somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শৈশবের সাথী (দুই) গল্প

০২ রা মে, ২০১৪ রাত ৮:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গল্প শৈশবের সাথী ( এক )
আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। কবরস্থানের বড় বড় গাছ গুলো তখন ঝড়ো বাতাসের সাথে মোচড়ানো শুরু করে দিয়েছে । মানিক ভাই বলল " তাড়াতাড়ি কবরস্থানটা পাড় হ । নাইলে মাথার উপর ডাইল ভাইংগা পড়তে পারে । "
আমি এই কথা শুনে আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। মানিক ভাই আমার জন্য আস্তা আস্তে দৌড়াছ্ছে । এখানে চাইলেও জোরে দৌড়ানো যায় না , কারন বড় বড় গাছের জন্য রাস্তাটা আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে । ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ইয়া মোটা মোটা এক একটা ফোটা । গায়ে লাগলে চামড়া জ্বলে উঠে ।
মানিক ভাই আবার বলল " চৈতি জোরে আরও জোরে দৌড়া । এখন ঠাডা পড়া শুরু অইব । তখন এই সব গাছের নিচে থাকলে বিপদ। গাছের উপর ঠাডা বেশি পড়ে । ঠাডা পড়ার সময় গাছের নিচের থিকা খোলা জায়গায় থাকনডা বেশি নিরাপদ।
এর মধ্যেই আমরা কবরস্থান পাড় হয়ে গেলাম । বিকট আঁওয়াজে বজ্রপাত হছ্ছে । মনে হছ্ছে কান ফেটে যাবে । ভয়ে আমি দুই চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে গেলাম । মানিক ভাই আমাকে দাড়িয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে এল " আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল " কিরে ডর লাগে ? ক্যান আমি আছি না । এই ঠাডা তোর গায়ে পড়ার আগেই আমি নিজের বুক পাইত্যা ঠেকামু । "
আমি চোখ খুলে মানিক ভাইয়ের দিকে তাকালাম । মাথার চুলগুলো ভিজে মুখের উপর লেপ্টে আছে। গভীর কালো দুই চোখে কিশোরের দুরন্ত ভয়হীন কোমল দৃষ্টি । দেখেই বুঝতে পারলাম সেখানে আমার অবস্থানটা কোথায় ? আমার কিশোরী দেহ কিসের এক অজানা শিহরনে কেঁপে উঠল। বুজতে পারলাম না তাকি বৃষ্টির হিমেল স্পর্শে না অন্য কিছু। মনে হল সত্যি তাই করবে। এর উপর ভরসা করা যায়। হঠাৎ করে আমার ডর-ভয় সব কোথায় চলে গেল।
" মানিক ভাই আমি আর দৌড়ামু না হাইট্টা যামু । তুমি লগে থাকলে আমার একটুও ডর লাগব না । আমার হাতটা ধর। "
মানিক ভাই আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকাল
তারপর মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল " ঠিক আছে চল। "
আমরা দুইজন কিশোর- কিশোরী হাত ধরাধরি করে, জমির আল বেয়ে হাটছি । চারদিকে ধূ ধূ জমিন, তার মাঝে ঝড়ো বাতাসের সাথে ঘন বৃষ্টি আমাদের অবগাহন করছে । বৃষ্টির ঘনত্বে চারদিকটা হয়ে গেছে ধোয়াশা । মাঝে মাঝে বিকট শব্দে আছড়ে পড়া বজ্রপাত, মাটির বুকে মাথা ঠুকে নিষ্ফল আতংক ছড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি এখন আর কিছুকেই ভয় পাইনা ।
সেদিন বাসায় ফেরার পর আমার গায়ে প্রচন্ড জ্বর এল । পরবর্তিতে সেই জ্বর নিউমোনিয়ায় রুপ নিল; , আমাকে প্রথমে গ্রামের সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সেখানকার ডাক্তাররা অপারগতা প্রকাশ করায়, ঢাকা বিভাগীয় হাসপাতালে নেওয়া হল। ওখানে প্রায় পনের হতে বিশদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হলাম । সুস্থ হলেও শরীর খুব দুর্বল ছিল তাই আর গ্রামে যাওয়া হল না । বাবা ঢাকায় সরকারী চাকরী করতেন তাই মেসে থাকতেন । আমি অসুস্থ হয়ে ঢাকা আসার পর বাবা সরকারী কলোনীতে বাসা পেলেন । মা ও আমার ছোট ভাইসহ সবাই গ্রামের তল্পি তল্পা গুটিয়ে ঢাকার স্থায়ি ভাবে বসবাস করতে লাগলাম। আমদের দুই ভাই-বোনকে এখানে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল।
