বর্তমান প্রজন্মের একটা নিয়মিত অভ্যাস নিজেকে একটু ফোকাস করতে পারা। অথচ এ কাজটা করতে গিয়ে সে নিজেকে প্রতিনিয়ত কলুষিত করছে নিজের অজান্তেই। একটু ভেবে দেখুন। আজকালকার ছেলেদের “বডি ল্যাংগুয়েজ” একটু দৃষ্টি কটু। আগে দেখতাম একজন সিনিয়র, শিক্ষক বা কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি পথ দিয়ে গেলে সকলের মাথা নুয়ে থাকতো। তাঁদের সাথে আচরণে থাকতো শিষ্টাচার। আর এখন ১০০ জন ছাত্রের মধ্যে মনে হয় ৮০ জনই জানবে না ‘শিষ্টাচার’ বলতে কি বুঝায়। হুম, আমরা এখনো মাথা নুয়াই……, তবে যার-তার সামনে নয়, শুধু মাত্র যার কাছ থেকে ডাইরেক্ট কোন সুবিধা পাব, তাদেরই সমীহ করি।
বিনয়, শ্রদ্ধা আজকাল সমাজ থেকে উঠে গেছে। অপরিচিতের সাথে আমরা শত্রুভাবাপন্ন ব্যবহার করি। হোক সে ভাল কিংবা খারাপ। কিন্তু কেন? কেন প্রথম দেখাতেই আমরা কোন অপরিচিতের দেখা সেরা মানুষ হতে পারি না।
“আরে কার কি আসে যায়। এ স্বাধীন বাংলাদেশে আমার যা খুশি আমি তাই করবো”। “আমি তাকে শুধু শুধু শ্রদ্ধা দেখাতে যাব কেন? সে আমার কি করতে পারবে”। “আমিও কম কিসে”। “এখন কি আর সেই মান্দাতার আমলের যুগ আছে যে শুধু গুরুজনের পা চাটতে হবে”। “এখন পরিবারের আমিই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সুতরাং সবাইকে আমার কথাই শুনতে হবে, আমি কারো ধারধারি না”। “আরে ও বহুতদিন নেতাগিরি করছে, এখন আমাদের সময়। এসব নেতা-কেতার বেল নাই”। “এখন ডিজিটাল যুগ, ফেইজ বুকে আমার ছবিতে 1K লাইক পড়ে। সুতরাং আমি এখন সেলিব্রিটি। সেলিব্রিটিরা যাকে তাকে পাত্তা দেয় না”। “আরে সিনিয়র হইসে তো কি হইসে, তাই বলে সিট ছেড়ে দিতে হবে?” – এ ধরণের চিন্তা কোন কোন সময় এসে যায়।
আগেকার লোকদের চক্ষুলজ্জা বেশি ছিল, যার কারণে “পাছে লোকে কিছু বলে” ভাবনায় অনেকেই জীবনে কিছু করতে পারেননি। অতঃপর কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছেন। বর্তমান তরুণ সমাজ এ চক্ষুলজ্জা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে সত্যি, বরং তাদের আচরণ দেখে আশেপাশের লোকের চক্ষুলজ্জা বেড়ে গেল।
নেতার সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে কখনো সেলিব্রিটি হওয়া যায়না। সিনিয়র বা গুরুজনদের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে “ডোন্ট কেয়ার” টাইপের আচরণ করে কখনো বড় হওয়া যায় না। আপনি কাউকে পাত্তা না দিলেও তার দিন চলে যাবে, পাত্তা দিলেও তার দিন চলে যাবে। কারো জন্য কেউ আটকে থাকবে না। জীবন আপন গতিতে চলে, কারো অনুরোধে তাকে আটকে রাখতে পারবেন না। শত চেস্টা করেও আপনার বয়সটাকে ধরে রাখতে পারবেন না। সব সময় স্বপ্নের ঘোরে থেকে দিন পার করা যায়, কিন্তু বাইরের লোকজন আপনাকে ঠিকই বুঝে নিবে। আপনি চোখ বন্ধ করে নিজেকে রাজা ভাবলেও বাইরের লোক পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আপনার সত্যিকারে অবস্থান কোথায়? জ্ঞান যার সীমিত, সে-ই কুয়ার ব্যাঙের মতো নিজেকে সেরা মনে করে। জ্ঞান অনুসন্ধিৎসু মানুষ প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন কিছু শিখতে চায়, সবার কাছ থেকে ভালটা গ্রহণ করে। আর নিজেকে ঐ ভাবে পরিচালিত করে।
