গতকাল বাসে বগুড়া থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম এক ভাইয়ের সাথে। বাস থেকে দেখা রাস্তার সাইডের নির্মাণাধীন একটা মসজিদের বিশাল বোর্ডে টাঙানো নশকা দেখে তার উচ্ছাসের কারণে নিচের আলোচনার শুরু। শেষ পর্যায়ে আমার সম্পর্কে তার মন্তব্য হলো আমি আমেরিকার 'ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র' দিয়ে প্রভাবিত। তাদের এই রাজনীতি আমার নির্বোধ মস্তিস্কে ধরা দেয় নি। এ কারনে বদ ভাবনাগুলো আমার মাথায় ঢুকেছে। এই পোস্টের শিরোনাম তার মন্তব্যের সন্মানেই।
প্রসঙ্গ এক: মসজিদ।
আমার কথাগুলোর সারংশ-
মসজিদের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। মসজিদগুলোর দিকে তাকালে আমাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্হা বুঝার কোন উপায় থাকে না। প্রতিটা এলাকায় একাধিক মসজিদ, শুক্রবারের দুরাকাত নামাজ ছাড়া অন্যদিন গুলোতে নামাজ পড়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না, মসজিদগুলোর বেশিরভাগ অংশ ফাঁকাই থেকে যায়। মাইনষে দুইরাকাত নামজ পড়বে মাসে চারদিন, এর জন্য টাকা দান করছে মসজিদের উন্নয়নে, নতুন নতুন মসজিদ বানাচ্ছে যাতে ঐ চারদিন নামাজ পড়তেও কষ্ট না হয়, বেশি হাঁটতে না হয়। নিজের এলাকার মসজিদ অন্যটার চাইতে কত বেশি সুন্দর করা যায় এই প্রতিযোগীতায় থাকে এলাকার মুরুব্বীরা। প্রতিমাসে বাধ্যতামূলকভাবে বাড়িগুলো থেকে চাঁদা তোলা হয়, টাকাআলারা কে কার চাইতে বেশি টাকা মসজিদে দান করতে পারে এই প্রতিযোগীতায় থাকে, মসজিদে যে যত বেশি দান করে তার সন্মান ততো বেশি, কেউ কেউ আবার রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে মসজিদে টাকা ঢেলে ভাল মানুষ সাজে। বিশেষ করে গ্রামগুলোর পলিটিক্স অনেকটা মসজিদ নির্ভরশীল।
অনেকেই সারাজীবন ধর্ম কর্ম করার নাম নাই, আকাম কুকামে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সারাটা জীবন, বুড়া হইলেই তাদের আবার পরকালের চিন্তা ধরে, তিনারা কুকাম থেকে অর্জিত টাকাগুলি দিয়ে একটা মসজিদ বানিয়ে দেন, পরকালেও ৭০টা হুর পরীর সাথে যেন পুনঃরাই আকামে লিপ্ত হতে পারেন, হুরের এমনি রুপ যে গায়ের মাংস ভেদ করে ভিতরের হাড্ডি দেখা যায়, তাও আবার ৭০ টা, কেমনে তারা এই সুযোগ হাতছাড়া করে!!! তিনারা অত বোকা নন। যতদিন এই মসজিদ থাকবে ততোদিন তাদের নেকি হাসিল হবে,হুরের আশা আস্তে আস্তে পরিপূর্ণ হবে।
বাড়ি থেকে বের হয়ে কয়পা হাটলেই এখন মসজিদ পাওয়া যায়, বিশাল বিশাল সব মসজিদ, কিছুদিন পরপর আরো এক্সটেনশন হয়, আশে পাশে বাড়ানো সম্ভব না হলে উপরদিকে বাড়তে থাকে। একটা গ্রামে প্রাইমেরি স্কুল একটা থাকলেও মসজিদ থাকে অসংখ্য।
এখন একটু ভেবে দেখি, আমাদের আসলেই এত মসজিদের দরকার আছে কিনা! বা এত টাকাপয়সা খরচ করে এত বানানো মসজিদের ফিডব্যাক কি!
