১.
ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে আমি হুট করে খুব একা হয়ে যাই। সূর্যাস্ত আমার প্রিয় সময় না। আমার সব না পাওয়া অথবা হেরে যাওয়ার গ্লানি গুলো এই সময় আমার উপর ভর করে। তাই ছুটির দিনের সন্ধাগুলো আমি খুব সচেতন ভাবে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি। তারপরও মাঝে মাঝে হুট করে এই সন্ধ্যার ফাঁদে পড়ে যাই।
আমি হচ্ছি আমজনতার একজন। আমাদের জীবনটা হচ্ছে দৈনিক পত্রিকার যে পাতায় ছোট ছোট শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপন ছাপে সেই পাতাটার মত। যেখানে রোজ রোজ সেই একই একঘেয়ে সাদাকালো বিজ্ঞাপনগুলোর মত ছকে বাধা ঘটনা ঘটে। আমাদের জীবনে কখনো আটকলামে লাল রংয়ের হেডিঙের কোন খবর থাকে না। দিনের পর দিন.. সেই একঘেয়ে গল্প।
২.
আমি মানুষ নিয়ে খুব আগ্রহী। হাতে সময় থাকলে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে মানুষ দেখি। মানুষগুলোর রঙ বোঝার চেষ্টা করি। আমার কাছে সবথেকে উজ্জ্বল রঙের মানুষগুলো হচ্ছে ছোট বাচ্চাগুলো। এরা কি আগ্রহ নিয়েই না চারপাশটা দেখে। সব কিছুর মধ্যেই এদের জন্য কোন না কোন আনন্দ লুকিয়ে থাকে। এরা কেউ উজ্জ্বল লাল, কেউ লেমন ইয়েলো আবার কেই উজ্জ্বল গোলাপি বা কমলা। প্রেমিক-প্রেমিকারা হচ্ছে নানা রঙয়ের। এক এক সময় এক এক রঙ। বয়স্ক মানুষগুলো প্রায় সবাই'ই ধুসর রঙের। বন্ধুত্বের রঙ হচ্ছে সবথেকে সুন্দর।
বাসে মাঝে মাঝে দলবাঁধা বন্ধুদের দল দেখতে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ সময়েই এদের হইচই বা কোন আচরণে সবাই খু্ব বিরক্ত হয়ে থাকে। কিন্তু আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখি। বন্ধুত্বের চমৎকার রঙটাকে।
গত সপ্তাহে বাসে ফেরার সময় মনভাল করে দেয়ার মত একটা ঘটনা দেখলাম। আমার সিট থেকে দুটো সিট সামনে, বাচ্চা কোলে এক ভদ্রলোক বসে ছিল। বাচ্চাটার বয়স সম্ভবত এক বছরেরও কম। ফর্সা.. লালচে চেহারা। খুবই মায়া মায়া দেখতে। বাচ্চাটা মানুষটার কাঁধের উপর কপাল রেখে ঘুমোচ্ছিল। তার ঠিক পেছনের সিটে একটা ডিজুস মার্কা ছেলে বসা। বাসের ঝাঁকিতে বাচ্চাটার মাথা সিটের পেছনে উঁচু হয়ে থাকা হেড-রেস্টের রডে যে কোন সময় লাগতে পারে। আর লাগলে ব্যথা পাবার সম্ভাবনা খুব ভাল। কারণ হুট-হাট ব্রেক করার কারণে বেশ জোরেই ঝাঁকি লাগছিল। এমন সময় পেছনের সিটের ছেলেটা সামনে ঝুঁকে তার হাত সেই রডটার উপর এমনভাবে রাখল যাতে করে বাচ্চাটার কপাল রডে না লেগে তার হাতের সাথে এসে থামে। এবং প্রায় এক ঘণ্টার পুরোটা পথ ছেলেটা সেভাবে বসে রইল যেভাবে বসাটা এই দীর্ঘ সময়ের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। তাদের পেছনের সিটে বসে এই খুবই সাধারণ একটা অসাধারণ ঘটনা আমি দেখলাম।
মাঝে কয়েকবার ছেলেটা লোকটাকে অনুরোধ করেছিল বাচ্চাটাকে সাবধানে কোলে নেওয়ার জন্য কিন্তু ভদ্রলোকের কোন বিকার ছিল না। বাসে মাঝে মাঝে খু্ব বাজে কিছু ঘটনা দেখতে হয়। এধরণের মনভাল করা ব্যাপার খুব বেশি ঘটে না। প্রতিদিন চারপাশের এত কুৎসিত সব ঘটনার পরও এরকম ছোট ছোট অসাধারণ সব ঘটনার জন্যই সম্ভবত আরেকটা ভোর আসে।
৩.
