somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জুড়ুয়া ২ এবং আমাদের দক্ষিণ এশীয় মনোবিকৃতি

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




বরুণ ধাওয়ানের জুড়ুয়া ২ দেখার পরে আমি বাস্তবিক অর্থেই বিস্মিত হয়েছিলাম। এই ছবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, গত কুড়ি বছরে দর্শকদের রুচি ও মূল্যবোধের কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। এটা পূর্ববৎ থাকলেও হয়তোবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যেত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দর্শক রুচির আগের চেয়েও অবনমন ঘটেছে। আমার মনে হয়েছে, এই মুভি ও তৎসংক্রান্ত দর্শক প্রতিক্রিয়া (বা প্রতিক্রিয়ার অভাব) গবেষণার দাবীদার। আর সে গবেষণার ক্ষেত্র ফিল্ম স্টাডিজ থেকে শুরু করে মনোবিজ্ঞান হয়ে সামাজিক বিজ্ঞান বিশেষত জেন্ডার স্টাডিজ পর্যন্ত যেতে পারে। আপাতত একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার কিছু ভাবনা শেয়ার করলাম।

প্রথমেই কিছু বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই, এই লেখার উদ্দেশ্য ভারতীয় মূলধারার ছবি বা তার দর্শককে কটাক্ষ করা নয়। আমি এখানে দর্শক বলতে এই উপমহাদেশের সকল দর্শকদের কথা বুঝিয়েছি। প্রতিটি মানুষের রুচি ভিন্ন ও পরিবর্তনশীল। তারপরেও মোটাদাগে আমাদের উপমহাদেশের আপামর সিনেমা দর্শকদের রুচি অভিন্ন। আমরা নাচ-গান-অ্যাকশন-কমেডি-রোম্যান্সের সমন্বয়ে ছবি দেখতে ভালোবাসি। অর্থাৎ কিনা যাকে বলা হয় মাসালা মুভি।

ছবিটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিই। এটা দুই আইডেন্টিকাল টুইন (জন্মের সময় কনজয়েন্ড টুইন)-এর গল্প। একজন বড় হয়েছে মুম্বাইয়ে অন্যজন লন্ডনে। দূরত্ব যতই হোক, দুজনকে কাছে রেখেছে তাদের রিফ্লেক্স। একজন হাত নাড়ালে, অন্যজনের হাতও নড়তে থাকে (তবে, বেশিরভাগ সময়ই এই রিফ্লেক্স চারিপাশের মেয়েদের অ্যাবিউজ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে)। এটা মূলত ১৯৯৭ সালের জুড়ুয়া মুভির রিমেক। যেটার মূল চরিত্রে ছিলেন সালমান, পরিচালনায় ডেভিড ধাওয়ান। সেটা ছিলো আবার নাগার্জুনের তেলেগু ছবি হ্যালো ব্রাদারের হিন্দি রিমেক। হ্যালো ব্রাদার্সের গল্পটা নেওয়া হয়েছিলো জ্যাকি চ্যানের ৯২ সালের ছবি Twin Dragons থেকে। হাইট অফ ক্রিয়েটিভিটি বুঝি একেই বলে।

কুড়ি বছরে ফিল্মের অনেক কিছু পাল্টেছে। কিন্তু এই দুই ছবির মাঝে পার্থক্য খুব সামান্যই। একটা বড় পার্থক্য অবশ্য আছে, দুই নায়িকার পোশাক। পরিচালকের একবারও মনে হয়নি কোন দৃশ্য পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সে সব তিনি আগের মতোই রেখেছেন। ক্রিয়েটিভিটির সবটাই খরচা হয়েছে দুই নায়িকার পোশাক কি কি উপায়ে কমানো যায় তার উপরে। আসল ছবিতে রম্ভার বিকিনি পড়া গান ছিলো। ঠিক আছে এবার তাহলে একজনকে স্কার্টিনি আর আরেকজনকে টু পিস বিকিনি পরিয়ে দেই।

