডাম, বুঝিনি। যাক্গে ছাড়ো, তুমি বারণ করছ, সো… আমি টাকা দেব না, খুশি?”
“তাও ভাল… কী আর বলব…”
“নাও ন্যাপা, শুরু করো… তুমি বরং বেশ ঝাল দিয়েই বানাও…” মেয়েটা ন্যাপার দিকে ফিরে বলেছিল।
“আচ্ছা ম্যাডাম…” ন্যাপা হাসিমুখে কাজ শুরু করেছিল।
খাওয়া শেষ করে রোজকার মতো পরস্পরের হাত ধরে রংচঙে ভিড়ে মিশে গিয়েছিল ওরা।

প্রকৃতির নিয়মে বিদায় নিয়েছিল উত্‌সবের শরত্। এসেছিল শীতের আমেজ। ন্যাপার মাথার ঠিক উপরে যে গাছটা বছরের বাকি সময়টা সিটি সেন্টারের কংক্রিটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত, সেও তার সমস্ত সবুজ হারিয়ে শুধু একটা প্রকাণ্ড কাঠের নকশায় পরিণত হয়েছিল। এই দৃশ্য ন্যাপার কাছে খুব পরিচিত। প্রত্যেক বছর শীতকালেই ঠিক এরকমই হয়। কোনও কিছুই অন্যান্য বছরের থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না ন্যাপার কাছে, শুধু ওদের আসা-যাওয়াটা ছাড়া। মোটামুটি নিয়ম করে সোম-বুধ-শুক্র ন্যাপার কাছে আসাটা ওরা কখনওই বন্ধ করেনি। প্রায় প্রত্যেকদিনই চলত ঝাল নিয়ে খুনসুটি। এক-একদিন ওরা বিভোর হয়ে থাকত ওদের স্বপ্নের দিনগুলো নিয়ে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকত পরস্পরের দিকে। কোনও কথা বলত না। ভুলে যেত ন্যাপার উপস্থিতি। ওদের সব কথার মানে ন্যাপা বুঝতে পারত না, কিন্তু তার খুব ভাল লাগত। তার মনে হত এমন একটা ভাল কিছু হচ্ছে যেটা সাধারণত হয় না। এতদিন ধরে তো সে এখানে বসছে, এত লোক তো তার কাছে আসে, কই এমন তো কখনও হয়নি!
সরস্বতীপুজোর দিন ওরা দুপুরবেলা এসেছিল। সেদিন অবশ্য ছিল রবিবার।
ন্যাপা আশা করেনি ওরা আসবে। ওদের দেখে খুব খুশি হয়েছিল ন্যাপা। মেয়েটা শাড়ি পরে সেজেছিল। ছেলেটা পাঞ্জাবি-পাজামা পরেছিল।
“কী ন্যাপা? তোমার বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করেছিল।
“না ম্যাডাম, আমাদের পাড়ায় হচ্ছে… আমরা ওখানেই পোসাদ খাই।”
“তুমি লিখতে-পড়তে পার?”
“না ম্যাডাম, সেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেখা হয়নি…”
“কেন? পয়সার অভাবে?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম, বাবা মরে গেল, দাদাও মরে গেল, পয়সা তো কামাতেই হবে, নইলে খাব কী?”
“কে কে থাকে তোমার বাড়িতে?”
“আমি, মা, আর বোন। বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে…”
“বিয়ে? কত বয়স তোমার বোনের?”
“পনেরো…”
“এই বয়সে বিয়ে দিচ্ছ? এটা বেআইনি জান না? আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়া অন্যায়… টিভিতে দ্যাখো না?”
