দূর দেশে সোনা আছে বলে নয়ই নিতান্তই জীবিকার তাগিদে এক যুবক পাড়ি জমিয়েছিল সমুদ্রে। তারপর নীল পানি, বিশাল ঢেউ, আর নি:সঙ্গতা। দিন গোনা, ঢেউ গোণা, বন্দরে বন্দরে নূতন অভিজ্ঞতা। সেইসাথে স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের পালা - এই নিয়ে সমুদ্রের দিনরাত্রি।
জাহাজ ছাড়ল সন্ধ্যায়।
তখন চারদিকে নিয়নবাতি জ্বলে উঠছে। কয়েকবার ভেঁপু বাজিয়ে আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে কর্ণফুলির জোয়ারে। বন্দর থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি আমরা।
কর্নফুলির অপরপাড় ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। কেবিন ছেড়ে বাইরে আসি। অনেকদূর চলে এসেছি। মেরিন একাডেমি জেটি পেরিয়ে সার কারখানা। সার কারখানা টাওয়ারে সেই সিগন্যাল বাতি জ্বলছে-নিভছে যথারীতি।
একসময় সারকারখানার সিগন্যাল বাতিও হারিয়ে যায়। চারদিক অন্ধকার। আকাশে একটু একটু মেঘ। মেঘের ফাঁকে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে। নিচে অথই সাগর। জল আর জল। চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে চারপাশ।
এ জায়গায় আগেও কয়েকবার এসেছি। কয়েকরাত কেটেছে এখানে। রাতের বেলা চাঁদের আলোতে দেখেছি সমুদ্রকে। কিন্তু সমুদ্রের সেই আসল রূপ দেখিনি। যে রূপ ভয়ঙ্কর। উত্তাল তরঙ্গ কিংবা ফেনিল ঊর্মিমালা কোনটাই দেখা হয়নি। সমুদ্রের নীলপানি তাও না। ঘোলাটে পানি ছেড়ে কখন নীলপানিতে পৌঁছি তা দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এখন রাতের বেলা তা আর সম্ভব হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে শুধুই রূপালি সাগর।
কর্নফুলির পাড় থেকে শুধুই দেখতাম সাগরকে। সাগরের বুকে নোঙর করে থাকত অজস্র জাহাজ। রাতের বেলা ঘুমুতে যাবার আগে নজরে পড়ত আলোয় ঝলমল জাহাজগুলো। ভাবতাম, কবে যাবো ওই দূর সমুদ্রে!
সমুদ্রে না গেলেও কর্নফুলির সাথে পরিচয় ছিল। সে পরিচয় বেশ ভালভাবেই। সাম্পানে চড়ে কর্নফুলি পাড়ি দেয়া - সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সামুদ্রিক ঢেউয়ের ছিটেফোঁটা এসে পড়ে এই কর্নফুলিতে, বিশেষ করে জোয়ারের সময়। ছোট্ট সাম্পান দুলতে থাকে এদিক ওদিক। মনে হয় এই বুঝি চলে গেল জলের তলে। কিন্তু না, তা হয় না। আবার ভেসে ওঠে। জাহাজ এসে ঢোকে বন্দরে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে কর্নফুলির দুপাড়ে। সাম্পানও দুলতে থাকে সেই তালে। বেশ ভাল লাগে। দু'একটা মাছধরা ট্রলার সমুদ্র থেকে ফিরে আসে। উপরে উড়তে থাকে চিল আর বাজপাখি। পাহারাদারকে ফাঁকি দিয়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় মাছ নিয়ে উড়াল দেয় আকাশে।
রাতের কর্নফুলির রূপটা আলাদা। চারপাশে নিঝুম, এক পাতলা কুয়াশার আবরণ। তারমধ্যে দু'একটা হারিকেনের মিটিমিটি আলো। কাঠের নৌকা কিংবা মাছ ধরা ট্রলার ফিরছে সমুদ্র থেকে। আর জোয়ার বা ভাটার সময় অজস্র ডিঙি নৌকা বেরিয়ে আসছে গোপণ আশ্রয়। ভাটার টানে নিজেকে ছেড়ে দেয়, পৌঁছে যায় সমুদ্রে। আবার জোয়ারের সময় ফিরে আসে স্রোতের টানে। সারাদিন খেটে কখনও মাছ পায়, কখনও পায় না। তবু অব্যাহত থাকে সংগ্রাম, 'ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী'র সংগ্রাম, কুবের ও গণেশের সংগ্রাম।
কর্নফুলির পাড় থেকে দেখতাম ওইসব কুবেরদের সংগ্রাম। মাঝে মাঝে মনে হতো চলে যাই তাদের মাঝে, ঘুরে আসি সমুদ্র থেকে; দেখি কীভাবে মানুষের জালে আটকা পড়ে রূপালি ইলিশ। কিন্তু তা করতে পারি না। নানাবিধ বাধানিষেধ আছে। এক পা বাড়ানো যাবে না বৃত্তের বাইরে। বৃত্তবন্দি জীবনে প্রতিদিনই শুনতে হয়- গ্রো অফিসার লাইক কোয়ালিটিজ, লার্ন হাউ টু ডিল উইদ ক্রুজ। কখনও বা মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয় ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি'র। ছোটলোকদের শাসন করার এটাই উত্তম পদ্ধতি। কেউবা সেই উত্তম পদ্ধতি প্রয়োগ করতে উঠে পড়ে লাগে; হাতের কাছে আছে 'জুনিয়রস'; বাইরে 'সিভিলিয়ান', কেউ বলে 'ব্লাডি সিভিলিয়ান'। ইভেন দে ডোন্ট নো হাউ টু ওয়াক। ইউ শুড নট বি লাইক দেম। স্যুটেড বুটেড হয়ে চলাফেরা করবে, কাঁটাচামচ দিয়ে ভাত খাবে, ইংরেজিতে কথা বলবে। মাদারটাঙ? হোয়াট ইজ মাদারটাঙ? ফাকআপ ইউর মাদারটাঙ!
সুতরাং যাওয়া হয় না। কুবেরদের কাছে তো নয়ই, সাধারণ মানুষের কাছেও যাওয়া হয় না।
তবু কর্নফুলিকেতো সমুদ্রে মিশতেই হয়, পদ্মা-মেঘনা-যমুনাকেও। হিমালয়ের দিকে যেতে পারে না, ফিরতে হয় সমুদ্রেই; যদিও উত্পত্তি হিমালয়ে। অবশ্য শুকনো পাতা আর খড়-কুটোদের কথা আলাদা। তারা কর্নফুলিতে ভাসতে ভাসতে সমুদ্রে মিশতে পারে; বাতাসে উড়ে পৌঁছে যেতে পারে হিমালয়ে। পৌঁছে যায়ও। কিন্তু সবাইতো খড়কুটো নয়। অনেকের আদর্শই নদী ও বৃক্ষ। বৃক্ষ হলে মাটির সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়, আঁকড়ে ধরতে হয় মাটিকে। নদী হলে মিশতে হয় সমুদ্রে।
দেড় বছরের বেকারত্ব, তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছ এই সমুদ্রের সাথে। এই সমুদ্রকে না চিনলে আটলান্টিক চেনা যায় না। এই সমুদ্রের মাঝে আটলান্টিকের নির্জনতা আর উত্তাল ঢেউ নেই, আছে জীবনের কোলাহল, অপরিসীম মমত্ব, প্রগাঢ় ভালবাসা। আমরা সবাই বিন্দু বিন্দু জল এই সমুদ্রের।
পাড়ি জমাই এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০০৮ রাত ১১:২২