somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ফিরে এলাম কোম্পানীগঞ্জের কমলার বাগান থেকে

০৪ ঠা মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাজের প্রয়োজনেই সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে একটা সময়। সিলেটের ১১ টি উপজেলার প্রায় সবক’টিতে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আজ শোনাবো আপনাদেরকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাংলাদেশের তিনটি কমলার বাগান ভারতীয় ভূ-খণ্ডের ভেতর দিয়ে হেঁটে ঘুরে আসার এক রোমহর্ষক কাহিনী। শুরুতেই জানিয়ে রাখছি, যেভাবে আমি ওখানটাতে গিয়েছি, আশা করছি আপনারা কখনই ওইভাবে যাবেন না। যাবার বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্য একটা আছে। সেটা আমি পরবর্তীতে জানাচ্ছি।

৬ সেপ্টেম্বরর, ২০১০, সোমবার, সকাল ৯ টা। সিলেট শহর থেকে কোম্পানীগঞ্জ যাবার জন্য সি.এন.জি স্টেশনে গেলাম আমি এবং দীপন দা’। দীপন দা’ আমার কলিগ, সিলেট শহরেই বাড়ি। চমৎকার একজন মানুষ।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাতে যাবার জন্য জনপ্রতি ৫০ টাকা করে সি.এন.জি.-তে যাওয়াই ভালো। বাসেও যাওয়া যায়। তবে রাস্তা ভয়ংকর খারাপ ছিল সেই সময়। মাসখানেক আগে আরেকবার গিয়েছিলাম। দেখলাম, রাস্তার কাজ চলছে।

সকাল ১১.৩০ এর দিকে আমরা কোম্পানীগঞ্জ থানা বাজার পার হয়ে পৌঁছালাম টুকের বাজারে। এরপর আর সি.এন.জি যাবেনা। অগত্যা ভারতীয় বর্ডারের আগ পর্যন্ত যে ঘাট আছে, সেখানে যাবার জন্য রিক্সা নিলাম। চরম খারাপ রাস্তা। পথের দু'পাশে পাথর ভাঙার মেশিনের শব্দতে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। রিক্সার ঝাঁকুনি খেতে খেতে ঘাট পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম আমরা। ঘাটে যে লোকগুলো নৌকাতো পাথর তুলছে, তাদের একজনকে অনুরোধ করলাম আমাদেরকে ওপারে পৌঁছে দিতে।
নৌকা করে নদী পার হচ্ছি আমরা

ওপারটায় ভোলাগঞ্জ। এখান থেকে ট্রলার নিলাম দয়ার বাজার পর্যন্ত। প্রসঙ্গত: জানিয়ে রাখছি, কোম্পানীগঞ্জ থানা বাজার থেকে দয়ার বাজার পর্যন্ত সরাসরি সি.এন.জি -তেও যাওয়া যায়, রিজার্ভ সি.এন.জি ভাড়া পড়বে ২০০-৩০০ টাকা। আমরা ভোলাগঞ্জ হয়ে একটু ঘুরে দয়ার বাজার গিয়েছিলাম পাহাড় আর নদীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে। দয়ার বাজার থেকে রিক্সা নিলাম উতমা পর্যন্ত। এখানেই সেই কমলার বাগান।
ভোলাগঞ্জের পথে আমরা

যাবার পথের সৌন্দর্য

জলক্রীড়ারত দুই শিশু

এ পথেই ভোলাগঞ্জ যেতে হবে

রিক্সাওয়ালা মজিদ ড্রাইভার আমাদেরকে গ্রামের একটা মেঠোপথের শেষ সীমানায় নামিয়ে দিল। এখান থেকে হেঁটে গ্রামের ভিতরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পিলার পর্যন্ত চলে এলাম আমরা। একটু থমকে দাঁড়ালাম। কারণ যে বাগানগুলোতে আমরা যাব, সেগুলো বাংলাদেশের অংশ হলেও একটা পাহাড়ী নদী দিয়ে পৃথক করা আছে বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে। আমরা এখন বাংলাদেশের যে অংশে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে বাগানে যেতে হলে গলা সমান পানির সেই পাহাড়ী নদীটি পাড় হতে হবে। নদীর স্রোত অনেক বেশি, আর কোন নৌকাও নেই। চিন্তা করে দেখলাম, এভাবে সঙ্গে থাকা ব্যাকপ্যাকের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে গলা পানি পার হয়ে ওপারে যাওয়া সম্ভব নয়।

