বালিতে প্রথম সকালেই বৃষ্টির কবলে পড়লাম। আমাদের ২/৩ ঘন্টা নষ্ট হলো। পরে ট্যাক্সি করতে গিয়ে জানলাম, এটা এখানকার স্বাভাবিক বৃষ্টি। আশপাশের এলাকায় বৃষ্টি না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। যাই হোক, আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য উলুয়াটুর বিখ্যাত সানসেট পয়েন্ট। এখানে পাহাড় থেকে সাগরের বুকে সুর্য ডুবতে দেখা যায়। সুউচ্চ পাহাড়ের খাদে দাড়িয়ে মনে হয় পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে আছি। যাই হোক, দুনিয়ার সুন্দর সুন্দর জায়গার বর্ণনা দিয়ে খামাখা মানুষজনের হিংসার কারন হয়ে লাভ কি? বরং মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক। উলুয়াটু যাবার পথে লুয়াক কফির বাগানে ঢুঁ মারলাম। কফি বানানোর পদ্ধতি বলতে বলতে বাগানের কেয়ারটেকার আমাদের নিয়ে গেল তাদের হাতেকলমে তৈরি কফি টেস্ট করানোর জন্য। ছোট ছোট কাপে সাত-আট রকমের চা-কফি দেওয়া হল আমাদের সামনে। এককটা একেক স্বাদের। কোনটা ভ্যানিলা কফি, কোনটা ডার্ক চকলেট কফি কোনটা আবার সাধারণ আদা চা। প্রায় সবগুলোই খেয়ে দেখলাম। বাঙালী ফ্রিতে আলকাতরাও খায় আর সেটাতো কফি। ভালোই ছিল। পছন্দের একটার অর্ডারও দিলাম। আসল কফি কিন্তু আমাদের দেওয়া হয়নি। কারন সেটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কফি। বাংলাদেশী টাকায় এককাপ কফির দাম কমবেশি পাঁচ হাজার টাকা। এই কফির জন্মস্থান বিধায় এখানে একটু দাম কম। এটা কিনে খেতে হবে। মাথা খারাপ নাকি! এই কফিটার নাম কপি লুয়াক ( copy luwak)। এটা সাধারন কফি বীজ থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আসে না। এটা আসে সিভেট নামের বিড়ালসদৃশ প্রানীর হাগু থেকে। সিভেটকে সবচেয়ে দামী,পাকা আর সুন্দর কফি চেরী খেতে দেয়া হয়। কফি বীজ হজম করতে পারে না এই প্রাণীটা। মলের সাথে বের করে দেয়। এগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধুয়ে,পরে কপি লুয়াক পাওয়া যায়। অর্থাৎ অনেক মানুষের সকালের সেরা কফি আসে বিড়ালের হাগু থেকে। ওয়াক থু!
২. নাম সমাচার
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকে শেক্সপিয়ার বলেছেন, "What's in a name? গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক সে সুগন্ধ ছড়াবেই।" নাম দিয়ে যায়না চেনা ব্যাপারটা অনেকক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বালির লোকেদের জন্য পুরোপুরি সঠিক হবে না। মানুষের নামকরনের ক্ষেত্রে বালিনীজরা দারুণ এক রীতি পালন করে। যখন সারা দুনিয়া বাচ্চাদের ইউনিক নাম রাখা নিয়ে গবেষণা, পরিকল্পনার শেষ দেখে ছাড়ছে, সেখানে বালির লোকেরা শিশুদের নাম নিয়ে একেবারেই নিরুদ্বিগ্ন। তারা জন্মের আগে থেকেই জানে তাদের পরবর্তি শিশুর নাম কি হতে যাচ্ছে। অদ্ভূত লাগছে তো?
আসলে বালির বেশিরভাগ মানুষের নাম (অথবা নামের প্রথমাংশ) চারটা নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর সেগুলো রাখা হয় তাদের জম্মের ক্রমানুসারে। বাবা মার প্রথম শিশুর নাম wayan, আমাদের বড়ছেলে অপূর্ব ইন্দোনেশিয়ায় জন্মালে নাম হতো wayan অপূর্ব বা শুধু wayan। দ্বিতীয় জনের নাম মেড, তৃতীয় জনের নাম নুমান আর ছোট জনের নাম হয় কেটুট(ketut)। চারের পরেও আরো শিশু জন্মালে তার ব্যবস্থা আছে। জন্মের সাইকেল অনুযায়ী সেই নামকরন চলতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো নামকরনের এই সূত্র মেয়েদের জন্যও প্রযোজ্য।
বালিতে আমাদের যে দুজন ড্রাইভার (কাম গাইড) ছিল তাদের একজন ছিল Wayan Philip আরেক জন Mr. Numan। Wayan সাহেব বেশ ভাল মানুষ। বড় ছেলেদের মতই বেশ দায়িত্বশীল আর ভদ্র!
