somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবরের ডাক ( সত্য ঘটনা)

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বাবা যখন হূদরোগে মারা যান তখন আমি ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছি মাত্র। আমরা ছিলাম এক বোন চার ভাই। বোন আমার চেয়ে আট বছরের বড়। বিবাহীত। আমি আমার মার বড় ছেলে। ছোট আরো তিন ভাই ছিল। মেজজন আমার এক বছরের ছোট, সেজজন আমার পাচ বছরের ছোট এর সবার ছোটজন আমার বার বছরের ছোট (তখন ওর বয়স মাত্র এক বছর)।অকাল বয়সে স্বামি হারিয়ে আমার সদ্য বিধবা মা ভবিষ্যত ভাবনার অকুল সাগরে পড়ে দিশেহারা।সু-সময়ের আত্বিয় -স্বজন,বন্ধুরা সব স্বার্থের আড়ালে হারালো। চারটি নাবালক সন্তান নিয়ে আমার মা এই চট্টগ্রাম শহরে প্রায় একাকি হয়ে গেলন। এই সময় আমাদের পাশে ছিল আমাদের একমাত্র দুলাভাই। তিনিই আমাদেরকে তার নিজের আপন ভাইয়ের মত আগলে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ বিমানে ছোটখাট পদে চাকরি করতেন। বিমানের চাকরি জীবনে তিনি একজন সৎ চাকরিজীবি ছিলেন। অল্প নিজের সংসার চালিয়ে যতটুকু সম্ভব আমাদের সাহায্য করতেন।
বাবা মারা যাবার পর মার কাছে যা ছিল আর আত্তীয়-স্বজন সহানুভুতিতে যা যা দিয়ে ছিল তা দিয়ে কিছুদিন চলার পর অর্থের টান পড়ল। তখন সবাই বলল শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে। আমার মা ছিলেন খুবই স্বাধিনচেতা ধরনের এবং আত্তসম্মানবোধ সম্পন্ন মহিলা। তিনি কারো কথায় কান না দিয়ে স্বামির রেখে যাও নায়ের হাল নিজের হাতে তুলে নিলেন। শিক্ষিত ছিলেন তাই টিউশনী করা শুরু করলেন। প্রথম দিকে নার্সারীর ছাত্র-ছাত্রী পড়াতেন কিন্তু ওনাদের আমলের অংক আর বর্তমানের অংকের সাথে বিস্তর ফারাক থাকায় ওনার জন্য সমস্যা হয়ে দাড়াল। তখন তিনি পড়ানোর বিষয় বদলে ফেললেন। তিনি কোরান শিখানো শুরু করলেন। ছেলেরা বড় না হওয়া পর্যন্ত তিনি অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়েছেন। এভাবে চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে একা একজন মহিলা শুধু মাত্র কোরান শিক্ষা দিয়ে চার জন সন্তানকে মানুষ করেছেন।
ধীরে ধীরে আমরা বড় হলাম আমাকে বিয়ে করালেন। আমার মেয়ে হল তারপর একটা ছ্বেলে হল। মেয়েটা ছিল আমার মায়ের সার্বক্ষনিক সংগী। এরপর আমার ছোট ভাইটিকে বিয়ে করালেন। সাল রোজার সময় প্রায় মার পেট ব্যাথা করছিল। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার দেখেশুনে কিছু টেষ্ট করতে দিল। ঈদের একদিন পড়ে আমি সস্ত্রীক শ্বশুর বাড়ি গেলাম। যাওয়ার পরদিন সবার ছোট ভাই ফোন করলঃ ভাইজান আম্মার পেটে ব্যাথা জন্য ডাক্তার দেখিয়েছি।
ঃ ডাক্তার কি বলল ?
ঃডাক্তার টেষ্ট দিয়েছিল ওগুলো করানো হয়েছে।
ঃরিপোর্ট কি ?