এই ছবিতে ভিলেন কি কি করেছে তার ছোট্ট একটা লিস্টি দেই। সে প্রথমবার নায়িকার বাড়িতে গিয়ে তার পশ্চাৎদেশে জোরে একটা চড় মেরেছে, তাকে জোর করে চুমু খেয়েছে, এমনকি তার মাকেও চুমু খেয়েছে (বলা বাহুল্য দুটোই লিপ কিস ছিলো)। আচ্ছা একটা ভুল তথ্য দিয়েছি, এই কাজগুলো ভিলেন করেননি, এর সবটাই "মে তেরা হিরো" স্টাইলে সম্পাদন করছেন নায়ক মহাশয়। সোজাকথায় অডি গাড়িতে চেপে আসা প্রিন্স চার্মিং।

নাচের মুদ্রার কথাও বা বাদ যাবে কেন! কোন এলিয়েন যদি ভুলক্রমে এই সিনেমার গান দেখে ফেলে তবে তাদের নিশ্চিত অনুসিদ্ধান্ত হবে, পৃথিবীর নারীদের মাত্র দুটো অঙ্গ সক্রিয়- স্তন ও নিতম্ব। এদেরকে না দেখিয়ে, না দুলিয়ে কোন নাচ মনে হয় সম্ভব ছিল না। শরীরের এই দুই অংশের অবাধ প্রদর্শন বাদে পুরো ছবিতে নারীর অস্তিত্ব ও প্রয়োজন সীমিত। অবশ্য নারীদের অবজেক্টিফাই করাই যদি মূল উদ্দেশয় হয়, প্রচলিত আইটেম সঙের তুলনায় এসব গানকে তখন "নির্দোষ" বিনোদনের কাতারে ফেলতে হয়। আইটেম সং বস্তুটি যে আসলে কি, সেটা আমি অনেক ভেবেও বুঝে উঠিনি। আমার ধারণা ইন্ডাস্ট্রীর মানুষদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তারাও কোন সদুত্তর দিতে পারবেন না। সেক্সুয়াল পার্ভার্সনের এই মহোৎসবকে দিনের পর দিন সবাই অম্লান বদনে সহ্য করে যাচ্ছে। যার হাওয়া আমাদের বাংলাদেশী ও পাশের নেপালী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীতেও লেগেছে। এসব গানের সাথে বাচ্চারা পারফর্ম করছে আর বাবা-মারা খুশীমনে সেই ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করছে। গানের তো এতটাই আকাল পড়েছে।

যুক্তি আসতে পারে, জুড়ুয়া টু-তো কোন সিরিয়াস ছবি না। কমেডি মুভি, তাও আবার ডেভিড ধাওয়ানের ছবি। যে সিনেমায় পুরো জীবনে একবারও কাউকে আঘাত না করা ভীতু, দুর্বল নায়কের সিক্স প্যাক আছে; সেই সিনেমায় লজিক খুঁজে কি লাভ! এই ডেভিড ধাওয়ান তার পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন টুকলিফাই করে। মেধাস্বত্বকে পায়ে দলে চুরি করা গল্প নিয়ে সিনেমা বানানো যদি অপরাধ হয়, তবে ধাওয়ান সিনিয়র সেটাকে টপ ড্রয়ার পর্যায়ে নিয়েছেন (আর ভাট পরিবার সেটাকে পরিণত করেছে অর্গানাইজড ক্রাইমে। তাদের বিশেষ ফিল্মসের লোগোটা পর্যন্ত ইয়াশরাজ ফিল্মসের "জুড়ুয়া" ভাই)। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একটা মাস্তিজাদে, সুপার কুল হ্যায় হাম (বা এনি র‌্যান্ডম সানি লিওনি মুভি)-এর চে জুড়ুয়া বেশি ক্ষতিকর? কারণ এর সমস্যা যতটা না কন্টেন্টে তার চেয়ে বেশি মোড়কে। মাস্তিজাদে যেখানে অ্যাডাল্ট রেটিং নিয়ে মুক্তি পেয়েছে, সেখানে জুড়ুয়া টু ফ্যামিলি মুভির রেটিং (U/A) নিয়ে এসেছে। এখানে নায়কের হাত থেকে বাড়ির কাজের লোক কিংবা মা কেউ-ই রেহাই পাচ্ছে না। সে সবার সাথে "ফ্লার্ট" করছে, গায়ে হাত দিচ্ছে। সবরকম আপত্তিকর আচরণকে নর্মালাইজ করা হয়েছে নায়কোচিত ভাব দেখিয়ে, শুগারকোট করা হচ্ছে "দুষ্টুমি" বলে।