আমি গ্রামের মেয়ে । দড়ি ছাড়া গরুর মত সারাদিন বান্ধবীদের সাথে টৈ টৈ করে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম । শহরে আসার পর কয়েকদিন নতুনত্বের কারনে ভাল লাগলেও , পরবর্তিতে এই ছোট্ট গন্ডির ভেতর হাপিয়ে উঠলাম । মাস খানেক পরই শুরু করলাম ঘ্যানঘ্যানানি ।
" এইহানে থাকুমা চলেন আমরা আমাগো বাড়িতে যামুগা । আমার এই হানে ভাল লাগে না । একটু বেড়ান যায়না । কেউর লগে কথা কওন যায়না । সবাই যার যার ঘরে বইয়া থাকে । আমার ভাল লাগে না । "
আমার এই ঘ্যাননানিতে মা -বাবা দুজনেই স্বান্তনা দিতেন ।
" আর কয়ডা দিন থাক দেখবি তখন খুব ভাল্লাগবো । "
তারপরও আমি কান্না করতাম।
আমার মন সারাক্ষন পড়ে থাকত সেই সবুজ ছায়া ঘেরা পাখির কলতানে সরব গ্রামে ।
দখিনা বায়ুর ছুয়ে যাওয়া অনাবীল সবুজ -সোনালী ধান ক্ষেতের বুকে।
কলকল - ছলছল করে এঁকে বেঁকে যাওয়া ছোট্ট খালের বুকে ভাসা কোসা নায়ে।
পুকুরের বুকে দাপাদাপি করে, গোসল করা ভেজা কাপড়ে সোনালী রোদের ছোয়া সেই দুপুরে ।
গাছের ডালে ঝুলে শামুক ভাংগা দিয়ে আমের চামড়া ছিলে খাওয়া সেই ছুটির দিনে ।
বাঁদল দিনের ঘন বরষে ভিজে কাদায় লুটোপুটি করা সেই দুষ্টুমিতে ।
মেঠো পথে দুই পাশের জংলা গাছের আশেপাশে উড়া জোনাকি পোকা দুই হাতের মুঠায় ধরে বাড়ি ফেরা সেই রাতে ।
শীতের কুয়াশায় কাঁপতে কাঁপতে খেজুর রস খাওয়া সেই ভোরে ।
মন পড়ে থাকত মানিক ভাইয়ের ডানপিটে কাহিনী শোনা সেই রুপকথাতে ।
মন চাইত ছুটে যাই এই দালানের কারাগার ভেংগে ছোট্ট আমার সবুজ গাঁয়ে । যেখানে আছে আমার সহপাঠি বান্ধবীরা । আছে খালা-ফুপু দাদী-নানীরা আরও আমার রোমান্চে ভরা সেই প্রিয় দিন গুলির সাথী মানিক ভাই । যেখানে ফেলে এসেছি আমার রাংগানো শৈশব ।
আছ্ছা মানিক ভাই এখন কি করছে ? নিশ্চয় আমার কথা ভেবে আমার মতই কাঁদছে । আমাদের বাড়ির উঠানে বারবার এসে দেখছে আমরা এসেছি কিনা ।এই সব ভাবনায় কেটে যেত আমার সারাদিন । স্কুলেও সারাদিন উদাস হয়ে থাকতাম । তবে পড়ালেখা ঠিক ছিল।
এভাবে আস্তে আস্তে বছর শেষ হয়ে গেল। স্কুলের সমাপনী পরিক্ষা শেষ হলে আমরা স্বপরিবারে গ্রামের বাড়িতে এলাম ।আমরা বাড়িতে আসা মাত্র আমাদের আত্মিয় স্বজনরা এল । আমার বান্ধবীরা সবাই আমাকে দেখে বলল " কিরে শহরে যেয়ে তুই অনেক সুন্দরী আর ডাংগর অইয়া গ্যাছস । "
আমি ওদের কথা শুনে লজ্জিত হয়ে যাই ।
সবাই এল মানিক ভাই এল না । দুই চোখে শুধু তাকেই খুজি । বাইরে কারও আওয়াজ শুনলেই মনে হত এই বুঝি মানিক ভাই এল । কিন্ত দুই দিন পার হওয়ার পরও মানিক ভাই এল না । দুই দিনের দিন মানিক ভাইয়ের মা এলেন । সইকে দেখে আমার মা কি খুশি ! দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে কত অভিযোগ করে ফেললেন ।
" কিরে সই আইজ দুইদিন অইল আমি আইছি, তোর এত দিনে আমার লগে দেখা করতে আহনের সময় অইল ?
" কি করুম ক , একা মানুষ তার উপর বাবা অসুস্থ । আজকা বাবা একটু সুস্থ অইছে । তয় মানিকেরে ঘরে থুইয়া তরে দেখতে আইছি ।''
আমি সামনে এসে খালাকে সালাম দিলাম । খালা আমাকে দেখেই বুকে টেনে নিলেন " কিরে তুইতো আরও ডাংগর অইয়া গ্যাছস, সুন্দরও অইছস । সই কয়দিন পরত তর মাইয়ার লিগা রাজপূত্র আনন লাগবরে । "
এই কথা শুনে আমি জোর করে খালার হাত থেকে ছুটে বের হয়ে গেলাম । যেতে যেতে শুনলাম মা বলছে " তোর রাজপুত্রটাকে দিয়া দে না ।"
আমি দৌড়ে আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় আসতেই দেখি আমার কয়েকজন বান্ধবী আমার বাড়ির দিকে আসছে ।
চলবে......।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮



গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×