মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া অধ্যাপক গোলাম আযমসহ মুসলিম নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়ার জন্য সৌদি কূটনীতিক ড. আলী আল ঘামদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লিখেছেন। সৌদি গেজেটে আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই চিঠিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আলী আল ঘামদি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান কখনো এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনেননি। তিনি তার শাসনামলেও কোনো রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করেননি।
এখানে তার চিঠিটি অনুবাদ করে দেয়া হলো
মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে জানাচ্ছি যে সৌদি কূটনীতিক হিসেবে আমি স্বাধীন হওয়ার আগেই বাংলাদেশে এসেছিলাম। বাংলাদেশী হজযাত্রীদের হজ ভিসা ইস্যু করার জন্য সৌদি সরকার আমাকে ১৯৬০-এর দশকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে আমি ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের দূত হিসেবে আবার বাংলাদেশে ফিরি।
অবসরগ্রহণের পরে বাংলাদেশকে ভালোবাসে এমন একদল লোক জেদ্দায় সৌদি-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এসোসিয়েশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের লক্ষ ছিল দ্বিতীয় পক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করা এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশের জনশক্তিকে সহায়তা করা। আমি এসোসিয়েশনের মহাসচিব করে সম্মানিত করা হয়। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমরা কোনো বৈষয়িক সুবিধা গ্রহণ করিনি। আমরা শুধু সৌদি আরব এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশটির মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে চেয়েছি।
আমি করাচিতে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে আপনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করার সম্মান লাভ করেছি। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ জি এম সৈয়দের আয়োজিত এক সংবর্ধনায় আমি ছিলাম অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি। আমি সেখানে আপনার পিতার সাথে সাক্ষাত করেছি এবং তার ক্যারিশমা ও বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি ঢাকায় সৌদি দূতাবাসে দায়িত্ব পালনের সময়ে আপনার সাথেও সাক্ষাত করার সম্মান লাভ করেছিলাম। জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে আমি আপনার কার্যক্রম লক্ষ করতাম।
আমার মনে এখনো ওই দিনটির কথা সজীব রয়েছে যেদিন বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং পুলিশ যখন আপনাকে গ্রেফতার করতে যাচ্ছিল। আপনি বলেছিলেন : ‘আমাকে স্পর্শ করবেন না, আমি একজন মুসলিম নারী।’ এই ঘটনা জানিয়ে দেয় যে আপনি খোদাভীরু মুসলিম নারী। অধিকন্তু সুযোগ পেলেই আপনি সব সময় ওমরাহ করতে অত্যন্ত আগ্রহী থাকেন।
এসব কারণে আমি আপনাকে অনুগ্রহপূর্বক ও মনোযোগের সাথে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পড়তে অনুরোধ করব।
১. কারাগার থেকে ঢাকায় ফেরার পরে আপনার পিতা যে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছিলেন তা আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দেশ যেসব সমস্যায় রয়েছে সেগুলো সমাধানে কঠোর পরিশ্রম করেন। তিনি যুদ্ধাপরাধসহ অনেকগুলো আইন ইস্যু করে, যাতে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ওই আইনে কোনো বাংলাদেশ বেসামরিক ব্যক্তি বা রাজনীতিবিদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অধিকন্তু, ওই ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে পরে ক্ষমা করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে আপনার পিতা পুরো মুসলিম বিশ্বের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন। ওই সময়ে তার বিখ্যাত বিবৃতি ছিল : ‘আমি বিশ্বকে দেখাতে চাই যে বাংলাদেশীরা ক্ষমা করতে জানে, ভুলে যেতেও জানে।’
২. আপনার পিতার শাসনামলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতাকারীদের দোষী সাব্যস্ত করতে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। যদিও লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতার করা হলেও তাদের মধ্যে কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। আপনার পিতা তাদেরকে ক্ষমা ও মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তার পুরো আমলে তিনি কখনো কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেননি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পরে আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়েও একই কাজ করেছেন। যুদ্ধাপরাধ কিংবা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতার অভিযোগে আপনি কাউকে গ্রেফতার করেননি। আপনার পিতা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ায় এবং তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষমা করায় আপনি তা করেননি।
৩. আপনার পিতার নেয়া প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্তগুলো বাতিল করে যখন আবার যুদ্ধাপরাধের বিষয়গুলো ওঠে আসলো, তখন সবাই বিস্মিত হয়েছে। অনেকে মনে করে ওইসব সিদ্ধান্ত বাতিল আপনার পিতার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন, যা অগ্রহণযোগ্য বিষয়। ওইসব সিদ্ধান্ত বাতিল করার সিদ্ধান্তের যারা বিরোধিতা করেছে, তারা বিরোধী দলের এবং আপনার পূর্ববর্তী সরকারের।
৪. যেসব মুসলিম নেতাকে আপনার পিতার এবং আপনার আমলে গ্রেফতার করা হয়নি তাদেরকে গ্রেফতার করার কোনো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এই সিদ্ধান্ত দেশের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। উপরন্তু এটা জনগণকে বিভক্ত করবে, গোলযোগ উস্কে দেবে যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের নেতা হিসেবে আপনার জন্য সরাসরি ক্ষতির কারণ হবে। বাংলাদেশ ও এর জনগণের প্রতি আমার ভালোবাসার থাকার কারণে আমি বলতে চাচ্ছি যে বিশ্বজুড়ে অনেক মুসলিম নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের মতো নেতা ও মুসলিম ব্যক্তিত্বদের গ্রেফতারে মর্মাহত হয়েছেন। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা কেউ বিশ্বাস করে না। ৪০ বছর আগের ঘটনার জন্য তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই সময়ে তার বিরুদ্ধে ওইসব অভিযোগ আনা হয়নি।
৫. আমি আশা করব যে আপনি অযৌক্তিকভাবে মুসলিম নেতাদের গ্রেফতারের সিদ্ধান্তটি পুনঃবিবেচনা করবেন। আপনার পিতার জন্য, যিনি ওই সময়ে এ ধরনের কোনো অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করেননি, অনুগ্রহ করে ওইসব লোককে মুক্তি দিন। আর তা করলে আপনি আপনার জনগণের প্রশংসা ভাজন হবেন এবং সেটা হবে আপনার মরহুম পিতার প্রতি আপনার গভীর ভালোবাসা প্রদর্শন করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১২ রাত ৮:০৬ | বিষয়বস্তুর স্বত্বাধিকার ও সম্পূর্ণ দায় কেবলমাত্র প্রকাশকারীর...