তার মতে, বাড়ির কাছে মসজিদ থাকলে, মসজিদ সুন্দর হলে মানুষ মসজিদমুখি বেশি হয়, নামাজি হয়। আর নামাজি হলে খারাপ গুনাবলি লোপ পায়, নৈতিকতা, মানবাতা বাড়ে।
মসজিদ নৈতিকতা মানবতা বাড়ায়, কথাটায় আমার যথেষ্ঠ আপত্তি আছে। একটা উদাহরণ দেই, আমার এক এলাকার ফ্রেন্ড; গুন্ডা বদমায়েশ যাকে বলে এমন,গান্জা ফেন্সি খাইতো, আবার ধর্মের প্রতি 'কেউ টোকা দিলেও অনুভূতিতে আঘাত খায়' এমন ছিল। একবার এই অবস্হা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিয়ে দাড়ি টুপি লাগিয়ে হটাৎ তাবলিগি হয়ে গেল। নিয়মিত নামজ রোজা, এক মাসে দুইবার তিনদিন তিনদিন তাবলিগে ঘুরে এসে আবার চল্লিশ দিনের ঘুরাও কম্লিট করে এলো। আমাদেরকে হাদিস কুরআন শুনাতো, নামাজের দাওয়াত দিত। আরও কিছুদিন ভাল থাকার পর আবারো আস্তে আস্তে আবার গান্জা ফেন্সি খাওয়া শুরু হলো। একদিন লোকমুখে খবর পেলাম সে গান্জা খেয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়, মাঝে মাঝে ফেন্সির বোতল পকেটে রেখেই নামাজ পড়তে যায়, কারণ একবোতল ফেন্সি সে একবারে খায় না, অর্ধেক মারার ঘন্টা দুয়েক পর বাকিটুক মারে। তাকে এসব জিজ্ঞেস করলে ধর্মের দৃষ্টিকোন থেকে এর পক্ষে ব্যখ্যা শুনতে হতো। এরপর আস্তে আস্তে পাঞ্জাবী বাদ দিয়ে জিন্স-শার্ট, কিছুদিন পর দাড়ি গোফ ফেলে আগের অবস্হায়।
অবস্হা যখন খুবই শোচনীয়, আত্মীয় স্বজন আর আমাদের পরামর্শে তাকে একটা ভালো মাদক চিকিৎকালয়ে ভর্তি করানো হলো, তিনমাস সেখানে থাকার পর তাকে ইংল্যান্ড পাঠালেন তার বাবা মা, তারও ইচ্ছা ছিল। প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি হয়ে এসেছে সে ইংল্যান্ডে। শেষখবর; এখন ভাল আছে, পার্ট টাইম জব আর পড়ালেখা করে সময় কাটে, ইংল্যান্ডে ইচ্ছা থাকলেও অন্তত্ব ফেনসিডিল গাঁজা খাবার উপায় নাই, আর নিজে বাঁচার জন্যই টাকা ইনকাম করতে হয় ওখানে।
মসজিদ, নামাজ, দাড়ি টুপি আসলে তার কি কাজে এসেছে! নৈতিকতা মানবতা তো সে ধরে রাখতে পারে নি। আল্লার প্রতি আর ইসলামের প্রতি প্রচন্ড বিশ্বাসের কারনে মনে হয় সে নামাজ ধরেছিল, ইচ্ছা ছিল এর মাধ্যমে পরিত্রাণ আসবে। কিন্তু একজন শিক্ষিত অনুসন্ধানী মানুষ শুধু বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে অনিশ্চায়তার মধ্যে বেশিদিন থাকতে পারে না। নামাজ আর ধর্মপালনের মধ্যে সৃষ্টিশীল কিছু নাই, কোন নতুনত্ব নাই, কোন ফলাফল নাই, একঘেয়ে অন্ধকারের জীবন, কোরআনের আলো দেখা যায় না, অনুভবও করা যায় না, শুধু বিশ্বাস দিয়ে অলীক কল্পনা করতে হয়। অনেকটা ভুত প্রেত বিশ্বাসের মতো, ভাষাটাও অজানা, কিছু বোঝা যায় না, নাজেনে নাবুঝে একটা কিছু বারবার আওড়ানো। যেকোন প্রাণবন্ত মানুষের এ ধরণের জীবন একঘেয়ে লাগাটাই স্বাভাবিক। এসব কারণেই ধর্ম এখন আর মানুষ শুদ্ধ করতে কাজে লাগে না।
