somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাদাকালো স্ন্যাপশট...

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১... অপেক্ষা
ফুটপাথটা ফার্মগেটের বড় ফুটওভার ব্র্রীজ ঘেষে কাওরান বাজারের দিকে চলে গেছে। খয়েরি আর ধূসর পেভমেন্ট ব্লকের ফুটপাথ। জায়গায়-জায়গায় ব্লকগুলোর জ্যামিতিক সরলতায় ছেদ আছে। একপাশ দিয়ে খোলা গভীর ড্রেন, আরেকপাশে চওড়া পিচের রাস্তা। মাথার ওপরে কালো রঙের হরেক-রকম তারের জটিল নকশা নিচের ড্রেনের সমান্তরালে বয়ে গেছে।

সময়টা ভোরের ভাঁজ খোলা পর্ব। সামনের ব্যাস্ত রাস্তাটা এখনো আলসে আমেজে আছে।

ফুটপাথ ঘেষা তেঁজগা গার্লস স্কুলের সামনে একসারি মানুষ বসা। কারো কারো সামনে কোদাল, টুকরি। একনজরেই বলে দেওয়া যায়, দিনমজুর।
বিভিন্ন বয়েসের মানুষগুলো সামনে পড়ে থাকা পুরো দিনটির জন্য বিকিয়ে যাবার অপেক্ষায়, জুবুথুবু হয়ে বসে আছে।
এদের মধ্যে একজন, ফরিদপুরের তালেব মৃধা। ভদ্র সমাজের হলে আমরা জনাব তালেব মৃধা বলতে পারতাম।
দিনমজুরেরা ভদ্র সমাজের মধ্যে পড়ে না।

২... তন্দ্রাবিলাস
ছয় বছর বয়সি ছবিকে আরো কম বয়সের মনে হয়। অন্তত ভোরের মায়াময় আলোয় পান্হপথের ফুটপাথে চট জড়িয়ে দ-হয়ে শুয়ে থাকা ছবিকে দেখে তাই মনে হয়।
ঘুমুলে এমনিতেই সবার ভেতরের বাচ্চার ছায়াটা দেখা যায়। আর বাচ্চাদের তো আরো দেবশিশু মনে হয়। এমনকি পান্হপথ সিগন্যাল থেকে বসুন্ধরা সিটির দিকে যাওয়া ফুটপাথে, দেয়াল ঘেঁষে পাকুড় গাছের নিচে শুয়ে থাকা ছবিকেও মনে হচ্ছে, কোন মহান ভাস্করের তৈরি করা খুব মায়াময় কোন মূর্তি।
কিছু দুরের উপচে পড়া ডাস্টবিন আর মাথার ওপরের কাকের কোরাসও দৃশ্যটাতে কোন ছন্দপতন ঘটাতে পারছে না।
আড়মোড়া করে উঠতেই ছবির গায়ের চটটা সরে যায়।
একটু দূরে কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কালচে-সাদায় মেশানো কুকুরটার নজর এড়ায়না দৃশ্যপটের এই পরিবর্তন। আস্তে করে উঠে এসে বাচ্চাটার ঘাড়ের কাছে নিজের ঠান্ডা ভেজা নাক ঠেকায় কুকুরটা। ...সম্ভবত আদর করার, বা আদর পাবার ইচ্ছে থেকে।
স্পর্শের পরিবর্তনে ঘুমন্ত ছবির মুখে আলতো হাসির একটা আভা ফুটে ওঠে। হয়ত বাস্তবের এই কুৎসিত স্নেহের স্পর্শ তন্দ্রাজগতে আদরের কোন মায়াময় দৃশ্যে হয়ে গেছে।

আহারে... ভোরের আলোতে এই আপাত জঘণ্য দৃশ্যটাই কত মায়াকাড়া লাগছে।

৩... আরো একবার হেরে যাওয়া
তালেবের আজকের দিনটি বিক্রি হয়নি। হয়নি আরো বেশ কয়েকজনেরই। কারণ যারা দিন হিসাবে মানুষ কিনে নেন, তাদের কাছে তাগড়া জোয়ানই বেশি পছন্দ। সম্ভবত এই একটা জায়গাতেই পতিতা আর দিনমজুরের ক্রেতাদের মিল আছে।
তালেবের বয়স খুব বেশি না, কিন্তু এটুকু ব্যাপ্তিতেই ইতিমধ্যে জীবণের ঘায়ে যথেষ্টই ক্লান্ত তালেব।
অবিক্রিত মানুষগুলো একজোট হয়ে সিদ্ধান্তে আসে দিনটা কাওরান বাজারের সবজির আড়তে কামলা দিয়ে কাটাবে। রোজগার তুলনা করলে দিনমজুরের কাজের থেকে যথেষ্টই কম, কিন্তু বেকার থাকা থেকে যথেষ্টই লোভনীয়।

৪... এলামেলা দিন
ছবির দিন শুরু হয় সোনারগাঁ হোটেলের পেছন থেকে গোলাপ সংগ্রহ করে। না, ওখানে কোন বাগান বা ক্ষেত নেই। সময়টাও রূপকথার না, যেখানে কাননে কুসুম কলি ছবিদের জন্য ফুটে থাকে। শাহবাগের দোকানের বাসি ফুলগুলো এখানে আসে, ট্রাফিক সিগন্যালে বিক্রি হতে। যেখানে মানুষকে সহজেই বাসি ফুল গছানো যায়।
দিনটা খালি পেটে শুরু হলেও, প্রথম বিক্রি হওয়া ফুলের তোড়ার দশ টাকা থেকে তিন টাকা সকালের নাস্তার জন্য বরাদ্দ। মহাজনের সব কঠিন হিসাব। সারাদিনের বাকী সব বিক্রির টাকা থেকে কড়ায়-গন্ডায় আদায়ের পর খুব ছোট্র একটা কমিশন ছবির জন্য।
একশ টাকায় আট টাকা হিসাবে।

