
আম্লিগের নেতারা তথা শেখ মুজিব সামরিক বাহিনীর মতো একটি সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাসীনদের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করতো। অন্যদিকে ভারত কোনভাবেই চাচ্ছিলোনা যে বাংলাদেশে বড় আধুনিক সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা হোক। সেই সময় ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছিল যে বাংলাদেশের ওপর কোনো আগ্রাসন আসলে সক্রিয় ভাবে সাহায্য করা হবে তাই সামরিক বাহিনীর পিছনে সম্পদ ব্যয় না করে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণাধীন একটি আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং শেখ মুজিব কতৃক গৃহীত হয়। সেই বাহিনীর নাম করন হয় রক্ষীবাহিনী।

১৯৭২ সালের ৭ মার্চ জাতীয় রক্ষীবাহিনী আদেশ জারি করা হয় এবং তা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর বলে গণ্য করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। অর্থাৎ ভারতীয় সামরিক বাহিনী যেদিন বাংলাদেশ থেকে চলে যায় সেদিন থেকেই রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করা নির্দেশ প্রদান করা হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ভারতীয় প্রশিক্ষকের হাতে রক্ষীবাহিনী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় অন্যদিকে সামরিক বাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেই হচ্ছিল। এই বৈপরীত্য ছিল বিস্ময়কর ও প্রশ্নবোধক। আরো বিস্ময়কর ছিল পরিকল্পিতভাবেই রক্ষীবাহিনীকে রাখা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর অধীনে; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। এই বাহিনীর পোশাক রাখা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো যাতে প্রয়োজনে ভারতীয় ভারতীয় সেনার অনুপ্রবেশ ঘটানো যায়। সেই সময় নিন্দুকেরা বলতো রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বেশির ভাগই ছিল ভারতীয়।

রক্ষীবাহিনী প্রধান কাজ ছিল বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, সীমান্তে চোরাচালান রোধ, পণ্যের অবৈধ গুদামজাতকরণ ও কালোবাজারি বন্ধ এবং চূড়ান্তভাবে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিশ্চিহ্ন করা। এই বাহিনীর প্রায় সকলেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। একটা বড় অংশ ছিল মুজিববাহিনীর। বাকিরা কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য। রক্ষীবাহিনী গড়ে উঠেছিল সরকার প্রধানের এক নিজস্ব প্রহরীদল হিসেবে যাদের কার্যক্রম ছিল ঝড়ো পুলিশের মতো এবং তৈরি হয়েছিল বিকল্প সেনাবাহিনীর আদলে।

