somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ড্রাকুলা ও ওসমানী সাম্রাজ্য

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পশ্চিমা দেশগুলোতে অক্টোবর মাস এলে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। নোবেল পুরস্কারের জন্য নয়, হ্যালোউইনের জন্য। এই যেমন খুশী তেমন সাজো'র উৎসবে শত বছর পরেও হরদম যে চরিত্রটির দেখা মেলে, তা হলো কাউন্ট ড্রাকুলা। ব্রাম স্টোকারের হরর উপন্যাস "ড্রাকুলা"-এর মূল চরিত্র এই নিশাচর ভদ্রলোক। স্টোকারের ড্রাকুলা ভ্যাম্পায়ার ফিকশন ঘরানাকে জনপ্রিয় করে। যার ফলে টুয়ালাইট, ট্রু ব্লাড, হোটেল ট্রান্সসিলভ্যানিয়া দেখতে হচ্ছে দর্শকদের।

ড্রাকুলার স্রষ্টা ব্রাম স্টোকারের জন্ম আয়ারল্যান্ডে। ছোটবেলায় স্টোকার অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। ঠিক মতো হাঁটতে পারতেন না। তার সময় কাটতো ঘরে বসে মায়ের কাছে বিচিত্র সব গল্প শুনে। পরে অবশ্য তার শারীরিক অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। ট্রিনিটি কলেজে স্নাতক করার সময় তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা অ্যাথলেট। পাস করার পর স্টোকার "ডাবলিন ইভনিং মেইল"-এ নাট্যসমালোচনা লিখতে শুরু করেন। এই পত্রিকার মালিক ছিলেন জেমস শেরিডান লা ফানু। যার লেখা "Carmilla" ড্রাকুলার অন্যতম অনুপ্রেরণা হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া স্টোকারের লেখায় জন পলিডোরির "The Vampyre"-এর ছায়া পাওয়া যায়। পলিডোরি ছিলেন ইংরেজ কবি বায়রনের চিকিৎসক। ১৮১৬-তে সস্ত্রীক জেনেভা বেড়াতে গিয়েছিলেন বায়রন, সঙ্গে ডাক্তার পলিডোরি। তাদের সাথে এসে যোগ দেন শেলী দম্পতি। একবার টানা তিনদিনের বৃষ্টিতে মুখে মুখে ভুতুড়ে গল্প বানানোর খেলায় মেতে ওঠেন তারা। যার ফলে, পলিডোরি জেনেভাতে বসেই দ্য ভ্যাম্পায়ার লিখেন আর সেই অবকাশ শেষে মেরী শেলী লিখতে শুরু করেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন।


স্টোকারের ড্রাকুলা লেখার পিছে আরেকটি কারণ সম্ভবত নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ড। ডাবলিনের এক আড্ডায় স্টোকারের পরিচয় হয় ডাকসাইটে সুন্দরী ফ্লোরেন্স ব্যালকোম্বের সাথে। অস্কার তখন ফ্লোরেন্সের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। কিন্তু ফ্লোরেন্স গিয়ে মালা পড়ালেন স্টোকারের গলায়। ভগ্নহৃদয় অস্কার প্রথমে বেশ ক্ষেপে গিয়েছিলেন, পরে স্টোকার তার সাথে মিটমাট করে নেন। এই অস্কারের বিরুদ্ধে ১৮৯৫ সালে সমকামীতার অভিযোগ ওঠে। আদালতের রায়ে অস্কার দু বছর জেল-ও খাটেন। সেই মামলাকান্ডের হপ্তাখানেক পরে স্টোকার ড্রাকুলা লেখায় হাত দেন। সমালোচকদের মতে, অস্কারের ঘটনায় স্টোকার প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে ড্রাকুলা উপন্যাসে এমন "হোমোএরোটিক" আবহ পাওয়া যায়।

ব্রাম স্টোকার তার উপন্যাসে ড্রাকুলার নিবাস হিসেবে ট্রান্সসিলভানিয়ার কথা লিখেছেন। এটি বর্তমানে রোমানিয়ার অন্তর্ভুক্ত। যদিও এখন ড্রাকুলা আর ভ্যাম্পায়ার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় ড্রাকুলা নামে একজন সত্যিকারের মানুষের অস্তিত্ব আছে। স্টোকার তার মূল চরিত্রের নামকরণ করেছিলেন রোমানিয়ান শাসক ভ্লাদ ড্রাকুলার নামানুসারে। স্লোভাক ভাষায় ড্রাকুলা শব্দটির অর্থ হলো ড্রাগনের সন্তান। ওসমানী সাম্রাজ্যর বিস্তার ঠেকাতে রোমান সম্রাট গঠন করেছিলেন অর্ডার অফ দ্য ড্রাগন। ভ্লাদের বাবা সেই সংগঠনে যোগদান করায় তাকে ডাকা হতো ড্রাগন নামে। আর তাই তার সন্তান ভ্লাদ বনে যান ড্রাগনের সন্তান বা ড্রাকুলা।

