somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেদিন জবস ঘুরিয়ে দিলেন অ্যাপলের ইতিহাস

০১ লা নভেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আপনারা জানেন, আমি পিক্সার নামে একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং সিইও। আমি এবং আরো বেশ কয়েকজন মিলে চেষ্টা করছি অ্যাপলের সুস্বাস্থ্য যেন ফিরিয়ে আনা যায়।’ কথাগুলো স্টিভ জবস বলেছিলেন ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরে আয়োজিত ম্যাকওয়ার্ল্ড এক্সপো নামের অনুষ্ঠানের শুরুতে। তারিখটি ছিলো ৬ অগাস্ট।

চমকপ্রিয় জবস কৌশলে ওই দিন শুরুতে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন পিক্সারের চেয়ারম্যান এবং সিইও হিসেবে। অথচ ততক্ষণে তিনি অ্যাপলের অন্যতম বোর্ড মেম্বার, যদিও সে খবরটি তখনো প্রকাশ করা হয়নি। যারা স্টিভ জবস সম্পর্কে জানেন, তিনি জীবিত থাকতেই তার কর্মপদ্ধতি এবং জাদুকরি প্রেজেন্টেশন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তারা এই সত্য লুকানোর কারণ জানতে হন্যে হয়ে উঠবেন না। তারা জানেন, স্টিভ প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতেন হিসেব করে, তা সে যতো ছোটো সিদ্ধান্তই হোক না কেন।

ওই অনুষ্ঠানের শুরুতে নিজেকে পিক্সারের সিইও হিসেবে উপস্থাপন করা এবং বেশ অনেকগুলো নতুন তথ্য দর্শকদের জানানোর আগের ঘটনাগুলো যারা জানেন, তারা সম্ভবত বলবেন, ওই দিনটি ছিলো প্রযুক্তিভিত্তিক মার্কিন বাজার অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ওই দিনটিই মোর ঘুরিয়ে দেয় অ্যাপলের, স্টিভ জবসের এবং গেটা কম্পিউটিং জগতের।

দিনটির গুরুত্ব বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৮৪ সালে। ওই বছর অ্যাপল বাজারে আনে ম্যাকিনটশ নামের ডেস্কটপ কম্পিউটার। এই কম্পিউটারেই প্রথমবারের মতো যোগ করা হয় গ্রাফিক ইউজার ইন্টারফেস। যারা এই কারিগরি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের জন্য সহজ করে বলা যায়, আমরা কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় যে ডেস্কটপ দেখি, যেভাবে মাউস দিয়ে ক্লিক করে ফাইল খুলি, মাউস দিয়ে টেনে ফাইল স্থানান্তর করি, এই সুবিধাটিকেই বলা হচ্ছে গ্রাফিক ইউজার ইন্টারফেস। এইটিই অ্যাপলের আবিষ্কার। অ্যাপল সে কাজটি করেছিল ১৯৮৪ সালের মধ্যেই। এর আগে কস্পিউটারে কাজ করতে হতো লাইনের পর লাইন লিখে কমান্ড দিয়ে।

ওই সময়ের অনেক পরে মাইক্রোসফট ১৯৯৫ সালে বাজারে আনে উইন্ডোজ ৯৫ এবং প্রথমবারের মতো মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেমে যোগ হয় মাউস ক্লিক ভিত্তিক গ্রাফিক ইউজার ইন্টারফেস যাকে ধরা হয় ব্যবহার বান্ধব হিসেবে অ্যাপলের গ্রাফিক ইউজার ইন্টারফেস-এর মতো।

ইতিহাস সংক্ষেপ করে বলা চলে, ১৯৯৫ সালে উইন্ডোজ ৯৫ বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় এবং বাজারে পিছিয়ে পড়ে অ্যাপল। এর মধ্যে অ্যাপলের যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। নিজে গবেষণায় মন দেবেন বলে স্টিভ জবস অ্যাপলে নিয়োগ করেছিলেন একজন সিইও, নাম জন স্কালি। ভদ্রলোক এর আগে ছিলেন কোমল পানীয় পেপসির সিইও। ১৯৮৪ সালেই স্টিভ তাকে বলেছিলেন, আপনি কি সারাজীবন এই চিনি মেশানো পানি বেচবেন নাকি পৃথিবীটাকে বদলে দেয়ার কাজে নেতৃত্ব দেবেন?

