somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রিয় কবি ও কবিতা - ৩

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্মার্টফোনে বিভিন্নজন বিভিন্ন উপকারীতা খুঁজে পান। এর সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তর্ক বিতর্ক আছে খুব। আমি সেদিকে না যাই। এটুকুই বলতে পারি তিন ইঞ্চির স্ক্রীন নিয়ে যে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করা শুরু করেছিলাম সেটা আমার জীবনে পরিবর্তন এনেছে ব্যাপক। নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে আমার পড়ার অভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে অনেক। চোখের বারোটা বাজিয়েছি, বাজাচ্ছি কিন্তু পড়া ছেড়ে দেইনি। পত্রিকার কলাম, ব্লগের মন্তব্যের তুমুল ঝড়, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা কিছুই বাদ দেইনি শুরুর সময়টাতে। মনে আছে তখন আমাকে প্রতিদিন লম্বা একটা জার্নি দিতে হত। কলাবাগান থেকে গুলশান। পথটা খুব বেশি না হলেও সকাল বিকাল জার্নিটা দীর্ঘ আর বিরক্তিকর ছিল। সেই বিরক্তিকর সময়গুলো আমি কাজে লাগিয়েছি বই পড়ে আর গান শুনে। সকালে ভাগ্যক্রমে বসার জায়গা পেলে ব্যাগের থেকে বই বের হত আর দাঁড়িয়ে থাকলে বের হত এয়ারফোন। আর ফিরতে যেহেতু রাত হত সেহেতু আমার সেই ছোট্ট স্মার্টফোনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতাম আমি।

সেই সময়টায়, যখন শীত আসি আসি করছে। বাসের জানালার পাশে বসে হালকা শালটা গায়ে জড়িয়ে প্রথম ভাস্কর চক্রবর্তীকে পড়েছিলাম। কবিতার নাম ছিল “শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা”

‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব – প্রতি সন্ধ্যায় কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে – আমি চুপ করে বসে থাকি – অন্ধকারে
নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা, সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা – তারপর হঠাত্
সব মোমবাতি ভোজবাজির মতো নিবে যায় একসঙ্গে – উত্সবের দিনহাওয়ার মতো অন্যদিকে ছুটে যায়, বাঁশির শব্দ
আর কানে আসে না – তখন জল দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয় – জলের ভেতর – শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিশ্বাস নিই সারাক্ষণ – ভালো লাগে না সুপর্ণা, আমি
মানুষের মতো না, আলো না, স্বপ্ন না – পায়ের পাতা
আমার চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশ – ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি, ঘড়ির কাঁটা
আঙ্গুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন – আমার ভালো লাগে না – শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব

একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার কাছে – চারিদিকে অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যচ্ছিল না সেদিন – সেইদিন
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম – চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার -
এখন আমি মানুষের মতো না – রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাত্ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার – ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না – আমি
মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি এখন – যে-দিক দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব’

কি ছিল কবিতাটায় জানিনা। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম কয়েকবার। নিজের মত করে কবিতা নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে পার করেছিলাম সেদিনের পথ।

সেদিনের পর খুঁজতে শুরু করলাম ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা। পড়তে পড়তে একসময় তিনি ঢুকে গেলেন প্রিয় কবিতার তালিকায়। আর তার জন্য সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই স্মার্টফোনেরই।

পেশায় শিক্ষক এই মানুষটি ছিলেন ষাট এর দশকের কবি। উইকিপিডিয়ায় তাঁর সম্পর্কে লেখা আছে –

কবি জীবনানন্দ দাশের পর যদি কেউ একেবার নিজের কিংবা একেবার আলাদা রকমের সহজ ও সত্য কথা কবিতা লিখে ছিলেন এবং যা পাঠকের মনও ভরিয়ে ছিল, তিনি হলেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী।

কবির স্বীকারক্তিতে ………

“সারাজীবন একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে, আজ দেখি, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমি প্রায় কিছুই করিনি, শুধু কবিতা লেখা ছাড়া। বাংলা কবিতা নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করব, আমার এরকম একটা ইচ্ছে ছিল কমবয়স থেকেই। সেটা বোধহয় স্বপ্নই থেকে গেল। এই সংকলনের জন্যে আমার কবিতার বইগুলো থেকে পছন্দসই কিছু কবিতা বাছতে বাছতে শেষপর্যন্ত বুড়োই হয়ে গেলাম। তথাকথিত ছন্দ ছাড়া আমার কবিতাকে আমি হাঁটতে শিখিয়েছিলাম। আমার নিজের কাছে আমার একটাই দায় ছিল, জ্যান্ত আর নতুন কবিতা লেখার দায়… ( অগস্ট ১৯৯৯ / ভাস্কর চক্রবর্তী)”


নিজের কবিতা প্রসঙ্গে অন্য এক প্রবন্ধে বলেছিলেন –
‘কবিতা লেখার প্রথম থেকেই ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হতো- যে-কোন লাইন থেকেই একটা কবিতা শুরু হতে পারে, আর যে-কোন লাইনেই শেষ হয়ে যেতে পারে সেই কবিতা। কবিতা হবে আপাত সরল। হাজারমুখো। বিষয়ের কোন বাছবিচার থাকবে না। আর কবিতার একটা লাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে কয়েকশ কিলোমিটারের। কিন্তু অদৃশ্য একটা তলদেশে থাকবে মিলিমিটারের নিবিড় সম্পর্ক।’

আমার প্রিয় কবি ও কবিতা সিরিজ পোস্টে আজ কবিত ভাস্কর চক্রবর্তীর কিছু কবিতা ভাগ করে নিলাম সবার সাথে।

জীবন-সংক্রান্ত
……………………………………….