ধরি একজন খুব গরীব মানুষ খুব ধর্মকর্ম করে কিন্তু দুবেলা খাবার জোগাড় তার পক্ষে প্রতিদিন সম্ভব হয় না, ধর্মকর্ম তাকে খাবার এনে দেয় না, তার অভাব পূরণ করে না। পেটে খুদার কারণেই বাধ্য হয়ে চুরি করে, তার সবচাইতে বিশ্বাসের জায়গা মসজিদও সেক্ষেত্রে বড় বিষয় হয়ে দাড়াঁয় না, একারনেই মসজিদের জুতা সেন্ডেল চুরিও তার ধর্মবোধ রোধ করতে পারে না।
আমাদের গ্রামে পরিচিত একজন ৪৮ বছর বয়সে একবার ধর্ম দিয়ে অন্ধ হয়ে গেলেন। কিছুদিন মসজিদের ইমামতিও করেছেন। সে অবস্হায় ১৬ বছরের এক কোমলমতি পোস্টবক্স*(পোস্টবক্সের উদাহরণ নিচের ছবিতে) কিশোরীকে হটাৎ বিয়ে করে ঘরে তুলেছেন, অথচ তার তিন ছেলে আর এক মেয়ের সংসার। বড় ছেলের বয়স ২৪ বছর।
বিয়েটি অবশ্য বেশিদিন টিকে নি, বৌকে তিনতালাক দিয়ে বিদায় দিয়েছেন, মেয়েটির নাকি চরিত্র ভাল না।
পরের খবর, আট বছরের এক বাচ্চা মেয়েকে ফুসলিয়ে বাতরুমে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর সোহাগ শেষে লিঙ্গ গমন পর্যায়ে শিশুটি চিৎকার চেচামেচি করে দৌড়ে পালায়, নিশ্পাপ শিশুটি তার মুখোস জনমানুষে উন্মোচিত করে। তার শাস্তিস্বরুপ নামাজে তার সবচেয়ে সামনের অবস্হানটা শুধু একটু পেছনে প্রথম কাতারে একচেন্জ হয়। মসজিদ এমনই নৈতিকতা শেখাইছে তাকে!
কোটি টাকা খরচ করে যে এই মসজিদগুলো বানানো হচ্ছে, এ টাকাগুলো দিয়ে যদি কিছু গরীব মানুষের আত্মকর্মসংস্হানের ব্যবস্হা করে দেয়া যেত (যেমন একটা রিকশা ভ্যান কিছু বা একটা খামার বা ছোট্ট একটা মুদি দোকান), কিছু মানুষ অন্তত্ব তাতে খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারতো। যত টাকা খরচ করে একজন যে মসজিদ বানায় এই টাকা অন্য কোন জায়গায় ইনভেস্ট করা হলে দেশের অর্থনীতির জন্যে কিছু হলেও তো লাভ হতো!
আবার দেখুন মসজিদের মাইকগুলোর উচ্চ ভলিউমের আযান; প্রতিটা মসজিদে বেশকয়েকটা করে মাইক লাগানো থাকে। যাদের মসজিদের পাশেই বাড়ি তারা এর যন্ত্রনা হারে হারে টের পান, কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির কারণে কেউ প্রকাশ করেন না। মাঝে মাঝে এমনও অবস্হা হয় যে ফোনে কারো সাথে জরুরী কোন কাজের কথা বলতেছি, এমন সময় আযান শুরু হওয়ায় বাধ্য হয়ে কথা বন্ধ করে দিতে হয়, মাইকের উচ্চ ভলিউমের কারনে। রোজার মাসে রাত তিনটা থেকে শুরু হওয়া একঘেয়ে চিৎকার চেচামেচি তো আছেই। মসজিদের আশেপাশে কোন বাড়িতে কেউ গুরুতর অসুস্হ হলে মাশাআল্লা তার আর চিন্তা নাই।
প্রতি সপ্তাহে জুম্মার নামাজের সময় টাকার বক্সগুলোর ছিদ্র দিয়ে টাকা না ফেলানো মনে হয় একটা লজ্জার ব্যাপার! পাছ হতে হতে কারো সামনে আসা বক্সটায় টাকা না ফেলে তার পাশের জনকে বক্স পাছ করে দেয়ার ভঙ্গি দেখলেই ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়।
ভাবি শুধু, এই প্রয়োজনের অতিরিক্ত মসজিদ বানানোর টাকাগুলো দিয়ে যদি কিছু প্রাইমারি স্কুল করা হতো তাহলে কতই না ভাল হতো!
এক একটা ফ্যামিলি প্রতি মাসে মসজিদে যে টাকাগুলো দান করেন তা দিয়ে যদি নুন্যতম ১০ টা চারা গাছ কিনে রাস্তার ধারে লাগায়ে দিতেন তাহলে কতই না ভাল হতো!
