somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

--- ছোটগল্প- "বারান্দা ও রাজকুমারী" ---

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একবার কলেজের রচনা প্রতিযোগিতায় আমার জনৈক বন্ধু "মধ্যবিত্তের স্বপ্ন" শীর্ষক একটি প্রবন্ধে মধ্যবিত্ত সম্পর্কে বেশ কিছু কথা লিখেছিল। যা ঠিক এমন ছিল-
"আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি মানুষেরই স্বপ্ন রয়েছে।দরিদ্রের স্বপ্নটি যেখানে তিনবেলা পেট পুরে আহারেই সীমাবদ্ধ থাকে, ধনীর স্বপ্নটি সেখানে সম্পদ বৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে পৌছানোর পরও অপূর্ণই থেকে যায়।আর এ দুই স্বপ্নের কোনটিই যাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয় তারাই হল মধ্যবিত্ত।তবে এদের স্বপ্নগুলো যে একেবারে মামুলি নয় আবার খুব একটা উচু দরের, সেটিও বলার উপায় নেই।মধ্যবিত্তের অবস্থা অনেকটা পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী- তৃতীয় লিঙ্গের মত।না পারে দিতে, না পারে নিতে..."

রচনা প্রতিযোগিতায় বন্ধুটি পুরস্কার না পেলেও পরবর্তীতে তার কথাগুলোর সত্যতা খুঁজে পাই সবখানে।

এই মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন- নিজের একটি বাসস্থান ।তাদের এ স্বপ্ন পূরনের জন্যই হোক বা নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্যই হোক-ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে যেখানে যতটুকু খালি জমি রয়েছে তাতেই ডেভেলপার কোম্পানীগুলো আকাশ ছোঁয়া এ্যাপার্টমেন্ট গড়ে তুলছে।মুরগীর খোয়াড় সদৃশ্য এসকল এ্যাপার্টমেন্টের ছাদ আকাশ ছুয়ে যাক বা না যাক, দামটি ঠিকই আকাশ ভেদ করে যায়।যে কারনে অধিকাংশ মধ্যবিত্তের জীবন অন্যের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়েই অতিবাহিত হয়। কিন্তু আমার সরকারী চাকুরে বাবার অতিরিক্ত আয়ের সুবাদে আমাদের মধ্যবিত্তের স্বপ্নটি দেরিতে হলেও পূরন হল।

ফ্লাটটি বারোশ স্কয়ার ফিট, তিন বেড, দুই বাথ, দুই বারান্দা- ভালবাসা বলতে যেমনটি বোঝায়।সবচেয়ে ভাল লেগেছে আমার বুম লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনিটি।খাঁচার যুগে আজকাল এমন খোলা ব্যালকনি দেখতে পাওয়া যায় না।আগের বাসার বারান্দায় খাঁচা সদৃশ্য গ্রীল ছিল বলে বাদলা দিনের আনন্দ বলতে কেবল হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখা পর্যন্তই সম্ভব হত।কিন্তু এখন থেকে ইচ্ছেমত মুখ এগিয়ে বুকভরে বৃষ্টির স্পর্শ নিতে পারব।

ছোটবেলা থেকেই টুকটাক গানবাজনার শখের কারনে গিটার খুব ভালবাসি।আর গিটার প্র্যাকটিসের জন্য ব্যালকনি অতি উত্তম স্থান।কিছুদিনের মধ্যেই গিটারের টুংটাং সুর আর গুনগুন গানের মাধ্যমে ব্যালকনিটি বিকেলবেলা প্রিয় সঙ্গী হয়ে উঠল।

অবশেষে দিনটি আমার জীবনে এসে ধরা দিল।প্রতিদিনের মতই গিটার হাতে বারান্দায় এসে বসলাম।টুংটাং ছন্দে শুরু করলাম।কিন্তু কোলাহলের জন্য মাঝপথে থেমে যেতে হল।ব্যালকনি দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম।

রাস্তায় দুটি রিক্সা চাকায় চাবায় লেগে যাওয়ায় তুমুল ঝগড়া বেধে গেল। দু পক্ষই বাংলা শব্দ ভান্ডারের ওপর নিজেদের দক্ষতা প্রমানে ব্যস্ত। পাশেই এলাকার বাচ্চা ছেলের দল ক্রিকেট খেলছে। প্রত্যেকেই নিজেকে সাকিব বলে দাবি করছে। সামনে একটি বহুতল ভবনের কাজ চলছে। হঠাৎ সেখানে বিকট শব্দে ইট ভাঙ্গার মেশিন চালু হয়ে গেল।

এত কোলাহলের মাঝে কিছুতেই গিটারে মন বসাতে পারলাম না। বিরক্ত হয়ে হাতের পিকটি দিয়ে গিটারে টোকা দিতে লাগলাম আর ঘাড় দুলিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। হঠাৎ দুচোখ আটকে গেল, আমার সমস্ত মনোযোগ পাশের ফ্লাটের ব্যালকনিতে থাকা একজনের ওপর গিয়ে কেন্দ্রীভূত হল।

