রাত প্রায় ১১টা।রাস্তাগুলো ফাঁকা হতে শুরু করেছে।স্বপ্ন ওভারব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে সোজা ল্যাম্পপোস্টের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল ৪-৫বছর বয়সী একটি মেয়ে তার বাবাকে জরিয়ে ধরে পেটকাটা মটরসাইকেলে করে কোথাও যাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে।বাঁধিয়ে রাখার মত দৃশ্য।স্কুটি গুলোকে ও পেটকাটা মটরসাইকেল বলে। স্বপ্নর মনে কৌতুহল জাগল যে কি নিয়ে তারা কথা বলতে আর হাসতে পারে।কৌতুহলতার ঘোর কাটতে না কাটতেই সজোরে একটি শব্দ শুনল।পিছনে তাকিয়ে দেখে ঐ পেটকাটা মোটরসাইকেল এর সাথে একটি মাইক্রো বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।মোটরসাইকেলটা ছিটকে কয়েকমিটার দূরে গিয়ে পড়েছে।অবস্থা দেখে দৌড়ে ওভারব্রীজ থেকে নেমে ঘটনাস্থলে চলে যায় স্বপ্ন।বাচ্চা মেয়েটা আঘাত পেয়েছে বেশি।কচি মেয়ে যতটুকু লেগেছে তাতেই অবস্থা খারাপ।মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝড়ছে।ওর বাবার হাত মাথা ছিড়ে গেলেও তা মালুমে না নিয়ে মেয়ের অবস্থা জানতে উঠে দাড়িয়েছে।মেয়ের অবস্থা দেখে লোকটির বেহুঁশ হবার যোগাড়।রাত যেহেতু অনেক স্বপ্ন কারো জন্য অপেক্ষা না করে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে খালি একটা লেগুনা ডেকে পেকেটের রুমাল বাচ্চাটির মাথায় চেপে ধরে হসপিটালে ছুটল।সাথে লোকটিও।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাছের সরকারী হাসপাতালে পৌঁছালো তারা।ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবার পর দেখা গেল ডাক্তার নেই।দায়িত্বে থাকা কর্মী বাসা থেকে প্রায় আধা ঘন্টা চেষ্টার পর একজন ডাক্তার ডেকে আনল।এর মধ্যে বাচ্চাটার মাথায় ব্যান্ডেজ করা হল।কিন্তু রক্ত থামেনি।ডাক্তার এসে আরো দুইজন শিক্ষানবীশ নিয়ে ইমার্জেন্সি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলেন।আর জানালেন একঘন্টার মধ্যে দুই ব্য্যাগ ও পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন ছিল।সাহায্য করার মত শুধু স্বপ্ন।রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।কোথায় পাবে রক্ত?মানবতাটা জেঁকে বসল তার উপর।বাচ্চাটার বাবার অবস্থাও ভালো না।তাকেও বেডে নিয়ে যাওয়া হল।অবশিষ্ট শুধু স্বপ্ন।কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।ওরও রক্তের গ্রুপ সেম।কিন্তু মাত্র ১৫দিন আগেই রক্ত দিয়েছে।স্বাস্থ্যো খুব ভালো না।চিকনা ছাঁকনা।সাথে তার জন্ডিস থেকে উঠল মাত্র তিন দিন আগে।মাত্র সুস্থ হতে শুরু করেছে।সাত পাঁচ ভেবে ফেসবুকে লগিন করে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দিল।আর বেরিয়ে পড়ল রক্তের সন্ধানে।শ্যামলী কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করল।কেউ দিতে পারল না।কারো কাছে নেই।মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল স্বপ্ন।অনিশ্চিত আশংকা ঘিরে ধরল স্বপ্নকে।বাচ্চা মেয়েটির জন্যে এত খারাপ লাগবে কেন?ইচ্ছে করলেই পালিয়ে যেতে পারে সে।তারও রক্ত দেবার মত অবস্থা নেই।যদি দেয় তাহলে তার জীবনই সংকায় পড়ে যাবে।
ফিরে গেল চার মাস আগে।বাবা মারা গিয়েছে এক বছর আগে।রোড এক্সিডেন্টে।স্পট ডেড।বেশ কিছু দেনা ছিল তার।একটা ফ্ল্যাট কিনেছিল ধার করে।বাবা মারা যাবার পর সব পাওনাদাররা টাকা পাবে কিনা তার আশঙ্কায় পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে।মা দিশে হারা হয়ে যান।তার উপর মায়ের গর্ভে তিন মাসের সন্তান।মামা চাচাদের কাছে ধর্ণ্যা দিয়েছিল মা।কেউ সাহায্য করেনি।উপরন্তু ফিরিয়ে দিয়েছে।মা উপায় না পেয়ে সকল জায়গা-জমি বিক্রি করে দিয়েছে।সাথে কিছু গয়নাও।তা দিয়ে সব দেনা পরিশোধ করে দেন।বাবার প্রভিডেড ফান্ডের টাকা দিয়ে চলছিল সংসার।এর মাস তিনেক পর মা ও অনেক অসুস্থ হয়ে অড়ে।বাদবাকি গয়না বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা চলছিল।স্বপ্ন অল্পের জন্য পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পায়নি।