জন স্কালি অ্যাপলে এসেই সিদ্ধান্ত নেন, বাজারে যতো ধরনের কম্পিউটার আছে, অ্যাপলেরও ততো ধরনের কম্পিউটার চাই। বাজার দখলের এই কৌশল কোমল পানীয়র বেলায় কাজ করতে পারে, যেমনটা বলা চলে, কোকাকোলার বিপরীতে পেপসি কোলা, স্প্রাইটের বিপরীতে সেভেন আপ। কিন্তু কম্পিউটারের বাজার যে ভিন্ন যেটি স্কালি যেমন বুঝতে পারেন নি, তেমনি অ্যাপলের অন্য বোর্ড মেম্বাররাও বুঝতে পারেননি। ফলে বোর্ডরুম পলিটিক্সে হেরে যান জবস। নিজের কোম্পানি থেকে নিজেই হয়ে যান জব লেস। তার বয়স তখন ৩০-এর কম।

এর পর স্টিভ জবস পিক্সার অ্যানিমেশন তৈরি করেছেন, নেক্সট নামে কম্পিউটার ফার্ম তৈরি করেছেন আর দূর থেকে দেখেছেন- ডুবতে বসেছে অ্যাপল।

১৯৯৭ সালের ওই দিনটি এই ঘটনাবহুল হবার কারণেই স্টিভ জবসের জন্য হয়ে ওঠে ইতিহাসের হিসেব মেলানোর দিন। পাশাপাশি ওই দিনটি তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরুর দিন হিসেবেও।

আসুন, দেখে নেই ঠিক ওই দিনে অ্যাপলের হিসেব কী ছিলো। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, ওই দিন অ্যাপল দাঁড়িয়ে ছিলো দেউলিয়া হওয়া থেকে মাত্রই ৯০ দিন দূরে। অর্থাৎ ৯০ দিনের মধ্যে অ্যাপলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং অর্থ সমাগম করতে না পারলে কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হবে। ৯৫ সালের অ্যাপলের পণ্য বিক্রি হয়েছে ১১.১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের, ৯৬ সালে এটি দাঁড়ায় ৯.৫ বিলিয়ন আর ৯৭ সালে আরো নেমে দাঁড়ায় ৭ বিলিয়ন ডলারে। ওই টাকা থেকে উৎপাদন ও আনুষাঙ্গিক খরচ বাদ দিলে গোটা কোম্পানি তখন ছিলো লোকসানের খাতায়।

ওই সময়ে বাজার মূল্য হিসেবে অ্যাপলের দাম ছিলো ৬ বিলিয়ন ডলার আর মাইক্রোসফটের দাম ছিলো ২৫০ বিলিয়ন ডলার। সে সময় ছয় আর আড়াইশ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় না গিয়ে স্টিভ নিজে বিল গেটসের সামনে দাড়িয়ে হিসেব তোলেন মাইক্রো সফটের অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজে ব্যবহার করা ইউজার ইন্টারফেস বিষয়ে। অ্যাপলের দিক থেকে বিষয়টি ছিলো অনেকটা যেন এমন- ‘তোমরা যা দিয়ে ব্যবসা করছো, সেটি আসলে আমাদের বানানো’। বিল গেটসের সঙ্গে স্টিভ জবসের এই ইউজার ইন্টারফেস নিয়ে ঠিক কত টাকার চুক্তি হয়েছিল তা সে সময় কোনো পক্ষই প্রকাশ করেননি। তবে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য প্রতিষ্ঠান দুটি একটি চুক্তিতে আসে।