প্রসঙ্গ দুইঃ
ভাইজানের বাবা একটা হাফিজিয়া মাদ্রাসা বানিয়ে দিছেন তাদের গ্রামে, দুর্ভাগ্যত্রমে সে মাদ্রাসায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল গতকাল। কি বিশাল একটা জায়গার উপর মাদ্রাসা, চারটা বিল্ডিং, এর মধ্যে একটা লিল্লাহ বোডিং। ছোট ছোট ছেলেগুলো পান্জাবী আর টুপি লাগিয়ে ক্লাসরুমে একসাথে উচ্চস্বরে কোরান মুখস্ত করছে। কি ভয়ংকর দৃশ্য, এই বয়সে তাদের আকডুম বাকডুম…., খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো…, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি…কবিতাগুলো পড়ার কথা, ঠাকুর মার ঝুলির গল্প পড়ার কথা, বিকালে গ্রামের নিজস্ব খেলাগুলি নিয়ে থাকার কথা, রাতে বাবা মায়ের সংস্পর্শে তাদের আদর স্নেহ আর শাসনে মানুষ হবার কথা। অথচ তারা অন্য ভাষার একটা অজানা নাবুঝা বই আড়রিয়ে যাচ্ছে। শিশুগুলোকে কি করুনভাবে মানসিক বিকলাঙ্গ বানানো হচ্ছে, অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে!!!
তার যুক্তি হলো, এটা সরকারের দোষ, সরকার কেন সব মাদ্রাসাগুলোতে বাংলা ইংরেজি শেখা বাধ্যতামূলক করে না। মাদ্রাসার আরও একটা ভাল দিক নাকি হলো, প্রতিটি মাদ্রাসায় একটা করে লিল্লাহ বোডিং থাকে, এটার মাধ্যমে যাকাতের টাকাগুলো এলাকার মাঝে বিতরন করা হয়। তিনি ভবিষ্যতে এ মাদ্রাসায় দুএকটা কম্পিউটার দিতে আগ্রহী, তাতে ছেলেগুলো প্রযুক্তির শিক্ষা নাকি পাবে!
একটা ছেলে প্রথমে নিজের ভাষায়ই পড়তে না শিখলো, প্রযুক্তি কি তাই না জানলো, তার কম্পিউটার জ্ঞান দিয়ে কি হবে! আর সরকারের দোষ দিয়ে লাভ কি! সরকার তো আর গ্রামে গ্রামে হাফিজিয়া মাদ্রাসা বানায়ে দিচ্ছে না, আমরাই পরকালের সুখের জন্যে মাদ্রাসা মসজিদ বানায়ে কিছু সম্ভাবনাময় বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছি। আর মোল্লামুস্নীগো আন্দোলনের ঠেলায় সরকার কি ভালো কোন ইচ্ছা থাকলেও করতে পারে!!! তাদের তো আবার ভোটের চিন্তাও করতে হয়! আমাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে ভোট হারাবে এত বড় বলদা তো সরকার না, ধর্মানুভূতিতে আদর যত্ন সোহাগ দিয়ে কোলে বসিয়েই তারা রাজনীতি করবে।
ভাবি শুধু এই মাদ্রাসার জায়গায় যদি একটা স্কুল হতো তাহলে কতই না ভাল হতো!
প্রসঙ্গ তিন:
মোল্লা মুন্সীদের আন্দোলনে ভীত হয়ে সরকারের লালন ভাস্কার্যের স্হানে ইসলামিক ভাস্কর্য স্হাপন। অর্থাৎ দেশের সংস্কৃতির বুকে একটা কুঠারাঘাত।
তার যুক্তি, এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সুন্দর কোন কিছু যা ইসলামের সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে তোলে এমন কিছু স্হাপন করাই যুক্তিসঙ্গত কারন বাংলাদেশ একটা মুসলিম কান্ট্রি।
এই স্হানে ইসলামী নিদর্শন বানানো মানে যে দেশি সংস্কৃতিকে গলাধাক্কা দিয়ে আরবীয় সংস্কৃতি প্রাধান্য দেয়া, এইডা সে বুঝে না। লালনকে হত্যা করে ইসলামের বিজয় হলো। আবাল সরকার মোল্লা ভয়ে এতবড় একটা বেইমানী এ দেশটার সাথে করতে পারলো!!!
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:০৮