[ছবি প্রাপ্তিঃ গুগল]
(বিজনদা কবিতার লিংকগুলো একত্রিত করতে কঠোর পরিশ্রম করেন। বন্ধু স্রাঞ্জি সে কে দেখেছি গল্প পোষ্টের লিংক সমন্বয় করতে। বিজনদার কবিতা সংকলন পোষ্টে আমার লেখার লিংক থাকতো। বন্ধু স্রাঞ্জি সে তাই গল্প পোষ্ট করতে বলেছিলো একবার। প্রথম আলোতে প্রকাশিত আমার একটা গল্প ব্লগে পোষ্ট করেছিলাম। স্রাঞ্জির পুনরায় গল্প লিংক সংকলন পোষ্ট দেখে গল্প পোষ্ট করার শখ জাগলো। প্রিয় পদাতিক, আখেনাটেন, মনিরা সুলতানা আপা, বিশেষ করে গল্প বলিয়ে প্রিয় নীলাকাশ, রহমান লতিফ ভাইদের গল্প পাঠ করার পর গল্প পোষ্ট করার সাহস করে উঠতে পারিনা। তারেক ফাহিম ভাই, তানভীর অপু, প্রিয় হাবিব ভাইদের গল্প পাঠ করে পুলকিত হই। এই তালিকায় আরও অনেকে আছেন। শ্রদ্ধেয় চাঁদগাজী একজন সচেতন ও স্পষ্টবাদী পাঠক। তাঁর কথাটাও মাথায় আছে আমার। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, ভুল ত্রুটি ক্ষমা প্রার্থনা করে গল্পটি পোষ্ট করলাম।)
ফজরের ওয়াক্ত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ফুলবানুর সংসারের কাজ করতে করতে নুরজাহানের জীবন যাবার দশা। নুরজাহান যেদিন থেকে ঘরের কাজে হাত দিয়েছে, ফুলবানু সেদিন থেকেই যেন ছুটি নিয়েছে । সারাদিন গাধার মতো পরিশ্রমের পর শান্তিতে যে একটু দুচোখ বন্ধ করবে তারও উপায় নেই। রান্না ঘরের খুপরির বিছানায় শোয়ামাত্র ফুলবানুর লম্পট বড় ছেলেটা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর। ফজরের আজান না দেয়া পর্যন্ত ওর শরীরটা নিয়ে খেলে। নুরজাহানের আজকাল ঘুম হয়না বললেই চলে। শরীরে কীট বাসা বাঁধলে ঘুম আসে কীভাবে? বাপজান কত শখ করে তার নাম রেখেছিল নুরজাহান। গর্ব করে বলতো, "আমার মাইয়া সারা দুনিয়ার আলো। দেখতে য্যান হুর পরী।" অভাবে তাড়নায় পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে এসে এই গতরই কাল হয়ে দাঁড়ালো ওর।
প্রতিদিন সকালে নুরজাহান পাশের কয়েকটা বাড়িতে গরুর দুধ দিয়ে আসে। ফুলবানুর তিনটে দুধেল গাই আছে। খাওয়ার লোক নাই বলে বিক্রিও করে। এ বাড়ি-ওবাড়ি দুধ পৌঁছে দেয়ার কাজটা নুরজাহানই করে। আজকে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ করেই পথ আগলে দাঁড়ালো জেলেখার বাপ। লোকটা বেশ কয়েকদিন হল নুরজাহানের আশপাশ ঘুরঘুর করে। জেলেখার বাপ নিম গাছের ডাল দিয়ে মেছওয়াক করছিলো। একদলা থুথু ফেলে বলে," আহারে তুমার ওমন সোনার শরীলডা দিন দিন কেমুন তামা হইয়া যাইতাছে। খলিলের মায়ে খাওন দেয়না তুমারে?"
নুরজাহান শুকনো চোখ দিয়ে কি বললো বোঝা গেলনা। জেলেখার বাপ একটু এগিয়ে এসে বলে," তুমি আমার লগে ঘর করবা?"
