এক সময়ের প্রখ্যাত ব্লগার ধানসিঁড়ির কথা মনে পড়ে। নিজের নিকে অনেকদিন হলো তিনি আর আসেন না। খুবই অমায়িক লোক ছিলেন, সবার সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণে তার জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তিনি সবসময়ই তার ব্যস্ততা এবং সচেতনতনা দেখিয়েছেন। এইডস এর মত ব্যধির বিরুদ্ধে তার প্রচারণা কিংবদন্তিতুল্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে ভেবেছেন এবং আমাদের এখন যে অতীত নিয়ে মেতে না থেকে ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে হবে এ তত্ত্বের তিনিই বোধহয় সামহোয়্যারইন ব্লগের প্রবর্তক। তার ভাষায়,
"কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার, কে সত্যের সৈনিক, কে অসুরের দোসর তা সঠিক ভাবে নিরুপনের সময় আমার মনে হয় আমরা পার করে এসেছি। এখন আমরা এ নিয়ে যতই গবেষণা করিনা কেন সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। একজন মানুষ কেবল মাত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলেই সকল সুযোগ -সুবিধা পাবে, ধরাছোঁয়ার উর্ধে থাকবে, আর একজন মানুষ রাজাকারের সন্তান হওয়ার পরও সে যদি এদেশের প্রতি অনুগত হয়, এদেশকে তার নিজের দেশ মনে করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে তবুও তাকে দূরে ঠেলে দেব, তা আমার কাছে সামপ্রদায়িকতা বলেই মনে হয়।"
সম্ভবত রাজাকার শব্দটির ওপরেও তিনি খুব ঘৃণা পোষণ করতেন। নব্য রাজাকার রুখতে তাই তার অমোঘ বাণী,
"বাংলার সন্তানেরা, এক হও, রুখে দাড়াও শত্রুর বিরুদ্ধে, দেশের বেইমানদের বিরুদ্ধে। রুখে দাড়াও নব্য রাজাকারদের বিরুদ্ধে। "
কয়েকমাস পরেই অবশ্য তিনি 'আলোকিত নেতা' মওদুদীকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে পোস্টান, আমরাও জানি এইডসের প্রচারণা জামাতি এনজিওর প্রচারণা মাত্র এবং লোকমুখে শোনা যায়, তিনি জামাতের একজন ভালো লেভেলের নেতা। এভাবেই আমরা সাধারণ ব্লগাররা একজন জামাতি বুদ্ধিজীবির কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি।
সময় এগিয়ে যায়, ব্লগে তবুও সেই একই টেমপ্লেটে জামাতি রাজনীতি চলতে থাকে। অধুনা একজন পিএইচডি সুশীলের আগমন ঘটেছে, যিনি স্বাধীনতা নিয়ে পোস্টান আর চিহ্নিত জামাতি পেইড ব্লগাররা তাকে সানন্দে ৫ দিয়ে যায়। তিনি খুবই আশাবাদী মানুষ। স্বাধীনতাবিরোধিদেরকে বুঝিয়েশুনিয়ে তিনি স্বাধীনতার সপক্ষে আনতে পারবেন বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি সুশীল মানুষ, গালিগালাজ একদমই সহ্য করতে পারেন না। তাই যেসব মানুষের কাছে ৭১ এখনও ৩৬ বছরের পুরানো ইতিহাস নয়, স্বাধীনতা বিরোধীদের হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনের স্মৃতি যাদের কাছে এখনও জ্বলজ্বলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী প্রচারককে কটু কথা বললে জনাব পিএইচডি হায় হায় করে ওঠেন। ওহে তোমরা করছোটা কি! এভাবে গালি দিলে চলবে। ওদেরকে আদর করে বুঝিয়ে বলো!