পাহাড়ের গায়ে ঝর্ণা

আরেকটা উপায় অবশ্য আছে। সেটা হলো, সীমান্ত পিলার পার হয়ে ভারতীয় অংশের ওপর দিয়ে প্রায় হাফ কিলোমিটার হেঁটে তারপর নদী পার হয়ে কমলার বাগানে ওঠা। ভারতীয় অংশে সেই একই নদীর গভীরতা হাঁটু পানি পর্যন্ত। রিক্সওয়ালা মজিদ দেখলাম ভারতের ভেতরে ঢুকে আমাদেরকে ডাকাডাকি করছে, যেন তার সাথে ওই পথে হেঁটে রওনা দেই আমরা। স্থানীয়দের দু’এক জনের সাথে কথা হলো। তারা কেউ বললো, মজিদের সাথে হেঁটে আমরা রওনা দিতে পারি, কোন সমস্যা নাই। আবার কেউ জানালো, বি.এস.এফ দেখলে খবর আছে আমাদের।

বড়ই দুশ্চিন্তায় পড়লাম আমরা। দীপন দা’ আমার দিকে তাকালেন। কি করবো, বুঝতে পারছিনা। এভাবে ভারতের ভেতরে অবৈধভাবে ঢুকে পড়াটা খুবই বিপজ্জনক। একবার বি.এস.এফ-এর চোখে পড়ে গেলে তিনটা ঘটনা ঘটতে পারে - এক. গুলি করে আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারে, দুই. ধরে নিয়ে ভারতের জেলে ভরতে পারে, আর তিন. সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র সব রেখে দিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে দিতে পারে। তবে প্রথমটার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে। কি করবো, বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে এত কাছে এসে কমলার বাগান না দেখে চলে যাব, এটাও মেনে নিতে পারছিলামনা।

হঠাৎ দেখি দু’জন বি.এস.এফ সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি টহল দিচ্ছে। কাছাকাছি আসার পর সাহস করে আমি একটু এগুলাম কথা বলার জন্যে। তাদের একজনের সাথে কথা হলো। নেম প্লেটে লেখা দেখলাম ’যশোবন্ত সিং’। তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে মনের ইচ্ছার কথাটা জানালাম। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে বললো, ”ঠিক হ্যায়, আপলোগ যা সাকতে, লেকিন দের মাত কিজিয়ে” অর্থাৎ আমরা যেতে পারি, কিন্তু যেন দেরী না করি। যশোবন্ত সিং ভাইকে আশ্বস্ত করলাম যে, শুধু বাগান দেখেই তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।

তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে, দোয়া-দূরূদ পড়ে আমি আর দীপন দা’ ভারতের ভেতরে পা রাখলাম। কিছুদূর যাবার পরেই স্থানীয় ভারতীয় এক বাজারে বসে চা খেলাম। চা-ও দেখি ঠিক মতন গলা দিয়ে নামেনা। কারণ ভেতরে ভেতরে চাপা একটা টেনশন কাজ করছে। কোনমতে চা শেষ করেই হাঁটা শুরু করলাম। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ পার হয়ে অবশেষে সেই নদীর কাছে এলাম। হাঁটু পানির নদী পার হয়ে বাংলাদেশের অংশে ওঠার পর হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। টেনশন কিছুটা কমলো আমাদের। তারপর অল্প কিছু দূর হেঁটেই পৌঁছে গেলাম কমলার বাগানে। কমলার সুবিশাল বাগান আসলে এখানে তিনটি। এগুলোর মালিকের নাম আনসার সাহেব। এখানে একটা খাসিয়া পরিবার থাকে। তারাই এগুলোর দেখাশোনা করে। আমরা যে সময়টিতে গিয়েছিলাম, তখন কমলার সিজন ছিলনা। কিন্তু এত বড় কমলা গাছের বাগান দেখে মুগ্ধ হলাম। সত্যি বলতে কি, ফিরে আসা নিয়ে এত বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে, সৌন্দর্য উপভোগের থেকে নিরাপদে ফিরে যাবার চিন্তাটাই মাথায় বেশি কাজ করছিল। কারণ ফিরতে হবে আবার সেই ভারতীয় অংশ দিয়েই, অর্থাৎ যে পথে একটু আগেই এসেছি। এত বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছিল যে, ছবিও বেশি তুলতে পারিনি।