সুখে থাকা কি? অনেক বড় বড় আনন্দময় ঘটনা... নাকি জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলোর বুনোট? আমি বেশিরভাগ সময়েই খুব আনন্দে থাকি। কারণ আমি খুঁজে ছোট ছোট আনন্দগুলো বের করার চেষ্টা করি। অনেকদিন আগে পড়া কোন বইয়ের প্রিয় কোন পাতা। জমিয়ে রাখা চিঠিগুলোর কয়েক লাইন। প্রিয় কোন খাবারের সুঘ্রাণ। ভাল লাগার কোন রাস্তায় কয়েক মিনিট একলা হাটা। হুট করে দেয়া বন্ধুর সারপ্রাইজ। কফির তেতো স্বাদ।
খুব প্রিয় মানুষের অনেকদিন পরে পাওয়া কয়েক শব্দের একটা ই-মেইল আমার পুরো দিনটাকে রঙিন করে দেয়। তারপরও ...প্রায় সবসময়েই আমরা সফল আনন্দময় জীবন খোজার কাজে এই ছোট্ট জীবনটা অপচয় করছি।
৪.
আমার খুব কাছের এক বন্ধু আর সহকর্মী বিরাট টেনশনের মধ্যে আছে। বেচারা বিয়ে করছে। মানসিক দিক দিয়ে পুরা ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। বাবা মায়ের পছন্দে মেয়ে দেখা চলছে। কিন্তু ছেলের মেয়ে পছন্দ হলেও মেয়ের ছেলে পছন্দ হচ্ছেনা বা উল্টোটা ঘটছে। বেচারা অনেকগুলো বছর গোবেচারা হয়ে কাটিয়েছে। ভাল ছাত্র। ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পর ভাল চাকরি। কিন্তু কেন বিয়ে করতে চায় একথা জিজ্ঞাসা করলে অনেকক্ষণ ভাবার পর.. 'বাবা-মা চায় তাই' টাইপের উত্তর দিল। বিয়ে আমাদের বাংলাদেশিদের জীবনে একটা বিরাট ঘটনা। কেন এই ঘটনা ঘটাতে চায় এটার উত্তর খুব কম মানুষের কাছেই পরিষ্কার। বাবা-মা চায় তাই... লোনলি ফিল করেন তাই... বংশবিস্তার করতে চান তাই... প্রেম করেছেন তাই... শারীরিক আকর্ষণ বোধ করেন তাই?
কিছুদিন আগে পড়া এ বিষয়ে এক ভদ্রমহিলার একটা লেখা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করা/কারো সাথে থাকা প্রয়োজন কারণ সারাদিন বাকি দুনিয়াটাকে সামলে এমন কারো জন্য ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে যার জন্যে ঘরে ফেরা যায়। খুব সাধারণ উত্তর ...এমন কাউকে প্রয়োজন ...যার জন্য ঘরে ফেরা যায়। এমন একটা বন্ধু যার সাথে নিজের জীবনটাই নি:সঙ্কোচে শেয়ার করা যায়।
৫.
আমার উপর মাঝে মাঝে কোন একটা গানের ট্রাক ভর করে। দিনের পর দিন শোনা হয়। এখন লিমনের গাওয়া একটা ট্রাক ভর করে আছে।
"আমি ঘরের হইনি.. বাহির আমায় টানে.. আমি তোমার হইনি শুধু আকাশটা জানে... আমি পথ থেকে পথে যাই.. দূর থেকে দূরে..." খু্বই সত্যি কথা।
আগ্রহীদের জন্য লিংক:
Click This Link
এই লেখাটা মানবজাতির এক সদস্যের জন্য। যিনি আনন্দময় ঘটনার একটা দারুন সংজ্ঞা আমাকে দিয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১২ রাত ৮:০৪