বাবা বেঁচে থাকতে ভর্তিও হয়েছিল ভালো একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।বাবা ভাল একটা চাকুরি করতেন তাই তো প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছিল।কিন্তু ও তো জানত না যে তার বাবার কোনো সঞ্চয় নেই। সব টাকা দাদা দাদী আর তার পরিবারের লোকজনের পিছনে খরচ করেছে। বাবা মারা যাবার পর টাকার অভাবে পড়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছে স্বপ্নর।আজ থেকে ঠিক চারমাস তিন্দিন আগে বাচ্চা ডেলিভেরির ডেট দেয় ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্টে বলা হয়েছিল মেয়ে হবে মানে স্বপ্নর বোন।খবরটি এত কষ্টের মাঝেও কিছুটা খুশির আলোচ্ছটা হয়ে এসেছিল মা ছেলের মধ্যে।
ডেলিভেরির সময় হঠাৎ করে প্রচন্ড রক্তপাত শুরু হয়।তিন ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিল মা ও মেয়ের জন্য।আত্মীয় স্বজন কেউ আসেনি তখন।শুধু স্বপ্ন একা ছিল।একই রক্তের গ্রুপ ছিল।অনেক চেষ্টা করেও ম্যানেজ করতে পারেনি।লাভ হয়নি।দুই বন্ধুর সাহায্যে নিজের হাতে কবর দিয়েছিল নিষ্পাপ দুটি মানুষকে।অনেক স্বপ্নকে ঐ কবরের সাথেই কবর দিয়েছিল স্বপ্ন।কিছু করার ছিল না তার।কাঁদেনি মোটেও।শুধু পণ করেছিল তার শরীরে রক্ত থাকতে কাউকে অন্তত মরতে দিবে না।এটা তার নতুন একটা স্বপ্নের মত হয়ে উঠেছিল।
প্রায় আধাঘন্টা ঘোরের মধ্যে স্মৃতি রোমন্থন করে উঠে দাড়ালো স্বপ্ন।কোথা থেকেও রক্ত ম্যেনেজ হয়নি।নাহ আর না।কোথাও খুজবে না।নিজে তো সুস্থ ভাবে হাটছে।তার মানে সে সুস্থ্য।সোজা হসপিটালে চলে গেল।অপারেশন ভালোভাবেই হয়েছে।শুধু রক্তের দরকার।বাচ্চাটাকে বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে।স্বপ্ন পাশের বেডে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।নার্স জিজ্ঞেস করল রক্ত পাওয়া গেছে কিনা।স্বপ্ন সরাসরি উত্তর দিল যে সে দিবে।দুই ব্যাগই।আর যাবতীয় মিথ্যা তথ্য দিয়ে রক্ত দিতে আড়ম্ভ করল।একহাতে মোবাইল নিয়ে সব নাম্বার ডিলিট করে দিল স্বপ্ন।মানিব্যাগে চারটাকা ছাড়া আর কিছু নেই।সে জানে এই দু ব্যাগে তার জীবনও শেষ হয়ে যেতে পারে।সম্ভাবনাও অনেক উজ্জ্বল।বেঁচেও বা কি করবে।দুনিয়ায় কেউ নাই ওর।শুধু একটা ফ্ল্যাট আর একটা মোবাইল। খেয়াল করল বাচ্চাটার মা ও অন্যান্য আত্মীয়রাও এসে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।মা পাশে বসে নামায পড়ছে আর কাদছে।সবার ইচ্ছা ফুটফুটে বাচ্চাটা আবার বেঁচে উঠবে।আবার হাসবে খেলবে।যেমনটা স্বপ্নর বোন জন্মের সময় স্বপ্ন স্বপ্ন দেখত।কিন্তু সেবার পারেনি।এবার তার সামনে সুযোগ আরেক বোনকে নতুন জীবন দানের।সেজন্য জীবনের কার্পন্যতা না করে আরেকটা জীবনের ভাগ হতে যাচ্ছে।অনেক খুশি লাগছে ওর।দু ব্যাগ রক্ত নেয়া শেষ।চোখ মেলতে পারছে না স্বপ্ন।ঘুমিয়ে গেল ।সকালের দিকে তিনবার টানা বমি করে স্বপ্ন।টিপটিপ করে চোখ খুলে একবার তাকালো পাশের বেডের বাচ্চাটার দিকে।সুর্যটার আলো এসে পড়ছে বাচ্চাটার মুখে।চোখ খুলতে দেখে বাচ্চাটার পরিবারের অনেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে এগিয়ে এল ওর দিকে।সবার মুখে অনেক খুশি।অনেক কৃতজ্ঞতার ছাপ।কিছু দরকার নেই স্বপ্নর।হাতে ভর দিয়ে বাচ্চাটার গালে আলত করে হাত বুলিয়ে একবার খুশির ভাগিদার হয়ে নিল।তারপর ধপ করে বেডের উপর পড়ে গেল।চোখটা বন্ধ করতে করতে মৃত বোন আর মায়ের চেহারাটা আসছিল তার চোখে।সে পারেনি নিজের মা বোনকে বাঁচাতে কিন্তু পেরেছে আরেক বোনকে ও তার পরিবারকে অনেক খুশি এনে দিতে।এতেই তৃপ্ত সে।তার পণ সে রক্ষা করেছে।কাউকে তার রক্তের জন্য হলেও মরতে দেয়নি।তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে শেষ বারের মত চোখটা বন্ধ করে নিল স্বপ্ন আরো একটি পরিবারের স্বপ্নের উপলক্ষ হয়ে।হ্যাঁ স্বপ্নর স্বপ্নপূরন হয়েছে।সে বেঁচে নেই তাতে কি হয়েছে তার রক্ত অন্য কারো শরীরে নতুন স্বপ্নের জাল বুনেছে।
সবসময় বেঁচে থাকার মধ্যে সুখ নেই,কাউকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে অনেক সুখ আছে।