৩. টাকা সমাচার
২০০৭-০৮ সালের দিকে জিম্বাবুয়ের মুদ্রার মান এতই নেমে গিয়েছিল যে, সেখানে ব্যাগ ভর্তি ডলারের বান্ডিল নিয়ে গেলেও পকেটভর্তি বাজার আনা কঠিন ছিল। এক ব্যাগ টাকার বান্ডিল দিয়ে বড়জোর একটা রুটি কিংবা এক লিটার দুধ পাওয়া যেত। তিনটি ডিম কিনতে লাগত ১০০ বিলিয়ন জিম্বাবুয়ে ডলার। টাকার বান্ডিল শিশুদের খেলার সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার হতো। টাকার এ বেহাল অবস্থা দেখে জিম্বাবুয়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০০ বিলিয়ন ডলারের নোট বাজারে ছাড়ে। সাধারণত যুদ্ধাবস্থা বা দেশীয় অর্থনীতির চরম খারাপ অবস্থায় এরকম মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীতেও এরকম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। জিম্বাবুয়ের অবস্থা কিছুটা উপলব্ধি করলাম ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গিয়ে। বেশ ফাপড়ে পড়তে হয়েছিল টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে। সেখানে মুদ্রাস্ফীতি বা অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ যে তা না। এদের টাকার (ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়াহ) মান এমনিতেই অনেক কম। গত শতাব্দির শেষভাগে রপ্তানী বাড়াতে অথবা রাজনৈতিক দুরাবস্থার কারণে কেন্দ্রিয় ব্যাংক কয়েকবার রুপিয়ার অবমূল্যায়ন করতে (মান কমাতে) বাধ্য হয় । এছাড়া প্রোডাকশনের তুলনায় এখানে কনজাম্পশন বেশি হবার কারণে বছর কয়েক আগে বড়সড় কয়েকটা মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। বালিতে তাই পকেটভর্তি টাকা নিয়ে গিয়েও প্লেট ভর্তি খাবার পেতে বেগ পেতে হয়েছে আমাদের। দু'জন মানুষের এক দিনের খরচ মোটামুটি ১৫/২০ লাখ রুপিয়াহ এর মতো:-
সকাল+দুপুর+রাতের খাবার ৪ লাখ রুপিয়াহ
কফি ৪০ হাজার রুপিয়াহ
কোক ৫০০ এম এল ১৫ হাজার
ট্যাক্সি সারাদিন ৪ লাখ রুপিয়াহ (৪/৫ জন জনের জন্যও একই।)
টুরিস্ট স্পটে এন্ট্রি ফি ২ লাখ
হোটেল এক রাত ৫ লাখ
অন্যান্য ১ লাখ রুপিয়াহ
সর্বমোট ১৬ লাখ ৫৫ হাজার রুপিয়াহ।
ওখানে মাটির উপর দিয়ে হাঁটতে টাকাপয়সা লাগে না। কিন্তু পানির নীচে অর্থাৎ সাগরতলে ২০ মিনিট ঘোরাঘুরির জন্য আপনার খরচ পড়বে ১০ লাখ রুপিয়াহ। তবে রিস্ক নিয়ে টাকার চিন্তা ভুলে একবার যদি পানির নিচে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন, সেক্ষেত্রে আপনার জীবন বীমা করা হবে ১০ কোটি রুপিয়াতে। জীবনের এত দাম! দেখে বেশ খুশি হয়েছিলাম। দেশে কেউ জীবনের দাম না দিক, বিদেশিরা অন্ততঃ আমার দামটা বুঝেছে। ওদিকে আমার বউও বেশ খুশি। আমার কিছু একটা হলে কোটিপতি হয়ে যাবে সে। আমার জীবদ্দশায় তো আর কখনো সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি! যাই হোক, সাগরতলে নামার উত্তেজনায় ওদের ১০ কোটি আসলে কত টাকা জানা হয়নি। ভাগ্যিস হিসাবটা আগে করিনি। তখন জেনে গেলে এত সস্তা জীবন নিয়ে পানির নিচেই ডুবে মরতে ইচ্ছে করত!
পরিশিষ্টঃ ১০০ ডলার ভাংতি করে ১৩ লাখ ৩০ হাজার রুপিয়া পেয়েছিলাম। আমাদের ১০০ টাকা ওদের ১৭ হাজার টাকার সমান। ওদের এক লাখ রুপিয়ার নোট আর এক হাজার টাকার কয়েনও আছে। এখানে অন্ততঃ ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন কেউ দেখেনা। কারণ কোটি টাকার স্বপ্ন দেখলেও কম দেখা হয়ে যায়!
বি.দ্র. প্রথম দুইটা ছবি গুগল হতে প্রাপ্ত। এত সুন্দর ছবি তোলার ক্ষমতা নাই আমার। গরীব মানুষ তাই আর ডিএসএলআরও নাই আমার।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:১৩