ভেবে দেখুন, আজ যাকে আপনি হেয়-প্রতিপন্ন করছেন, কাল হয়তো সে আপনার সম্পর্কে অন্যকে ভাল কিছু বলবে না, বরং বলবে ছেলেটা বেয়াদব, ঘাড়-তেরা, আচরণে সমস্যা আছে। প্রত্যেকের একটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে, আপনি আজ তাকে অবজ্ঞা করলেন, অপমানিত করলেন, ভবিষ্যতে এমন দিন যে আসবে না তা বলা কঠিন, সুযোগ পেলে সেও আপনাকে একহাত দেখে নেবে। হয়তো এমন একটা টার্নিং পয়েন্টে সে এমন মন্তব্য করে বসবে যা হয়তো আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিবে। মানুষের ক্ষমতা সবসময় কন্সটেন্ট নয়, মানুষ ঘটনা ক্রমে কখনো জিরো পাওয়ার হয় আবার কখনো কখনো অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। আজ যাকে মনে হচ্ছে অপাংক্তেয়, কাল সে হয়ে উঠবে আপনার ভাগ্য নির্ধারক। সুতরাং সাধু সাবধান। আপনার আচরণে যত্নবান হোন।
আজ আপনি বড়দের শ্রদ্ধা দেখান, ছোটরা আপনার থেকে শিখবে। কাল তারাই আপনাকে শ্রদ্ধা করবে। আজকের একজন বিশ্বস্ত অনুগামী কর্মীই হতে পারে আগামী দিনের যোগ্যতম নেতা। সুতরাং একজন সুদক্ষ নেতা হতে হলে আগে নিষ্ঠাবান কর্মী হয়ে আসতে হয়। কর্মী হওয়ার আগে যে নেতা হতে চায়, সে এখনো স্বপ্নের ঘোরে আছে। তাকে জাগাতে হবে। কেউ নেতা হয়ে জন্মায় না, তার মানবীয় গুণাবলীই তাকে নেতা করে। আর এ গুণাবলী অর্জন করতে হলে কাজ করতে হবে। আজ আপনি যা করছেন, আপনার কাজে অন্যকেউ বিব্রতবোধ করছেন কিনা একটু যাচাই করুন। আপনার অন্যের ক্ষতি করার কোন অধিকার নাই, যদি নিজের অজান্তে কারো ক্ষতি করেও থাকেন একটু ভাববেন আশেপাশে কি ঘটছে, কেউ আপনাকে গালি দিচ্ছে কিনা। কেউ নিয়ম মেনে না চললেও ভাবুন এখানে একটা নিয়ম আছে। নিয়ম মেনে চলুন, নিয়মকে শ্রদ্ধা করুন অন্যকে নিয়ম মেনে চলতে উৎসাহিত করুন। তাহলে অন্তত কেউ পেছনে গালি দিবেনা। আর আপনার দেখা দেখি হয়তো অনেকে তা অনুসরণ করবে।
অনেকে বলে, “বিনয়কে মানুষ দুর্বলতা মনে করে। যে বিনয়ী হয় বাঁশটা খেতে হয় তাকে সবার আগে।“ আপনাকে বুঝতে হবে – অন্যায়কে মেনে নেয়া “বিনয়” নয়; অনিয়মের সাথে আপোষ “বিনয়” নয়; বিশৃঙ্খলাকে গ্রহণ করা “বিনয়” নয়। “বিনয়” দেখাতে পারেন কেবল ক্ষমতাবান ব্যক্তি। সুতরাং আগে ক্ষমতাবান হোন, মানুষকে বুঝতে শিখুন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন, নিজের বিবেককে জাগ্রত করুন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোন, সমাজের অচেতন মানুষদের সচেতন করুন। সমাজের কুসংস্কার দূর করুন, সমাজ সংস্কারক হোন। তারপর বিনয়ী হোন, দেখবেন সমাজ আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:৪৬