কোথাও সানাই বেজে চলেছে এখন
মানুষেরা বাড়ি ফিরছে সুখ-শান্তি চেয়ে।

আমি শুধু ঘুরি আর
ঘুরে মরি।
চেয়ে দেখি আমার জীবনে

শুধু রাস্তা পড়ে আছে- ধূ ধূ রাস্তা পড়ে আছে শুধু।

লেখো
……………………………………….

ঐ সব চমৎকার খেলা
আমি জানি , আমি
একদা খেলেছিলাম
আমার শহরে ।
আজো এই তুমুল বৃষ্টির দিনে
হে আমার ঘোড়া
তুমি জানো
কেমন মিলিয়ে যেতে পারি আমি —
কেমন আবার
নিমেষে তোমাকে দেখা
দিতে পারি — ফুটপাতে —
চায়ের দোকানে ।
ছিলো বাহাদুরি । আমি
ছিলাম খেলায়
মগ্ন , ওগো
সহসা শুনেছি আজ
নদীর ওপার থেকে
ঘুমের ওপার থেকে —
‘লেখো লেখো ,
ইডিয়ট , লেখো ।’

সে
……………………………………….

সে পেতে রেখেছিলো পুরোনো বিছানা
নতুন ভাবে ঘুমোতে চেয়েছিলো কিছুক্ষণ’

বেড়াতে বেড়াতে ঘুরে এসছিলো সে এক রেলওয়ে কলোনি
ওইখানে, এক দার্শনিক বিড়াল, সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো তাকে-
সে বন্ধ করেছিলো চিঠি লেখা- খবরের কাগজ
ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো সে-

সে খুশী হয়েছিলো কিছু-
সে অনেক খুশী হয়েছিলো- শুধু, অনেক দিন পর
যখন আবার যুদ্ধের কথা ঘুরে ঘুরে উঠেছিলো তার মাথায়
যখন আবার, তার মনে পড়েছিলো
কামানের কথা
শক্ত হয়ে উঠেছিলো তার হাত- সে, সত্যি, কেঁদেছিলো।

বিশাল এই মহাদেশের ছায়ায়
……………………………………….

আমি যে কী করব নিজেকে নিয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

সুদুর কোনো গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে পড়ব?
কান্নাকাটি করব কোনো মেয়ের কাছে গিয়ে?
জীবনটা নিয়ে, সত্যি, একটা ছেলেখেলা করেছি-
পুরোনো প্রেমিকার শোকে আপাতত একটা সিগারেট ধরানো যাক।
কিন্তু বিছানায় এভাবে চিত হয়ে আর কতদিন চলতে পারে?
শীতকাল, আমার আর ভালো লাগে না-
বিছানা থেকে ছোটো বোনকে ডাকি-‘আলোটা জ্বালিয়ে দে’
বিছানা থেকে ছোটো বোনকে ডাকি-‘আলোটা নিভিয়ে দে’
বিষাক্ত একটা জীবন আমি গিলে চলেছি প্রতিদিন
ঐ এসে পড়েছেন হেডলি চেজ
তিনি আজ জানাচেছন আমাদের-অপরাধের পরিণাম কী!

আমার যে হয়েছে কী মুশকিল দিনগুলো আর কাটতেই চায় না।
বন্ধুদের হাতগুলোও এমনই কৃপণ যে কাঁধে পড়ে না
গলাগুলোও এমনই শুকনো যে ঘুম পাড়ায় না আমাকে।
তবে কি ঔষধপত্রই সারাজীবন ছড়িয়ে থাকবে আমার ঘরে?
তবে কি শান্তা সর্ম্পকে আমি আর জানতে পারবো না কিছুই?
‘শাশ্বত’ শব্দটাকে আমি আলমারিতে চাবি-বন্ধ করেছি গতকাল
অশ্তিত্ববাদ নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই
বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকা হয়তো এখন প্রেম করছে শালবনে
সন্ধেবেলায় শুয়ে-শুয়ে আমি একটা মোমবাতির মৃত্যুদৃশ্য দেখছি এখন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১৯
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

বামিঙ্গিয়ান উপাখ্যান

লিখেছেন যুবায়ের আলিফ, ১০ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০




মাঝ রাতে কড়া একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙলো জ্যাকের৷ ঘুমের ঘোরে দেখতে পেল কেউ চোখ ধাঁধানো পোষাক পরে ডাইনিংয়ে একটা চামচ রেখে দরজা গলিয়ে চলে যাচ্ছে৷ গা ও পোষাকের উজ্জ্বলতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×