ঃখারাপ। গলব্লাডারে পাথর হয়েছে। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে।
আমি আমার বেড়ানো সংক্ষিপ্ত করে চলে এলাম । আমি আসার পর আম্মার অপারেশন করানো হল। পাথরগুলো বের করে ঢাকা পাঠানো হল পরিক্ষা করানোর জন্য। প্রায় দশদিন (!) পর ফলাফল এল নেগেটিভ।আমার মার ক্যানসার হয়েছে। লিভার সিরোসিস।
আমারা সবাই স্তব্দ হয়ে গেলাম।
স্বামি মারা যাওয়ার পর যে মহীয়সি নারী নিজেকে বিলীন করে আমাদের চার ভাইকে এই কঠিন পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেই তিনি এখন আমাদের এতিম করে চলে যাছ্ছেন না ফেরার দেশে।
ডাক্তার সময় দিলেন পাচ মাস। আমরা তারপরও সাগরে ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিকের মত মাকে বাচানোর আশায় খড়কুটো আকড়ে ধরার ব্যার্থ প্রয়াস চালিয়ে যেতে লাগলাম। যে যেখানে বলেছে সেখানেই ছুটে গিয়েছি মায়ের রোগ নিরাময়ের আশায় । আমার সেজভাইটি তার চাকরির বেতন থেকে কিছু কিছু করে জমিয়ে রাখত শুধু এই জন্য যদি মা কখনও অসুস্থ হয় তখন চিকিৎসা করবে। ও মায়ের চিকিৎসার জন্য ওর জীবনের সব সন্চয় খরচ করে ফেলল। কিণ্তু আল্লাহ যার জীবনের খাতায় শেষ দাগ দিয়েছেন। সেই দাগ মুছবে এমন কেই বা আছে। তাই আমাদের সব প্রচেস্টা হতাশায় মিলিয়ে গেল। ধীরে ধীরে আমার মার জীবনের আলো গোধুলী লগ্ন পার হয়ে অস্তমিত হতে লাগল।
মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আমার মা বলতে লাগল আমি টুইন্না পুকুর পাড় যাব। প্রথম বার মায়ের মুখে এই কথা শুনে আমরাত অবাক, টুইন্না পুকুর পাড় কেন? কারন আমার মায়ের বাপের বাড়ি এই পুকুর পাড় পার হয়ে আরও কয়েকশ গজ যেতে হয়। বুইড়গা পুকুর পাড়ে।এমনিতে মেয়েদের বাপের বাড়ির প্রতি সবসময় দুর্বলতা থাকে। তাই তারা সুযোগ পেলেই বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে থাকে। সেখানে আমার মা বুইড়গা পুকুর পাড় অর্থাৎ আমার নানার বাড়ি না যেতে চেয়ে টুইন্না পুকুর পাড় যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। কারণ কি?
মা তখন বেশি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমরা মাকে বললামঃ আপনি এখন বেশি অসুস্থ একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই আমরা এম্বুলেন্স ভাড়া করে আপনাকে নিয়ে যাব।
কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী মা কিছুই শুনতে চাইছেন না বার বার বলছিলেন ঃ তোরা আমাকে একবার শুধু একবার টুইন্না পুকুর পাড় নিয়ে যা। মা একটু সুস্থ হবে তারপর নিয়ে যাব এই আশায় থাকতে থাকতে মা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে গেলেন। বৃহষ্পতিবার রাত এগারটায় বাসায় মা স্ট্রোক করলেন। আমরা তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স এনে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে গেলাম। সারা রাত অসুস্থতায় ছটফট করলেন। সকালের দিকে একটু সুস্থ বোধ করলেন। সারারাত মাযের পাশে আমার স্ত্রী ছিল। আমি ও আমার এক নাতি ওয়ার্ডের বাইরে ঔষধ আনা নেওয়ার জন্য দৌড়ের উপর ছিলাম। এভাবেই বৃহষ্পতিবার রাতটা কেটে গেল। পরদিন শুক্রুবার সকাল সাড়ে আটটায় আমার ছোট ভাই দুজন আসল মেজ ও সবার ছোটজন। ওরা আসার পর আমরা স্বামি-স্ত্রী বাসায় চলে এলাম ।শুক্রুবার সকাল সাড়ে দশটায় আমার এক বাঘিনা মোবাইলে কল করলঃ নানি আর নেই।
মেডিকেলে চলে এলাম। অসহায়ের মত ভেজা চোখে দেখলাম জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত আমার মা ঘুমিয়ে আছে। এমন সেই ঘুম যেই ঘুম আর কোনদিনও ভাংবেনা। স্নেহের দৃষ্টির পরশ বুলিয়ে আমাদের দিকে আর তাকাবে না। কোমল হাত দুটি দিয়ে আর আমাদের আদর করবে না। দুচোখের বাধ ভাংগা জলে বুক ভিজিয়ে মায়ের কোমল মুখখানায় শুধু একবার হাত বোলালাম।
এরপরই প্রথম যে সিদ্ধান্তটি নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কবর কোথায় হবে। চট্টগ্রাম শহরে কোন জায়গায়? এই সময় আমার মামারা ফোন করল আমরা এখানে কবর খুড়ে ফেলছি তোরা লাশ নিয়ে চলে আয়।মামাদের কথা মত আমিও রাজি হয়ে গেলাম ( কেন রাজি হয়ে গেলাম তার উত্তর আজও পাইনি। কেননা আমার বাবার কবর চট্টগ্রাম শহরে দেয়া হয়েছিল।) আমার ভাইরা প্রথমে একটু প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু পরবর্তিতে তারা আমার উপরে আর কোন কথা বলল না। (আমার ঐ সিদ্ধান্তের জন্য আজও তারা আমার উপর মনক্ষুন্ন।) আমার মায়ের লাশ নিয়ে আমরা চার ভাই ও এক বোন চলে এলাম আমাদের মায়ের সেই প্রিয় জায়গায় টুইন্না পুকুর পাড়। কারন কবর স্থানটা সেই টুইন্না পুকুর পাড়েই। ওখানেই আমাদের প্রিয় মা শুয়ে আছেন চিরশায়িত হয়ে।
(পাঠকদের প্রতি অনুরোধ আমার মায়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।)


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:৩১
২১টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×