কাজ শুরুর পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে রক্ষীবাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ সকলের নজরে আসতে থাকে। রক্ষীবাহিনী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এক বিশেষ রাজনৈতিক বাহিনী হিসেবে অবর্ণনীয় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতনের সব রেকর্ড তৈরি করে, যা আগের সমস্ত নজিরকে ছাড়িয়ে যায়। রক্ষীবাহিনীর সৈনিকরা ২০-২৫ গ্রামের মানুষকে একত্রিত করে শুয়ে পড়তে অর্ডার দিত তারপর সে সব মানুষের ওপর দিয়ে মার্চ করে যেত। নকশালদের প্রতি সহানুভূতি থাকার দায়ে এ শাস্তি দেয়া হতো গ্রামবাসীদের। রক্ষীবাহিনী অনেক তুচ্ছ ঘটনায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনরোষ বয়ে এনেছিল। সারা গ্রাম ঘেরাও করে এই বাহিনী অস্ত্র, দুষ্কৃতকারী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অনুসন্ধান করতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে কথিত ভুয়া রেশনকার্ড উদ্ধার করতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় তারা বেপরোয়াভাবে হত্যা, লুণ্ঠন এমনকি ধর্ষণও করতে থাকে। তারা যেকোনো বাড়িতে প্রবেশ করতে পারতো, যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারতো। দেশের গোটা গ্রামাঞ্চলে শিবির স্থাপন করে তারা নারী-শিশু নির্বিশেষে যে কাউকে আটক রাখতে পারতো। জনগণের মধ্যে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে ভীতি ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং জনমনে ক্রমশ ঘৃণাবোধ সঞ্চারিত হয়। কোনো আদালতে রক্ষীবাহিনীর তৎপরতাকে চ্যালেঞ্জ করা ছিল দুঃসাধ্য। রক্ষীবাহিনীর যেকোনো সদস্য বা অফিসার বিনা ওয়ারেন্টে কেবলমাত্র সন্দেহবশত আইনের পরিপন্থী তৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, যেকোনো ব্যক্তি-স্থান-যানবাহন-নৌযান ইত্যাদি তল্লাশি এবং আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, শুধুমাত্র এমন সন্দেহে যেকোনো সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে পারতো। উপরন্তু রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের নজিরবিহীন ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল। যার অর্থ- তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের, অভিযোগ পেশ কিংবা আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেয়া যাবে না।
তারা অস্ত্রশস্ত্র বা গোলাবারুদের হিসাবের কোন ধার ধারতোনা। নিজেদের এরা অপরাজেয় শক্তি মনে করতো। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান পরিচালনাকালে তারা যেখানে খুশি সেখানে শিবির স্থাপন করতো। সন্দেহভাজন লোকদের ধরে শিবিরে নিয়ে আসতো। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য যে কোনো রকম নির্যাতনের পন্থা অবলম্বন করতো। কোনো রসিদ না দিয়ে তল্লাশিকালে তারা জনগণের সম্পত্তি জব্দ করার নামে হরণ করতো। ঘরে ঘরে ঢুকে লুট করতো ঘড়ি, ট্রানজিস্টার বা রেডিওসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী। প্রাণের ভয়ে কেউ তাদের আচরণের প্রতিবাদ করার সাহস পেতো না। বাজারে গিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে তারা টাকা সংগ্রহ করতো। গৃহস্থের ঘরে গিয়ে নিয়ে আসতো হাঁস-মুরগি। কোনো লোক তাদের কাজকর্মের বিরোধিতা করলে তাকে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ নদীতে নিক্ষেপ করতো। সরকারের বিরোধী যে কাউকে তারা দেশবিরোধী বলে সাব্যস্ত করতো এবং এভাবে অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে তারা। ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের একটি ‘ফ্যাসিস্ট বাহিনী’ হিসেবেই ‘রক্ষীবাহিনী’ তার পরিচিতি অর্জন করে।
গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে মুজিব শাসনামলে যে সব কারণে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম। বস্তুত গণমাধ্যমকে মুক্ত অবস্থায় রেখে দিলে রক্ষীবাহিনীকে কোনোভাবেই এতটা মুক্ত হস্তে তাদের কার্যক্রম চালাতে দেয়া সম্ভব হতো না। রক্ষীবাহিনীর অবাধ ভূমিকার স্বার্থেই গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। এই কারণে গণমাধ্যমের ওপর রক্ষীবাহিনীরও আক্রোশ ছিল। চুয়াত্তরের ১৯ মার্চ রক্ষীবাহিনী গণকণ্ঠ পত্রিকার প্রেসের যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে যায় যা ছিল গণমাধ্যমের প্রকাশনা বন্ধে ওই সময়কার এক অভিনব নজির। রক্ষীবাহিনী, মুজিববাহিনী ও সমজাতীয় বাহিনীগুলোর হত্যা, সন্ত্রাস ও নির্যাতন সম্পর্কে দেশি-বিদেশি পত্রিকায় বেশ কিছু রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। এসব রিপোর্ট ছাপার অপরাধে দেশের বহু দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কিংবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। বিদেশি অনেক সাংবাদিককেও অপদস্থ হতে হয়েছে। ১৯৭৫-এর মে মাসে রিডার্স ডাইজেস্ট-এ এক প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে লেখা হয়- জনগণের মধ্যে শেখ মুজিবের যাদুকরী ইমেজ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই পটভূমিতে শেখের পদক্ষেপগুলোও ক্রমেই নির্দয় হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎকাল অন্তত দু’হাজার আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী খুন হয়েছেন। শেখ মুজিব দু’টি বেসামরিক সংগঠনের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। একটি হচ্ছে তার ভাগ্নের নেতৃত্বাধীন এক লাখ সশস্ত্র একগুঁয়ে যুবকের সংগঠন যুবলীগ। এটি জাতীয় শুদ্ধি অভিযানে নিয়োজিত। অপরটি হচ্ছে তার (মুজিব) নিজস্ব নিরাপত্তাবাহিনী- নিষ্ঠুর রক্ষীবাহিনী। শেষোক্ত বাহিনীটি যেকোনো কারণে যখন-তখন অত্যাধুনিক অস্ত্র উঁচিয়ে মিল-কারখানায় প্রবেশ করে শ্রমিক নেতাদের উপর খবরদারি করতো। গ্রাম এলাকায় আকস্মিক কারফিউ জারি করে জনগণের মধ্যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালাতো। এরা লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় নির্মম নির্যাতন চালাতো যার পরিণতিতে বহু লোকের মৃত্যু হয়েছে। রক্ষীবাহিনী নামের এই খুনি বাহিনীর সদস্যদের হাতে কত মানুষ গুম কিংবা খুন হয়েছে তার সত্যিকার হিসাব হয়তো কখনোই পাওয়া যাবে না।
১৯৭৫ সালের ৬ অক্টোবর খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়। সেই সংগে শেষ হয় মুজিব কতৃক সৃষ্ট এক দানবীয় বাহিনীর রক্তাক্ত অধ্যায়।
(আংশিক সংকলিত নেট থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৩:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