তাপসী পান্নুর আলোচিত ছবি পিঙ্ক থেকে আমরা জেনেছিলাম No Means No (যেটা ঘরের স্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)। কিন্তু জুড়ুয়া টু-এর মেসেজ ভিন্ন। এখন থেকে বোধকরি অনুমতি (কনসেন্ট) নেবারও প্রয়োজন নেই। জোর করে ঠোঁট চেপে চুমু খেয়ে দিলেই হলো। এসব করলে মেয়েরা কিচ্ছু মনে করবে না। এক নায়িকা সাথে সাথে তাকে ফিরতি চুমু খাবে। আর অন্য নায়িকা পরেরবার সেই ছেলের সামনে সুইমস্যুট পড়ে গোসল করতে নামবে, বেডরুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে। ভাবখানা এমন যেন, এভরি ওম্যান ইজ নাথিং বাট আ বিগ ফাকেবল ভ্যাজাইনা। তারা অপেক্ষায় থাকে, কখন কোন পুরুষ এসে স্পর্শ করে তার জীবনটা ধন্য করে দেবে। দক্ষিণী ছবিগুলোতে তো মেল শ্যভুনিজমকে অন্য স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। NTR Jr এর ধাম্মু মুভিতে দেখানো হয়েছে এক নায়কের জন্য চার মেয়ে অস্থির। নায়ক আবার তাদের নিয়ে একটা গানও গেয়ে ফেলে (সৌভাগ্যবশত সেই সিনেমার দেশীয় রিমেক রাজা বাবুতে শাকিব খান কষ্ট করে দুই নায়িকা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছেন। বাজেট কম ছিলো মনে হয়)।

জুড়ুয়া টু পৃথিবীজুড়ে দুশো কোটি রূপীর উপরে ব্যবসা করেছে। বাংলাদেশে কতজন মানুষ এটা দেখেছে সেটা তো বের করা সম্ভব না। তবে একটা ছোট্ট তথ্য দেওয়া যেতে পারে। এর একটি স্ক্রিনার প্রিন্ট শুধুমাত্র ক্রেজিএইচডি সাইট থেকে এক সপ্তাহের মাঝে দশ হাজারবারের বেশিবার ডাউনলোড করা হয়েছে। এত মানুষ এটা দেখলো, অথচ দুর্ভাগ্যবশত সিনেমাটির এই দিকগুলো নিয়ে কোন কথাই হলো না। ফিল্ম মেকাররা পাবলিক পালস যথার্থভাবেই ধরতে পেরেছে- এসব নিয়ে কেউ কেয়ার করে না। অথবা সবাই এমনটাই দেখতে চায়। শুনেছিলাম দক্ষিণ এশীয়দের মাঝে নাকি সেক্সুয়াল ফ্রাস্টেশনের হার সবচে বেশি। কথাটা এখন আর অবিশ্বাস্য ঠেকে না।

চলচ্চিত্র সমাজকে বদলে দেয় বা সিনেমায় ভালো আচরণ দেখালেই নারীদের প্রতি সবার ব্যবহার রাতারাতি পাল্টে যাবে, এমন অর্বাচীন মন্তব্য আমি করবো না। তারপরেও কুড়ি বছরে অনেক কিছু পাল্টেছে। আমাদের সচেতনতার পরিধি বেড়েছে। এখন নিউজফিডে গেলে "কলরবের" অভাব দেখি না। কিন্তু আজ এত বছর পরেও সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টকে কেন হিরোইজমের অংশ হিসেবে দেখানো হবে! Don't we deserve better?

পূর্বে মুখ ও মুখোশে প্রকাশিত
http://mukhomukhosh.net/2018/04/19/judwaa2-south-asian-sensibility/
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৫৪
১৩টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×