somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলের দেশে, মাছের দেশে

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চলন বিল। ভরা বর্ষায় যৌবনবতী এক অচেনা সুন্দরী। মনে হয় যেন সাদার মাঝে সবুজের পাড় দেয়া শাড়ি পড়ে রূপের পসরা সাজিয়ে প্রকৃতি প্রেমিকের প্রতিক্ষায় সে। আমার ছেলেবেলার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়ি সেখানে। এই বরষায় আমার স্ত্রীসহ তাকে নিয়ে যখন সেই গ্রামে পৌছলাম তখন সূর্য সেদিনের মত বিদায়ের আয়োজনে ব্যস্ত। কি অদ্ভূত শান্ত আর সুন্দর গ্রাম! জলমগ্ন। কয়েকটি রাজহাঁস দুষ্টু ছেলের মত ঘরে ফেরার কথা ভুলে দুরন্ত জলকেলিতে মত্ত হয়ে আছে। একটা হাঁস আবার তার ছানাদল নিয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদের পিছু পিছু আমরাও পৌছে গেলাম গন্তব্যে।

অচেনা জীবন



রাজশাহী বিভাগের তিনটি জেলায় (পাবনা, সিরাজগঞ্জ আর নাটোর) বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের এই বৃহত্তম বিল। বর্ষা মৌসুমে ঢাকা থেকে রাজশাহী আসা যাবার পথেও বাস বা ট্রেন থেকে চোখে পড়ে নয়নাভিরাম চলন বিলের একাংশ।

অবারিত জলের আমন্ত্রণ



প্রায় পনের'শ গ্রাম নিয়ে ছড়িয়ে থাকা এই বিলের একসময় আয়তন ছিল প্রায় একহাজার বর্গমাইল যা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে এখন। ব্রহ্মপূত্রের প্রবাহপথ পরিবর্তনের সময় যখন যমুনার সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকেই এই বিলের জন্ম বলে মনে করা হয়। চলন বিলের মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী বয়ে গেছে যার মধ্যে আছে আত্রাই,করোতোয়া,বড়াল,তুলসী ইত্যাদি।
পরের দিন সূর্য্যিমামাকে হারিয়ে দিয়ে তার আগেই জেগে উঠলাম। ঘাটে গিয়ে দেখি নৌকা রেডিই আছে। বন্ধুকে নিয়ে আনাড়ি হাতে নৌকা চালানো শুরু করলাম। এলোমেলো যাত্রায় শুরু হলো অনন্য এক দিনের। জলের মাঝে গ্রামগুলোকে ভীষণ অচেনা লাগছিল। বাংলাদেশের সাধারন গ্রামের মত না। রাশি রাশি পানির মাঝে একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ যেন।

সূয্যিমামা জাগার আগে



সাঁঝের বিল



ছেলে-বুড়ো নৌকা নিয়ে যে যার কাজে ছুটছে। বই খাতা হাতে একদল শিশু হইচই করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে । বন্ধুর কাছে জানলাম,যাদের নিজেদের নৌকা নেই, তাদের কেউ কেউ আবার সাঁতরেই স্কুলে যায়। কখনো দেখা যায় পাশে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল ভাসিয়ে তাতে জামাকাপড় রেখে যাত্রা শুরু করে স্কুলের জন্য। এদের মধ্যেই কেউ কেউ হয়তো ভবিষ্যতে দেশ ও জাতীর কান্ডারী হবেন অথবা নোবেল প্রাইজ জিতবেন। একই রক্ত-মাংসের,একই মেধা নিয়ে জন্ম নেয়া একটা শিশু বাবা-মায়ের হাত ধরে অথবা BMW তে চেপে স্কুলে যাচ্ছে অন্যদিকে তারই মত আরেকজন নেংটো হয়ে পোশাক আগলে সাঁতরে স্কুলে যেতে হচ্ছে। সত্যিই সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ!
আরেকটা মজার ব্যাপার যে, এখানে প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই নিজেদের অন্ততঃ একটা নৌকা আছে। আর নারী-পুরুষ, ছেলে বুড়ো প্রায় সবাই নৌকা চালাতে জানে। এখানকার মানুষগুলো ভীষণ সহজ-সরল। তাদের কাছে শুকনা মৌসুমে চলনবিল একটা নাকি একটা শস্যখনি যা আবার ভরা মৌসুমে রূপ নেয় বিশাল একটা মৎসখনিতে। নাম না জানা হরেক রকম দেশি মাছের ভান্ডার এ বিল। এখানে মেলে দেশি পুটি,গজার বোয়াল,টেংরা,বাতাসী,খলসে,বাইন,চেরা,রাইখর, শৈল,টাকি ছাড়াও আরো কত নাম না জানা মাছ। এক গবেষনার তথ্য অনুযায়ী, চলন বিলে প্রায় ৮০-৯০ প্রজাতির মাছের বাস যার মধ্যে ৯০ শতাংশই দেশীয় মাছ।
মাছেদের সাথে, জেলেদের সাথে সকালটা কাটল। জেলের জীবন,জলের জীবন দেখা, নানা বিচিত্র উপায়ে মাছ ধরা দেখতে দেখতে যে বেলা গড়িয়ে দুপুর হল টেরই পাইনি।

চলনবিলের মাছশিকারি


বাড়ি গিয়ে দেখি দুপুরে নানারকম মাছের আয়োজন। সত্যি বলতে কি, মাছ দিয়ে ভাত নয়, ভাত দিয়ে মাছ খেলাম। জিরোনোর একদম সময় নেই। মাঝি এসে গেছে ততক্ষণে। নৌকা চলতে শুরু করল গ্রামের ভেতর দিয়ে। একসময় সুবিস্তৃত জলরাশির মাঝে এসে পড়লাম। পানকৌড়িরা চৌকস ডুবুরির মত জলের গভীর থেকে তুলে আনছিল শামুক/ঝিনুক। এরই মাঝে ঝুম বৃষ্টি নামল। নিস্তরঙ্গ জলে যেন নুপুরের নিক্কন। আরেকটু এগোতেই ছোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। শাপলা-শালুকের বিশাল রাজ্য! সেখানে একদল কিশোর দাপাদাপি আর পানিতে ঝাপ দিয়ে তুলে আনছিল মুঠোভরা শাপলা-শালুক।

শাপলাশিকারি-১



শাপলাশিকারি-২


আমার স্ত্রী গ্রাম্যবালিকার মত তার চুলে কয়েকটা শাপলা গুঁজে নিল আর আমি ছেলেবেলায় ফিরে গিয়ে এটা দিয়ে লাটিমের মত একপ্রকার ঘূর্ণি বানালাম।

জলছবি-১


জলছবি-২



রাতের খাবার শেষে শুরু হল স্মৃতিময় নৌভ্রমনের শেষপর্ব- জোৎস্নাপর্ব। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, মাঝির মনমাতানো সুর আর চাঁদের আলোয় প্লাবিত হলাম। জোৎস্নাস্নাত বিল, আশপাশর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত গ্রাম, অনেক দুরে পানির মাঝে একটা দুটো খড়ের গাদা, হঠাৎ উড়ে যাওয়া গাংচিল অথবা অন্যকিছু । চারপাশ কেন জানি অপার্থিব মনে হচ্ছিল। স্বপ্নের মত লাগছিল সবকিছু। বাস্তবও কখনও কখনও স্বপ্নের মত হয় কখনো বা তার চেয়ে বেশিই সুন্দর হয়!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৪৮
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×