ওই দিন প্রথমবারের মতো স্টিভ জবস জানিয়েছিলেন মাইক্রোসফটের সঙ্গে চুক্তির কারিগরি বিষয়গুলো। স্টিভ বলেন, মাইক্রোসফট ওই সময়ের পর থেকে অফিস স্যুইট (অর্থাৎ মাইক্রোসফট অফিস, এক্সেল, পাওয়াপয়েন্ট বা এক্সেস এর মতো সফটওয়্যারগুলো) অ্যাপল এবং উইন্ডোজ পিসির জন্য একসঙ্গেই তৈরি করবে। উইন্ডোজ পিসির জন্য যতোগুলো অফিস ভার্সন তৈরি হবে, ঠিক ততোগুলো ভার্সনই তৈরি হবে ম্যাক অপরেটিং সিস্টেমের জন্য। মনে রাখা দরকার, বাজারে যতোগুলো অফিস স্যুইট আছে, তার মধ্যে মাইক্রোসফটের অফিস প্যাকেজটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবহারবান্ধব বলে স্বীকৃত। এর ফলে, অন্তত পাঁচ বছরের জন্য ম্যাক অপরেটিং সিস্টেমের জন্য বাজারের একটি ভালো ও জনপ্রিয় পণ্য নিশ্চিত করেন স্টিভ।

তৃতীয় বিষয় ছিলো, মাইক্রোসফট ১৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের শেয়ার কিনবে অ্যাপলের। এই তথ্যটি যেন অ্যাপলের জন্য ছিলো অহংবোধে আঘাত করার মতো। তবে, স্টিভ আস্বস্ত করেন বাড়তি আরেকটি তথ্য দিয়ে। ওই দেড়শ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে মাইক্রোসফট আদতে অ্যাপলে কোনোরকম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে না এবং অন্তত তিন বছর মাইক্রোসফট ওই শেয়ার হাতবদলও করতে পারবে না। ব্যবসার ভাষায় একে স্টিভ বলেছিলেন ‘নন ভোটিং শেয়ার’। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানে টাকা আসবে ঠিকই কিন্তু কর্তৃত্বও পুরোপুরি থাকবে অ্যাপলের।

তবে ওই চুক্তির ফল কী হয়েছিল তা এক কথায় জানা সম্ভব পরের দিন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়, স্টিভ জবসের ওই ঘোষণার ফলে অ্যাপলের প্রতিটি শেয়ারের দাম ৬.৫৬ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২৬.৩১ ডলারে। অপরদিকে মাইক্রোসফটের শেয়ারের দাম বাড়ে স্রেফ ১২ সেন্ট।

ওই দিন মাইক্রোসফটের সঙ্গে স্টিভ জবস চুক্তি করেছিলেন অসবম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করে। কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দুই ঘণ্টা আগে অন্যান্য পরিচালকদের তিনি জানিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। ফলে বাইরের লোকজন তো দূরের কথা, যার সঙ্গে চুক্তি করেছেন, সেই বিল গেটসও বলেছিলেন, ‘স্টিভ কেন আবার অ্যাপলের সিইও হতে চাইছে? সে জানে তথ্যপ্রযুক্তি বাজারে সে প্রতিযোগিতায় পারবে না।’

সে সময় বিল গেটস জানতেন না, ওই চুক্তির ফলে জবস প্রতিষ্ঠানের ধ্বস ঠেকানোর পাশাপাশি তিন থেকে চার বছর সময় কেবল বের করে নিচ্ছেন। স্টিভ সম্ভবত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, ওই সময়টুকু পেলেই তিনি ফের বদলে দিতে পারবেন খেলার ছক। ঠিকই চার বছর পর ২০০১ সালে অ্যাপল প্রবেশ করে কম্পিউটারের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়, বাজারে আনে জনপ্রিয়তম মিউজিক প্লেয়ার আইপড। এইসব পরিকল্পনা বিল গেটসের জানার কথাও নয়। যেমন তিনি সেই সময়ে কল্পনাও করতে পারেননি ২০১১ পয়লা নভেম্বর এসে ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইক্রোসফটের বাজার মূল্য দাঁড়াবে ২২৬ বিলিয়ন, আর সেই সময়ের ৬ বিলিয়ন ডলারের অ্যাপলের মূল্য দাঁড়াবে ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×