ফেরার পথে টেনশনটা চরমে পৌঁছালো। পথ যেন আর শেষই হয়না। একটা ঝোপ পার হয়ে সীমান্ত সেই পিলারের কাছাকাছি আসতেই দেখি, প্রায় ৬-৭ জন ভারতীয় বি.এস.এফ পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। যাবার সময় দেখলাম ২ জন বি.এস.এফ, এখন ৬-৭ জন কোথা থেকে কেন এল, কিছুই তো বুঝতে পারছিনা! আমাদেরকে দেখতে পেয়েই রাইফেল হাতে দুই জন এগিয়ে এলো। তারা আমাকে আর দীপনদা’ কে হিন্দী ভাষায় চোখ মুখ শক্ত করে আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলো।
আমার মনে হলো, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। অনুভব করলাম, দীপন দা’ আমার ডান হাতটা ধরে ঠকঠক করে কাঁপছেন। আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। মনে মনে আল্লাহপাক কে ডাকলাম। জীবন-মৃত্যুর এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমি।

পিছনের ওই নদীটা পার হয়ে দীপন দা' মাত্রই বাংলাদেশ অংশে উঠলেন

নদীর ওপারের সবটুকুই ভারতের

কমলার বাগানে দীপন দা'

কমলার বাগানের একাংশ

কমলার বাগানের একাংশ

বিপদের সময় আমার মাথা কাজ করে ভালো। এটার প্রমাণ আরেকবার পেলাম। আমি খুব ভাল করেই জানি যে, পাগলা কুকুর এবং ভারতীয় বি.এস.এফ - এই দুই প্রজাতির প্রাণীর সামনে ঘাবড়ে যেতে নেই। তাই 'মারাত্মক ভয় পেয়েছি' -এটা একেবারেই বুঝতে না দিয়ে এগিয়ে আসা সেই বি.এস.এফ দের কে খুব স্মার্টলি নিজেদের পরিচয় এবং আসার উদ্দেশ্য বললাম। কিন্তু এই বিপদের মুহুর্তে আমার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই যশোবন্ত সিং কে। হঠাৎ দেখি একটা ঝোপের ভেতর থেকে প্রাকৃতিক কাজ শেষে প্যান্টের জীপার লাগাতে লাগাতে তিনি বের হয়ে এলেন। নিজের সহকর্মীদের জানালেন যে, তিনিই আমাদেরকে অনুমতি দিয়েছিলেন ভারতের ভেতরে ঢোকার। তারপর হাসি মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন ঘোরা হলো। আমি একটা মলিন হাসি দিয়ে বললাম, ’ভাল’।

এরপর বিদায় নিলাম যশোবন্ত সিং আর তার সঙ্গে থাকা বি.এস.এফ দের থেকে। দূরু দূরু বুকে পা চালিয়ে সীমান্ত পিলার পার হয়ে ঢুকলাম বাংলাদেশের মাটিতে। আহ্! কি শান্তি‍! কি আনন্দ! সীমাহীন আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এলো। পিছনে তাকিয়ে দেখি, দীপন দা’ জ্ঞান হারিয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১১ রাত ৮:৩৫
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×