খোলা বারান্দার ঝুল দোলনায় গা এলিয়ে হাতের মোটা বইটা দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। মৃদু বাতাস তার ঘন কালো চুল নিয়ে খেলায় মেতেছে। এক গুচ্ছ চুল থমকে থমকে তার গাল ছুয়ে যাচ্ছে। বিকেলের মিষ্টি রোদে কোমল গাল উদ্ভাসিত। চোখে রোদ পড়ায় ঘন ভ্রু জোড়া খানিকটা কুচকে আছে, যা সৌন্দর্যের মাত্রাকে দ্বিগুন করে তুলেছে।
চারপাশে এত কোলাহল, অথচ এর মাঝেও তার মনোযোগের তিল পরিমান ব্যাঘাত ঘটছে না।প্রচন্ড কৌতুহল হল। বুঝতে চেষ্টা করলাম, এই মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে কি রয়েছে?অনেক্ষন তাকিয়ে দেখার পর বুঝতে পারলাম, আমার মনজগতের সম্পূর্ণটায় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠাকারীর মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তার হাতে রাখা শীর্ষেন্দুর মুখোপাধ্যায়ের 'দূরবীন' উপন্যাসটি। এই প্রথম কোন লেখক ও তার কাল্পনিক চরিত্রের প্রতি হিংসা হল।

ঐ দিনটির পর প্রতিটি বিকেল আমার জন্য অন্যরকম হয়ে ধরা দিল।সেই সাথে বারান্দায় যাতায়াতটাও নিয়মিত হয়ে উঠল।

তাকে দেখতাম বারান্দার অপর প্রান্ত থেকে, লুকিয়ে লুকিয়ে।তার বই পড়ার সময়টা নিদিষ্ট ছিল।প্রতিদিন বিকেল চারটায় আসবে। হাতে শীর্ষেন্দু অথবা সমরেশের একখানা মোটা বই থাকবেই।তারপর সেটি নিয়ে দোলনায় গা এলিয়ে পড়তে শুরু করবে।ব্যাস, এরপর যেন সে সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সমস্ত পৃথিবীর মত আমিও তার মনযোগ আকর্সনের নানান চেষ্টা করতাম।প্রথম প্রথম টুংটাং করে গিটারে সুর তুলতে লাগলাম।এরপর মৃদু স্বরে গান শুরু করলাম। একবার তো সাহস করে জোর গলায় গেয়েই ফেললাম-

"রাজকুমারী দু একটা কথা বলি,
বারান্দাটা ছেড়ে যেও না
ভালবাসি নিজের থেকেও বেশি
একটুখানি দাড়াও না।
তুমি আমার রাজকন্যা...."

কখনো কখনো পাশের দালানের ইট ভাঙ্গার মেশিনের সাথে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম।কিন্তু দিন শেষে আমাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হত,কিন্তু তার দৃষ্টি বইয়ের পাতা থেকে একচুলও নড়ত না।মাঝে মাঝে প্রচন্ড রাগ হত।কিন্তু, শীষেন্দু মশায়ের দূরবীন ও ধ্রুবর বংশ উদ্ধার করা ছাড়া আর কিইবা করতে পারি?

ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরা তাড়া থাকত কেবল এই একটি কারনেই।বাসায় ঢুকব, কোনরকম কাপড় পাল্টে গিটারটা হাতে নিয়ে সোজা ব্যালকনিতে চলে আসব।ব্যর্থ হতাম প্রতিদিনই, কিন্তু এটিই আবার পরদিনের অনুপ্রেরণা যুগাত।এমনি করে কেটে গেল কয়েকটি মাস।

প্রতিদিনের মতই ভার্সিটি থেকে ফিরে বাসায় ঢুকলাম।দেখলাম বসার ঘরে মা অপরিচিত এক মহিলার সাথে গল্প করছে।নিজের রুমের যেতে যেতে তাদের আলাপের কিছু অংশ কানে আসল।হঠাৎ থমকে দাড়ালাম।মনে হল আমার সেই রাজকুমারীকে নিয়ে কথা হচ্ছে।

-"....পাশের বাসার ছেলেটা কিন্তু খুবই মেধাবী।ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া চাট্টিখানি কথা না।" বললেন ঐ মহিলাটি।
- "হুম, শুনেছি। সকালে মিষ্টি দিয়ে গেছে।তবে মেয়েটা কিন্তু আরও বেশি মেধাবী।শুনলাম স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে সে।" মা বলল।
- "হুম। আমিও শুনেছি কথাটা।যাক, মেয়েটার একটা গতি হল।বাবা-মায়ের চিন্তাটা এবার একটু কমবে।
-"এ কথা কেন বললেন ভাবী? বললেন মা।
-"এই গুন দিয়ে আর কি মেয়ের বিয়ে হবে? মহিলাটি বলল।
-"হবে না কেন? মেয়েটা কোন দিকে কম? এমন মেয়ে কয়টা আছে? রূপ আর গুন দুটোই তো আছে মেয়েটার। অবাক হয়ে বলল মা।
-"আরে ভাবী, আপনি দেখছি কিছুই জানেন না!! মেয়েটা তো কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না।যাকে বলে "বোবা-কালা"।

নিজের রুমে ঢুকলাম।কাধের ব্যাগটা ফ্লোরে রেখে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লাম।কেন যেন মনে হতে লাগল, শেষ শব্দটি তিনি ব্যঙ্গাত্বক সুরে আমাকেই বললেন।
-----------------------------***-----------------------
--- সোহেল মাহামুদ(অতি ক্ষুদ্র একজন)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:৩৭
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×