“আমাদের টিভি নেই ম্যাডাম…”
“ও…”
“আমাদের মধ্যে ওসোব নেই ম্যাডাম, আমাদেরই খাওয়া জোটে না। বোনটা বিয়ে করে অন্য বাড়ি যাবে… ওদের আমাদের চাইতে পয়সা বেসি… ভাল খেতে-পরতে পারবে…আমাদেরও খাওয়ার খরচা কমবে…সুবিধা হবেস ম্যাডাম।”
“বুঝলাম। দাও, ঝাল কম দিয়ো আজ। ”
“আচ্ছা ম্যাডাম…” ন্যাপা একগাল হেসে কাজে মন দিয়েছিল।
খাওয়া শেষ করে ওরা রোজকার মতো হারিয়ে গিয়েছিল সিটি সেন্টারের কংক্রিটের অলিগলিতে।
এপ্রিল-মে মাসের প্রচণ্ড গরমেও ওরা নিয়মিত আসত। সন্ধের পর যখন গরমের দাপট একটু কমত, তখন আসত ওরা। জুন মাসের পরে ওরা আর আসেনি। এখন জুলাই মাস শেষ হতে চলেছে। আবার ফিরে এসেছে বর্ষা। মাঝে-মাঝেই ভিজে যাচ্ছে কলকাতা। আজ প্রায় সারাদিন ধরেই বৃষ্টি হয়েছে। আজ ন্যাপার খুব মনে পড়ছে ওদের কথা। গত একমাস ধরে প্রত্যেক সোম-বুধ-শুক্রতেই ওদের কথা মনে পড়েছে ন্যাপার। আজও শুক্রবার। আজ কি ওরা আসবে? সকাল পেরিয়ে দুপুর এল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ল। গোধূলির পথ ধরে নেমে এল সন্ধে। আলো জ্বলে উঠল রাস্তায়, দোকানে।
“দাও…ঝাল ছাড়া…”
আনমনা হয়ে প্লাস্টিকের টুলে বসেছিল ন্যাপা। চমকে উঠল চেনা পুরুষকণ্ঠ শুনে। হঠাত্ করে তার মনের ভিতর যেন অনেকগুলো আলো জ্বলে উঠল এক মুহূর্তে। সে তত্‌ক্ষণাত্ উঠে দাঁড়াল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে নেমে এল গাঢ় অন্ধকার। সে যা দেখল, তা সে কোনওদিন কল্পনাও করতে পারেনি। ছেলেটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মেয়ে। কিন্তু এ তো সেই ম্যাডাম নয়! এ তো অন্য একটা মেয়ে! মেয়েটার দিকে তাকাল ন্যাপা। আজ তার আর লজ্জা করল না। মেয়েটার মাথার মাঝখানের সিঁথি ঢাকা পড়ে গেছে লাল আত্মবিশ্বাসী সিঁদুরের প্রলেপে। ন্যাপার মাথার ভিতরটা দপদপ করতে শুরু করল। সে ভুলে গেল তার কাজ।
“দশ টাকায় ছ’টা, স্যার…” ন্যাপা ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল।
“হ্যাঁ…দাও…” ছেলেটা ন্যাপার চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে উত্তর দিল।
খাওয়া শেষ করে ওরা মিলিয়ে গেল রাস্তার ভিড়ে।
দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গেল ন্যাপা। সারারাত ঘুম এল না তার। বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্ধকার জানালায় ক্রমশ দিনের আলোর ছোঁয়া লাগল। সারারাত না ঘুমনোর ক্লান্তি ছিল শরীরে, কিন্ত তাও রোজকার নিয়মে কাজে বেরিয়ে গেল ন্যাপা।
আজ সকাল থেকে তেমন বৃষ্টি হল না।
কিন্তু বিকেলের দিকে হঠাত্ আকাশ ঢেকে গেল ধূসর মেঘে। দু’বার গর্জন করেই বড়-বড় জলের ফোঁটা আছড়ে পড়তে লাগল কলকাতার বুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। রাস্তার লোকজন দৌড়োদৌড়ি শুরু করল। কেউ গাছের নীচে, কেউ দোকানের ছাউনিতে সাময়িক আশ্রয় নিল। হঠাত্ রাস্তা থেকে ছুটে এসে একটা মেয়ে ন্যাপার দোকানের ছাতার নীচে দাঁড়াল। পাশে এসে দাঁড়ানো মেয়েটাকে দেখে চিনতে ভুল হল না ন্যাপার। মুহূর্তের মধ্যে তার মনে পড়ে গেল গতকাল সন্ধের ঘটনাটা। মনের মধ্যে একের পর এক ভেসে উঠতে থাকল গত একবছরের সোম-বুধ-শুক্রর ছবিগুলো। একটা তীব্র যন্ত্রণা ন্যাপার তলপেট থেকে উপরের দিকে বেয়ে উঠতে শুরু করল। ক্রমশ পেট, বুক পার করে সেটা গলার কাছে এসে ধাক্কা মারল, কামড় বসাল ন্যাপার দু’চোখের কোণে। মেয়েটা একবারও ন্যাপার দিকে তাকায়নি, অধৈর্য ভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। ন্যাপার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। বেদনা আর দ্বিধার এক দুর্গম বিভাজিকার উপর বেসামাল ভাবে দাঁড়িয়ে সমস্ত লজ্জা ভুলে কথা বলে উঠল ন্যাপা, “ম্যাডাম…




সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×