নুরজাহানের দুচোখ এবার যেন বিষ্ফোরিত হল। চিনচিন করে বলল," কি কন জেলেখার বাপ? আপনের ঘরে বউ আছে। দুইডা সোমত্ত মাইয়াও আছে। আমারে ঘরে নিবান কেমনে?"
খ্যাক খ্যাক করে হাসে জেলেখার বাপ। মুখে চু চু শব্দ করে বলে," সতীনের ঘর করবা। মাইনষে সতীনের ঘর করে না? তুমার এই কষ্ট আমি সহ্যি করবার পারতাছিনা। তুমারে যদি আমি সুখী করবার পারি, তাইলে খুদা আমারে নাজাত দিবো।"
দিন যায়, রাত যায়। নুরজাহানের শরীরে এখন দুটো কীটের বাস। প্রতিদিন কীটদুটো ওকে কুটকুট করে খায়। একজন খায় মধ্যরাতে, আর একজন খায় ভোররাতে। জেলেখার বাপের কাছে অনুযোগ করে," ও জেলেখার বাপ তুমি আমারে ঘরে নিবানা? চুরি চামারি কইরা কয়দিন আমারে এইভাবে লুইটা খাইবা?"
জেলেখার বাপ খ্যাক খ্যাক করে বলে," রোসো, রোসো।"
নুরজাহান আর অপেক্ষা করতে চায়না। চাপ দেয় বিয়ে করার। জেলেখার বাপ অবশেষে রাজি হয় ওকে ঘরে নিতে। বিয়ের অনুষ্ঠান শহরে হবে শুনে কিছুটা অবাক হয় নুরজাহান। জেলেখার বাপ ওকে বুঝায়। বউ থাকতে একজন কাজের মেয়েকে বিয়ে করলে গ্রামবাসী ক্ষেপে উঠবে, বাঁধা দেবে। জেলেখার মা হয়তো এই বিয়ে ভেঙ্গেও দিতে পারে। তারচেয়ে শহরে গিয়ে নূরজাহানকে বিয়ে করে গ্রামে ফিরে আনলে তখন কেউ কিছু আর বলতে পারবেনা। জেলেখার মা বড়জোড় চিৎকার চেচামেচি করে দুইদিন কাঁদবে আর কপাল চাপড়াবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। নুরজাহান রাজি হয়।
পরদিন ফুলবানুর বড় ছেলের মনের খায়েশ মিটিয়ে সকালের ট্রেনে লুকিয়ে জেলেখার বাপের সাথে রওয়ানা হয় শহরের দিকে। রাস্তা অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে নুরজাহানের কাছে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্ন দেখলো নতুন সংসারের, নতুন সুখের সুখ নামক একটি পাখির। দুপুরে জেলেখার বাপ নুরজাহানকে নিয়ে একটি বস্তিতে ঢুকলো। সেখানে কতগুলো বেঢপ মেয়ে রং তামাশা করছে। " ও জেলেখার বাপ, তুমি আমারে কোনে আনলা?" নুরজাহানের কথার জবাব
না দিয়ে একটা খুপরিতে ঢুকলো। মাঝ বয়সী এক মহিলা বিছানায় আধাশোয়া ছিল। নুরজাহানের দিকে একনজর দেখে জেলেখার বাপকে বলল, " জব্বর জিনিস আনছো আনছার মিয়া।" নুরজাহানকে বসে রেখে আধা বুড়িটাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেল জেলেখার বাপ। প্রায় দশ মিনিট পরে আধা বুড়ি একা ও ঘর থেকে বের হয়। নুরজাহান জিজ্ঞেস করে, "খালা জেলেখার বাপে কই?"
"তোকে রাইখ্যা দশ হাজার টেকা লইয়া ঐ ঘরের পেছন দরজা দিয়া পলাইছে আনছার মিয়া।" বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসে আধাবুড়ি।
চারদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। জানালায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখছে নূরজাহান। কতদিন হয়ে গেল এখানে আছে সে। হয়তো মৃত্যুটাও এখানে হবে। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখন তার শরীরে অসংখ্য কীটের বাস।