রাজনৈতিক বশ্যতার অংশ হিসেবে ড্রাকুলা থাকতেন তুরস্কে। ড্রাকুলা সেখানে তুর্কী ভাষা ও অত্যাচার করার তুর্কী তরিকা রপ্ত করেন। এ দুটো বিদ্যেই পরবর্তীতে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। ড্রাকুলা একসময় রোমানিয়ায় ফিরে ওয়ালাহিয়ার শাসকের পদে বসেন। ততদিনে কন্সট্যান্টিনোপলের পতন ঘটেছে, মসনদে তখন দ্বিতীয় মেহমেত (সুলতান মেহমেতের এই বিজয় নিয়ে নির্মিত হয়েছে তুর্কী চলচ্চিত্র "ফেতিহ ১৪৫৩"। আর তার প্রপৌত্র সুলতান সুলায়মানকে তো বাংলার দর্শকেরা একনামে চেনে)। জিজিয়া কর নিয়ে ড্রাকুলার সাথে মেহমেত-এর মতবিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ড্রাকুলা (যিনি অনর্গল তুর্কী ভাষা বলতে পারতেন) তুর্কী সৈন্যের বেশ ধরে মেহমেতের এক দুর্গে আক্রমণ করে বসেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। ড্রাকুলার সবচে কাছের বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করে আর ড্রাকুলা ১৪৭৭ সালে যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান।


ড্রাকুলার মৃত্যুর পর তার অত্যাচারের গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তাকে নিয়ে লেখা বই পরিণত হয় ইউরোপের প্রথম বেস্টসেলারে। গরীবদের ঘৃণা করতেন দেখে, একবার নাকি তিনি রাজ্যের সব ভিক্ষুকদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে পুড়িয়ে মেরেছিলেন। পাগড়ি না খোলার অপরাধে সুলতান মেহমেতের দূতদের মাথায় পেরেক দিয়ে পাগড়ি গেঁথে দিয়েছিলেন। তবে তার সবচে পছন্দের পদ্ধতি ছিলো শূলে চড়ানো (Impaling)। ড্রাকুলার নিজের জবানীতে জানা যায়, মেহমেতের দুর্গ অধিকার করার পর তিনি ২৩,৮৮৪ জন বেসামরিক নারী ও শিশুকে শূলে চড়ান। তার নাম হয়ে যায় দ্য ইম্পেলার।

মোটা দাগে হিসেব করলেও, ড্রাকুলাকে নিয়ে নির্মিত ছবির সংখ্যা অনায়াসে ত্রিশ ছাড়িয়ে যাবে। যার মাঝে চলচ্চিত্র হিসেবে সবচে এগিয়ে থাকবে ফ্রেডরিখ মারন্যাওয়ের নসফেরাতু। ফিল্ম স্কুলগুলোর পাশাপাশি অকালটিস্টরাও পরিচালক মারন্যাওকে ভুলতে পারেনি। জার্মানিতে তার সমাধিতে বার কয়েক হানা দিয়েছে তারা। সর্বশেষ ২০১৫ সালে মারন্যাওয়ের মাথার খুলি চুরি যায়। অকুস্থলে মোমের উপস্থিতি থেকে ধারণা করা হয়, কবর খোঁড়ার পূর্বে সম্ভবত কোন আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়েছিলো।

ড্রাকুলা উপন্যাসে কোন নির্দিষ্ট কথক নেই। পুরো গল্পটি বলা হয়েছে দিনলিপি, চিঠি, রেকর্ডিং কিংবা পত্রিকার রিপোর্টের মাধ্যমে। শোনা যায়, এই বর্ণনাভঙ্গি (এপিসটোলারি ফরম্যাট) সত্যজিতকে খুব আকৃষ্ট করায় তিনি প্রফেসর শঙ্কুও একইভাবে লিখেছিলেন। ড্রাকুলা স্টোকারকে নাম বা যশ কিছুই দেয়নি। কিন্তু তার সৃষ্টি ড্রাকুলা দর্শকদের দৌলতে অমরত্ব পেয়েছে।


মুখ ও মুখোশ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত
http://mukhomukhosh.net/2019/10/31/draculaverse/
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×