জনাব সুশীল অবশ্য স্বাধীনতার দলিল হিসেবে যা দেন, তা প্রায় সবই কাস্টুপেস্টু, নিজের তেমন কোনো বক্তব্য নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীনতা বিরোধীদের সম্পর্কে তার বক্তব্য একেবারেই ধোঁয়াশা। তার মহান মতবাদ অনুসারে,
"জামাত-শিবিরের মতাদর্শধারী আর যুদ্ধাপরাধী কিন্ত এক জিনিস নয়। "
মহান সার্টিফিকেটধারী পিএইচডি সুশীলটির অবশ্য না জানার কথা নয় যে, জামাত ব্যক্তিহিসেবে নয়, দল হিসেবেই স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষে ছিলো। এ বিষয়ে রেফারেন্স চাওয়ার মত নির্বোধ তিনি নন, তবে নির্বোধের ভূমিকায় অভিনয় করাটাও এক ধরনের পারদর্শিতার ব্যাপার, যা তার আছে বলেই জানি। অতএব, জামাতিদের মহান নেতা গোলাম আযমের 'যে পাতে খাই, সেই পাতে হাগি'টাইপ আত্মজীবনীতে দেখি তিনি কি বলেন,
"আমরা সবদিক বিবেচনা করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হলাম, তা হলো: এ দেশ আমাদের জন্মভূমি। আল্লাহই আমাদেরকে এদেশে পয়দা করেছেন। আমরা দেশ ছেড়ে কোথায় যাবো? আমাদেরকে এখানেই বাঁচতে হবে, এখানেই মরতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র কায়েমের আন্দোলনে শরীক হতে আমাদের ঈমান আমাদেরকে অনুমতি দেয় না।"
বাংলার মানুষকে যখন পাকিসৈন্যরা পাখির মত গুলি করে মারে, তখন জামাতি নেতারা রেডিওতে 'ভারতের' ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার ঈমানী ডাক দেন। পাকি সামরিক জান্তার সঙ্গে বৈঠক করেন, দলীয় কর্মপরিষদে পাকিস্তান সফর করেন। যে দলের আদর্শই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে সেদলের মতাদর্শ আর যুদ্ধাপরাধী নাকি এক জিনিস নয়। আমরা মূর্খ মানুষ! জনাব পিএইচডি সুশীল স্বাধীনতার চেতনার মানুষের কাছ থেকে আমাদেরকে শিখতে হয়!
জনাব পিএইচডি আল-বদর চিনেন না, এমনটা হবার কথা নয়। তার আরও জানার কথা ৭১এ আল-বদরের ভূমিকা। তারপরেও আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেই, দৈনিক সংগ্রামে মুজাহিদের বিবৃতি, "The youths of the Razakars and al-Badar forces and all other voluntary organizations have been working for the national to protect it from the collaborators and agents of India."
জনাব পড়ুয়া সুশীল আরও অবশ্যই জানেন, কামরুজ্জামান ছিলো আল-বদরের সংগঠক। জনাব কামরুজ্জামানের ছেলেমেয়েরা সামহোয়্যারিনে ব্লগায়। জনাব সুশীল তাদেরকে না চেনার কথা নয়। তারা জনাব পিএইচডির স্বাধীনতার দলিলের পোস্টে ৫ দিয়ে যায়, জনাব সুশীল আনন্দে গদগদ হয়ে জামাত থেকে'যুদ্ধাপরাধী' দূর করার মৃদু পরামর্শসহ ধন্যবাদ দেন। জনাব সুশীল কি জানেন না কাকে কি বলছেন? জানেন, খুব ভালো করেই জানার কথা তার! তাই তো বাবার আদর্শধারী যুদ্ধাপরাধীর ছেলেকেই যুদ্ধাপরাধী ছাঁকনির সুমহান দায়িত্ব দেন।
যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গে জনাব সুশীলের উপসংহার হয় গুল্লি বক্তব্য দিয়ে, ""আলজেরিয়া, সুদান, রুয়ান্ডা বা ইথিওপিয়াতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। যদিও এসব দেশে ঘৃণ্যতম যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিচার হয়েছে ইউরোপে।" এখন আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা কাদেরকে উদাহরন হিসাবে বেছে নবো "
বাংলাদেশ তো ইউরোপ নয়, আলজেরিয়া সুদানের মত বা আরো অনুন্নত। অতএব, ইউরোপ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা যুদ্ধাপরাধী নিয়ে মাথা ঘামাই কেন!
জনাব পিএইচডি আবার খুব ইসলামিক মানুষ। তার ধর্মানুভূতিও সেইরকম সেন্সিটিভ! অবশ্য একজন সার্টিফিকেটধারী পড়ুয়ার জানার কথা, কি করলে ইসলামের অবমাননা হয় আর কি করলে নয়। উহু, ও কথা তাকে বলতে যাবেন না। ইসলাম যতোই বলুক, নাস্তিকদের কথায় কিছু আসে যায় না, কেউ ভন্ড হাদিস শুনালেই তার ধর্মানুভূতি ব্যথায় জরোজরো হয়ে যায়!
ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে তিনি একজন সুশীল নিরপেক্ষ মানুষ। যেমন ধরেন, জামাতের ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে তার কোনো মতামত নেই, জনগণের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন, জনগণ জামাতকে গ্রহণ করলে করুক, বর্জন করলে করুক! এতে অবশ্য তার স্বাধীনতার চেতনায় কিছু যায় আসে না। তিনি তো আগেই বলেছেন, জামাত আর যুদ্ধাপরাধী এক জিনিস নয়, যতোই জামাত দলগতভাবেই স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করুক না কেন!
আমরা দেখে যাই। জামাতি বুদ্ধিজীবি খেলারামেরা খেলে যান। অবশ্য টেমপ্লেট তেমন একটা পালটাতে পারেন না। আমরা প্রান্তিক জনগণ। মহান নেতা আলী-আহসান মুজাহিদের জীবনী নিয়ে তিনি তার কোন নিকে কবে পোস্টাবেন, শুধু সেই অপেক্ষায়ই থাকি।