কড়া রোদ, গাড়ির কর্কশ হর্ন, রোদে তেতে ওঠা কালো পিচে খালি পা, গোলাপি মলিন ফ্রক, একটা টোস্ট আর আধ কাপ চা, ছয় বছরের ছোট্র হাতে কয়েকটা লাল টকটকে গোলাপের তোড়া, চপল পায়ে সিগন্যালে থেমে থাকা গাড়িগুলোর জানালার পাশে বসা চমৎকার সাজের মানুষগুলোর কাছে যাওয়া, শহরের ঝাঁ-ঝাঁ ঝিম ধরানো দুপুরে থেমে থাকা গাড়িগুলোর মাঝে ঝোলা হাতে একপেয়ে বাঁশিওয়ালা, সিনেমার কোন চটুল গানের সুরে বাজানো সুর.... এসব মিলে আরেকটা এলোমেলো দিন, আস্তে আস্তে বয়ে যায়।

৫... আকাশের নিচের আকাশ
শহরের সন্ধ্যাটা হুট করেই নামে। ফুটপাথের সোডিয়াম লাইট, গাড়িগুলোতে দানবের জ্বলে থাকা জোড়া চোখ, অনেক উচুঁ বিল্ডিংয়ের মাথার লাল বিকন আলো, ঘরে ফেরার নাগরিক ব্যস্ততা... সবকিছু নিয়ে সময় একটা নতুন দৃশ্য তৈরি করে।
এ দৃশ্যে... ক্লান্ত হয়ে তালেব ঘরে ফেরার চেষ্টা করে। ছবি একটা মাটির গর্তের পাশে তিনটা ইট দিয়ে টুকরো কাগজ যোগাড় করার চেষ্টা করে। আর কুকুরটা সারাদিন শেষে তার এই শহরের আপনজন ছবি আর তালেবের ফেরার আনন্দে মত্ত থাকে।

চাল কেনার পরেই সব্জির আড়তে কামলা দেওয়ার পয়সাটা প্রায় ফুরিয়েই যায়। কিছুটা জমা করতে হয় মাথার ওপরে একটা চাল যোগার করার ধান্দা করার জন্যে। আর ছবির সারাদিনের সামান্য রোজগার ফুরোয় কাঠাল বাগান ঢালের ফুটপাথ থেকে রান্নার আর কয়েকটা পদ কিনতেই।
চুলোটা যখন জ্বলে ওঠে তখন তিনটি প্রাণীই খুব আগ্রহের সাথে আগুন ঘিরে বসে। ...সম্ভবত আগামীকাল সন্ধার আগে এটাই শেষ ভাত খাওয়া। যদি না কোন চমক ঘটে...। অবশ্য চমকগুলো বাস্তবে কোনদিনই ঘটে না।

রাতের শোয়ার আয়েজন ঘটে ফুটপাথ ফাঁকা হবার পর। আটটার মার্কেট বন্ধ করার নিয়মে অবশ্য একটা লাভ হয়েছে ফুটপাথটা দ্রুতই পাওয়া যায়। ঘুমানোর আগে ফুটপাথের ভাড়া বাবদ বাকি পয়সাটা দেবার পর তালেব এবং ছবি... ভোরের শুরুর মূহুর্তেই ফিরে যায়।
সোজা বাংলায় ...আবারো নিঃস্ব।

...বাপের বুকের খুব কাছে ঘেঁসে আসে ছবি। আরেক পাশে কুকুরটা।
পাকুড় গাছের পাতাগুলোর ফাক দিয়ে সোডিয়াম আলোর ছিটে ফোটা ঠিকরে আসছে। অন্ধকারে বেশ একটা আলোর আলো-ছায়া। পাশ দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। ...ঢাকার আকাশে তারাগুলো খুব স্পষ্ট দেখা যায় না। তাদের গ্রামের আসমানটা অনেক সুন্দর ছিল, ভাবে ছবি। কত বড় আর স্পষ্ট লাগত তারাগুলা। পাশে বাজানকে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে আবার কবে গেরামে ফিরবে তারা। ...নিঃশ্বাসের ভারী শব্দে ছবি বোঝে, তার ক্লান্ত বাপ অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।
ছবি তারা খোঁজে... পাশের বসুন্ধরা সিটির বিশাল টাওয়ারের দিকে নজর ফেরায়। ...এখানেও বেশ তারার মত মিটি মিটি আলো জ্বলে। ...তাহলে কি আসমানের নিচে আরেকটা আসমান এটা?
চারপাশে আকাশের নিচে অনেক আকাশ চোখে পড়ে ছবির। কিন্তু সবসময়ই তাদের ঠাঁই হয় উপরের বড় আকাশটার নিচেই।


পোস্টের ছবিটা আমার খুব প্রিয় একজন আলো ও লেন্সের শিল্পি Catch the dream এর ফ্লিকার পাতা থেকে নেওয়া।
http://flickr.com/photos/bacillus/870756276

আজাইড়া এবং অযথা ফেনায়িত আবজাবের জন্য ...দুস্কিত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১:৪৭
৩৩টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×