somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্যালেষ্টাইনী সমস্যার ইতিবৃত্ত।

১৫ ই অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুরস্কে মুসলিম খিলাফত ভেঙ্গে যায়। ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন সহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ইহুদীবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। কিন্তু ব্রিটিশরা চাইনি ইহুদীদের ইউরোপে জায়গা দিয়ে জঞ্জাল সৃষ্টি করতে। কারণ তারা জানতো ইহুদীরা ঐতিহ্যগতভাবেই কূটকৌশলী। ইহুদীদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্রের চিন্তা শুরু হলে পৃথিবীর কোন দেশ তাদের ভূখণ্ডে ইহুদীদের বসাতে রাজী হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রে গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইহুদীদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।

দুর্বল শক্তির কারণে প্রথম পর্যায় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাষ্ট্র সমূহ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের গমনকে বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়। ইহুদীরা ফিলিস্তিন আসা শুরু করলে ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর শুরু হয় বিশ্ব ইহুদীদের একত্রিত করার কাজ। মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ, তাদের শক্তি খর্ব, তাদের মাঝে অনৈক্য স্থাপন ও মুসলমানদের দমনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে ইহুদী অভিবাসীদের ধরে এনে ফিলিস্তিনে জড়ো করার কাজ শুরু করা হয়। ফলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়। ধীরে ধীরে ইসরাইল ইহুদীদের জন্য নিরপরাধ ও স্বাধীন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠার ফলে সেখানে ইহুদীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩১ সালে ইহুদীদের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায় এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়। ১৯১৮ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় ইসরাইলের গুপ্ত ইহুদী বাহিনী "হাগানাহ" গঠিত হয়। এ বাহিনী ইহুদীবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীদের সহায়তা করা হাগানাহ বাহিনীর দায়িত্ব হলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছিল হাগানাহ বাহিনীর প্রধান কাজ।

মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি একটি স্বাধীন ও একচ্ছত্র মুসলমানদের এলাকা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ইহুদীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে মার্কিন ও ব্রিটেনের চক্রান্তকে সফল করার উদ্দেশ্যে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বিরোধিতাকে তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে। এই প্রস্তাব অনুসারে জাতিসংঘ মুসলমানদের প্রাণের মাতৃভূমির মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের প্রদান করে এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি জোর করে ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়। এভাবে ফিলিস্তিনের ভূমিকে জোর পূর্বক দখল করে গঠন করা হয় নতুন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৪৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছোট রাষ্ট্রগুলোকে চাপ দিতে থাকে জাতিসংঘে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য। মার্কিনদের প্রবল চাপ ও মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলকে জাতিসংঘ ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা প্রদান করে। স্বাধীনতা লাভ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল অস্ত্র-শস্ত্র ও শক্তিতে পরাক্রমশালী হয়ে উঠে। যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভূমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সেই ফিলিস্তিনকে পরাধীন করে ফিলিস্তিনের বাকি ভূমিগুলোকেও দখলের পায়তারা করতে থাকে ইসরাইল। বিনা অপরাধে, বিনা উস্কানিতে ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো মার্কিনীদের সেবা দাসে পরিণত হওয়ায় তারা ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে খুব বেশী আন্দোলন মুখর হতে ব্যর্থ হয়।

অধিকাংশ মুসলিম দেশ ইসরাইলকে অপছন্দ করলেও অনেক মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রটি ছিল মিশর। ফিলিস্তিনি ভূমি জোর করে দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে চলেছে। ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠন PLO প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে ফিলিস্তিনিরা। ইয়াসির আরাফাতের ইন্তেকালের পরও এখনো স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়ে চলেছে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনীরা।

আমেরিকার মদদে ইসরাইল এতটাই শক্তিশালী যে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে সিনাই মরুভূমির পাশাপাশি সিরিয়ার গোলান মালভূমি, জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং জেরুজালেমের পূর্ব অংশসহ অবশিষ্ট সকল ফিলিস্তিনী ভূখন্ড ইসরাইল দখল করে নেয়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম জর্দানের নিয়ন্ত্রণে এবং গাজা উপত্যকা মিশরের অধীনে ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের ফলে জাতিসংঘের প্রস্তাবে মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনী ভূখন্ড নিয়ে যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার কথা ছিল, সে সম্ভাবনাটুকুও বিলীন হয়ে যায়।


বিশ্বের সকল ইহুদির ইসরায়েলের নাগরিকত্ব পাবার অধিকার আছে। তাই যেকোন ইহুদীই সে যে দেশের নাগরিক হউক না কেন তারা জানে যে অন্য কোন দেশ তাদের জায়গা দিক বা না দিক তারা ইসরায়েলের কাছে জায়গা পাবে, নাগরিকত্ব পাবে, ইসরায়েলে তাদের সকল অধিকার আছে। সেজন্য তারা ইসরায়েলের উন্নয়নে যেকোন ভাবে অর্থ সহযোগিতা করে থাকেন। ছবিতে যে কোম্পানি গুলো দেখছেন তারা হয়তো ইসরায়েলের নাও হতে পারে কিন্তু এগুলোর মালিকানা ইহুদিবাদী মানুষ। সে কারণে প্রত্যক্ষ ভাবে এসব কোম্পানির মালিকানা ইসরায়েলের না হলেও পরোক্ষ ভাবে এগুলো সবই ইসরায়েলের কোম্পানি। কারণ এসব কোম্পানির মালিকগণ ইসরায়েলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।

সারকথ হলো : প্যালেষ্টাইনীদের দূরদর্শিতার অভাবে মারাক্তক ভুল ছিল ৪৫ শতাংশ জমি নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষনা না করা। তবে এতোদিন যা যা ঘটছে প্যালেষ্টাইনীদের সাথে তার পরিনাম হলো এই সাম্প্রতিক হামলা। নৃসংস এ হামলা ছাড়া আর কোন পথই খোলা রাখেনি ইসলাইল। (যদিও নৃশংসতা কখনই মঙ্গল বয়ে আনেনা) তারপরও প্যালেষ্টাইনে শান্তি ফিরে আসুক। প্যালেষ্টাইন ও ইসলাইল উভয়পক্ষই নিজ নিজ স্বার্থে শান্তির প্রক্রিয়া নিয়ে এক টেবিলে বসুক। যতদ্রুত বসবে ততই মঙ্গল।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১১:১৯
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×