অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে
নিস্তব্ধ বন। কোথাও মানুষের কোন ছায়া নেই। বনের গভীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ রক্ত হিম করা বানরের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। তৃষ্ণায় তন্বীর বুকটা শুকিয়ে কাঠ। সে কেন এই গভীর বনে একা দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছে না। ভয়ের চোটে একটু যে কাঁদবে তারও কোন উপায় নেই। কান্না শুনে আবার যদি বাঘ-ভাল্লুক উপস্থিত হয়, তখন কি হবে! ভাবতে না ভাবতেই পাতার খসখস আওয়াজে পেছনে তাকাতেই ভয়ে কেঁদে ফেলল তন্বী। ইয়া বড় এক অজগর সাপ তেড়ে আসছে তার দিকে। ডিসকভারি চ্যানেলে যেমনটি দেখায় ঠিক সেরকম। স্প্রিংয়ের মতো উল্টোদিকে ঘুরে দৌঁড়াতে গিয়ে তন্বী অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সে দৌঁড়াতে পারছে না। পা-দুটো যেন পাথর হয়ে গেছে। আম্মু আম্মু বলে দুবার জোরে চিৎকার দিল তন্বী। কিন্তু সে চিৎকার কেউ শুনতে পেল না। অজগরটির মস্ত বড় হা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকলো তার দিকে।
আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে
দুঃস্বপ্নটা দেখে ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছে তন্বী। ভাগ্যিস এটা একটা স্বপ্নই ছিলো, তা না হলে এতণে সে থাকতো সেই বিশাল অজগরটার পেটে। ভাবতে গিয়েই আবার গা শিউরে উঠলো তার। পাশের ঘরে আম্মু আব্বু ঘুমাচ্ছে। ইচ্ছে করেই তাদের আর ডাকলো না তন্বী। হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখা গ্লাসের সবটুকু পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ছোট্ট ব্যালকনিটায় গিয়ে দাঁড়ালো। ভোরের আলো এখনো সেভাবে ফোটেনি। নীচে মালি আঙ্কেল গাছে পানি দিচ্ছেন। বাগানের এক কোনায় বিশাল বড় এক আম গাছ। অনেক কাঁচা পাকা আম ঝুলছে সেখানে। আব্বু বলেছে এটি নাকি ল্যাংড়া আম গাছ। কি অদ্ভুত নাম রে বাবা! ভাবতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল তন্বী। মনের অজান্তেই সে সিড়ি বেয়ে টুকটুক করে খালি পায়ে নেমে গেল বাগানে। মালি আঙ্কেলকে বলবে পাকা দেখে একটি আম পেড়ে দিতে। উহু, সে নিজেই পাড়বে আম গাছ থেকে। সে এখন অনেক বড় হয়েছে না। নিজেই নিজের সব কাজ করতে পারে।
ই-তে ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে
দেখতে দেখতেই ঝলমলে রোদ উঠে চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল। বাগানে ঘাসের ওপর পড়া শিশিরে তন্বীর পা ভিজে গেছে। বেশ মজাই লাগছে তার। যদিও মালি আঙ্কেল বারবার বলছেন ভেতরে গিয়ে স্যান্ডেল পড়ে আসতে কিন্তু তন্বীর একদমই স্যান্ডেল পড়তে ইচ্ছে করছে না। কতদিন সে খালি পায়ে হাটে না। শুধু গ্রামের বাড়ি গেলে নানুর সঙ্গে মাঝে মাঝে খালি পায়ে হেটে বেড়ায়। আম্মু যদিও অনেক রাগ করেন। কিন্তু তার অনেক মজা লাগে। মালি আঙ্কেলের সহযোগিতায় পাড়া পাকা টসটসে একটা আমে কামড় বসাবে কিনা ভাবছে তন্বী তখনি দোতলার বারান্দায় আম্মুকে দেখা গেল। এত সকালে তন্বীকে নীচে বাগানে দেখে তিনি অবাক। আজ কপালে অনেক দুঃখ আছে ভাবতে ভাবতে তন্বী দৌড়ে গ্যারেজে ঢুকল। সেখানে খেলার জন্য একজোড়া জুতা রাখা আছে তার। আম্মু দেখার আগেই পায়ে দিতে হবে। কিন্তু জুতা পরতে গিয়ে তন্বী আবিষ্কার করল জুতাটার একদিকে বেশ বড় একটা ফুটো। ইঁদুর কেটে ফেলেছে! জুতার ভেতর কয়েকটা ইদুরের বাচ্চা ভয়ার্ত মুখে চিঁ চিঁ করছে। তন্বী চিৎকার করে আম্মুকে ডাকতে লাগল।
ঈ-তে ঈগল পাখি পাছে ধরে
তন্বীর চিৎকার শুনে দৌড়ে নীচে নেমে এলেন আম্মু। এসে দেখলেন তন্বী লাফাচ্ছে। ভয়ে নাকি আনন্দে বোঝা গেল না। চিৎকার শুনে ততণে সেখানে বাসার কাজের ছেলেটাও হাজির। ইঁদুরের বাচ্চা দেখে সে মহা উত্তেজিত। কিন্তু আম্মুর ধমক খেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার উত্তেজনা থেমে গেল। আম্মু তাকে কড়া নির্দেশ দিলেন ইঁদুরের বাচ্চাগুলোকে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে দিয়ে আসতে। না হয় দুদিন পরেই নাকি এগুলো অনেক যন্ত্রনা করবে। বিষয়টা তন্বীর একদমই পছন্দ হলো না। কিন্তু আম্মুর কথা বলে কথা। একটু পরে হাত মুখ ধুয়ে বাবার সঙ্গে নাস্তার টেবিলে বসলেও তন্বীর মন পড়ে রইল ইঁদুরের বাচ্চাগুলোর প্রতি। আম্মু কত নিষ্ঠুর। এত ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে কি কেউ ফেলে দিতে বলতে পারে! আব্বুকে এ কথা বলতেই তিনি তন্বীকে কাছে টেনে নিলেন। আর তখনই বাইরে তন্বীদের মোরগগুলো কক কক করে এক যোগে ডেকে উঠলো। আম্মু গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। কাজের ছেলেটি জানালো, ফেলে দেওয়া ইঁদুরের বাচ্চাগুলোকে নাকি ঈগল পাখি এসে ছো মেরে নিয়ে গেছে। তন্বীর মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো।
উ-তে উট চলেছে মরুর দেশে
আম্মু কেন ইঁদুরের বাচ্চাগুলোকে ফেলে দিল সেটা তন্বীকে খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললেন আব্বু। শুনে মনটা অল্প অল্প ভালো হয়ে উঠল তন্বীর। আর তখনই তার মনে হলো রাতের ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের কথা। আব্বুকে সে স্বপ্নের বর্ণনা দিতেই তিনি বললেন, এটা নাকি সারাদিন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর ডিসকভারি চ্যানেল দেখার ফল। আম্মু আদর করে কোলে তুলে নিলেন তন্বীকে আর আব্বুকে বললেন, আজ তো ছুটির দিন, চলো না আজ সবাই মিলে বিকেলে চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে আসি। সত্যিকারের অজগর দেখলে তন্বীর ভয়টাও কেটে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ, বিকেল না হতেই তারা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলো মিরপুরের চিড়িয়াখানার দিকে। চিড়িয়াখানায় ঢুকে তন্বী তো অবাক। চিড়িয়াখানায় কত মজার মজার প্রাণী। সবচেয়ে বেশি পছন্দ হলো তার উট। উটটি এমন ভাবে হাটছে যেন মরুর দেশে হেটে চলছে। সৌদি আরব সরকার এই উটটি বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। তন্বী অবাক হয়ে আব্বুকে বলল, ‘উটের পিঠ এত উঁচু কেন?’ আব্বু বললেন, ‘মরুভূমির জীব তো, পিঠের কুজে ওরা পানি জমিয়ে রাখে।’ তন্বী অবাক হয়ে ভাবল, উটগুলো কি বোকা! ওরা একটা ফ্রিজ কিনে নিলেই কিন্তু এত কষ্ট করতে হয় না। ফ্রিজের ভেতর মিনারেল ওয়াটারের বোতলে করেই পানি রাখতে পারে।
উ-তে ঊষা কালে সূর্য হাসে
‘উট কোথায় থাকে, কী খায়; এই প্রাণীটার গায়ে এত কাটা কেন, সিংহ কি কপ করে ধরে মানুষ খেয়ে ফেলে’-এ জাতীয় প্রশ্ন করতে করতে তন্বী ততণে আব্বুর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। আব্বু বিশাল ধৈর্যশীল মানুষ। নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তন্বীর সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। আম্মু অবশ্য এত কথা বলার জন্য মাঝে মাঝে অল্প অল্প ধমকও দিলেন, সঙ্গে দিলেন চিপস আর বাসা থেকে নিজ হাতে বানিয়ে আনা স্যান্ডউইচ। আব্বুর সঙ্গে হাতীর পিঠে চড়ে তন্বীর এত মজা লেগেছে যে আম্মুর কোন ধমকই সে গায়ে মাখেনি। সন্ধ্যায় চিড়িয়াখানা বন্ধ হয়ে যায়। বের হওয়ার সময় তন্বীকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভাবিত করে তুলল সেটি হলো, জেব্রার গায়ে কালোর ওপর সাদা ডোরাকাটা নাকি সাদার ওপর কালো ডোরাকাটা দাগ আর জেব্রা চাইলেও কি কখনো রঙিন ছবি তুলতে পারবে? বিকেল থেকে এত হাটাহাটির ফলে ফেরার সময় গাড়িতেই কান্ত তন্বী ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন ঊষাকালে সূর্য যখন হেসে উঠল ঠিক তখনই ঘুম ভাঙ্গল তন্বীর।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১:০৮