somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাস্পিয়ান সাগর দর্শন...

২২ শে আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইরানে এসে ছোট একটা কমিউনিটি পেয়েছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু হামিদ আছে এখানে সস্ত্রীক। এছাড়া আবদুল্লাহ আছে ওর স্ত্রী সহ আর আছে লিমন। রুপম নামে আরেকজন ছিল। ও এখন বাংলাদেশে আছে, কয়েক দিনের মধ্যেই আবার আসবে।

এছাড়াও বাংলাদেশী দূতাবাস, রেডিও তেহরান এও কিছু বাংলাদেশী রয়েছে। কিন্তু তাদের সাথে নিয়মিত কোন যোগাযোগ নেই। রমযানে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি নাজমুল ভাই এর বাসায় ইফতারের দাওয়াতে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। এছাড়া ঈদের দিন বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতের বাসাতে ডিনারের দাওয়াতেও অনেকের সাথে দেখা হয়েছে।

তো কাজের বাইরে এন্টারটেইনমেন্ট বলতে এই ছোট গ্রুপের সাথে ঘোরাফেরা আর আড্ডাবাজি। আড্ডার আসর বেশী বসে হামিদের বাসাতেই। আমাদের মধ্যে ওই সবচেয়ে বেশী দিন ইরানে আছে, বেশ ভাল ফারসি বলতে পারে।

গত শুক্রবারে আবদুল্লাহ ভাবী সহ মস্কো গেছে, এক সপ্তাহের জন্য ঘুরতে। বাকী রইলাম আমি, হামিদ, ওর বউ আর লিমন। ভাবলাম এই সপ্তাহান্তে আমরাও কোথাও ঘুরে আসি। ঠিক হল, আমরা ইরানের উত্তরে চালুস যাব, তেহরান থেকে ২০০ কি.মি. পথ। কাস্পিয়ান সাগরের তীরের এক শহর।



১৫ই আগস্ট, দুপুর সাড়ে বারটার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। লিমন ওর এক ইরানি বান্ধবীর কাছ থেকে একটা গাড়ী যোগাড় করেছে। ও ই গাড়ী চালাচ্ছে। যাত্রা শুরুতে আমরা পেট্রোল পাম্প খোজা শুরু করলাম। তেলের দেশ, কিন্তু আমাদের দেশের মত একটু পর পর পেট্রোল পাম্প নেই। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, “পাম্পে বেনজিন কোজা?” মানে পেট্রোল পাম্প কোথায় আছে। বহু ঘুরে শেষ পর্যন্ত বেনজিন মানে পেট্রোল নেয়া হল। যাত্রা হল শুরু... :)

তেহরান পাহাড় ঘেরা শহর। আমরা উত্তরে চলেছি। তেহরান থেকে কারাজ হয়ে তারপর চালুসের পথ।


তেহরান - কারাজের মধ্যে চলাচলকারী দ্বিতল ট্রেন

আলবোরজ পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া আকাবাকা পথ। পথের পাশে পাহাড়ী নদী। নদীর ওপর বেশ কয়েক জায়গায় বাধ দিয়ে দিয়ে ওরা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। রয়েছে একটু পর পর পাহাড় ফুটো করে তৈরী সুড়ংগ। রাস্তার মান বেশ ভাল, গাড়ী চালানোর জন্য আদর্শ।


চালুসের পথে...


এমন অনেক সুড়ংগ চোখে পড়বে...


দৃষ্টিনন্দন পাহাড় ঘেরা রাস্তা...


পাথুরে পাহাড়ের বুক চিরে তৈরী মসৃন রাস্তা...



জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরী কারাজ বাধ...

প্রায় ঘন্টা পাচেকের পথ। সারা পথ জুড়েই একটু পর পর রেস্টুরেন্ট আছে। তবে পথের এই রেস্টুরেন্টগুলোয় খাবারের দাম বেশ গলাকাটা যেমনটা বাংলাদেশেও। তার উপর এরা দাম নির্ধারণ করে কি করে সেটা বোঝাও দুস্কর। এখানকার খুব কমন আইটেম, জুজে কাবাব (মুরগীর কাবাব), কুবিদে কাবাব (ভেড়ার কাবাব), ভাত, জয়তুন (এখানকার বেশ ভাল মানের জলপাই এর সাথে আখরোট মিশিয়ে তৈরী একটা খাবার, আমার খুব প্রিয়), কোক, দুঘ (দুধকে পাতলা করে আরো কিছু ক্যারিক্যাচার করে তৈরী এক প্রকার পানীয়) এসব অর্ডার করা হল। খাওয়া শেষে একটা বড় অংকের বিল ধরিয়ে দেয়। এবার আমার বন্ধু হামিদ ফারসিতে বলে, হিসাব মিলাও। একটু পরে বাংলাদেশী টাকায় ৩/৪’শ টাকা দাম কমে যায়। এরপর মাছ বাজারের মত দামাদামি করে আমরা আরো ৫০/১০০ টাকা কম দিয়ে আসি। হাস্যকর অবস্থা ! ওরা সব কিছুর দামই অনেক বেশী করে ধরেছিল। চিন্তা করে দেখলাম, ফারসি না বুঝলে পুরো ডাকাতি করে ছেড়ে দেবে এরা !! :-*


আলবোরজ পর্বতমালার কোল ঘেষে পথ চলা...

বিকেল নাগাদ চালুস পৌছে গেলাম। সমুদ্র সৈকতে একটু উকি দিয়ে হোটেল খুজতে লাগলাম। বাংলাদেশী টাকায় পাচ হাজারের কিছু উপরে দিয়ে একটা ছোট এপার্টমেন্ট ভাড়া করলাম এক রাতের জন্য। দু’টো রুম আছে। বিচের একদম কাছেই।


কাস্পিয়ান সাগরে সূর্যাস্ত...

সন্ধ্যার পর চারজন মিলে সমুদ্রে ডুব দিলাম। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। ওপরে আকাশে চাদ, যদিও মেঘগুলো একটু জ্বালাতন করছিল। আমাদের ভাবী বেশ ভয় পান পানিতে এগুতে। তিনি জীবনে এর আগে একবারই সমুদ্রে নেমেছেন, কক্সবাজারে। আমি আর লিমন বেশ মজা করলাম। এদিকে হামিদ ভাবীকে নিয়ে যতদূর পারল পানিতে নামল। ঢেউ খুব বেশী না, জোয়ার থাকায় ছোট ছোট ঢেউ ছিল। আমাদের কক্সবাজারে কাছে কিছুই না। ঢেউ এর বারিতে সমুদ্রের সৈকতে লুটিয়ে পড়া বরাবরই আমার একটা প্রিয় খেলা। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পানিতে ডুবেছিলাম।:)

গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পরলাম চালুস শহরের দিকে। সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট দেখে বসে পড়লাম। “মাহী” মানে মাছ অর্ডার করলাম। কাস্পিয়ান সাগরের একটা মাছ (নাম মনে নেই) আর গেজেলালা বা Trout মাছ অর্ডার করলাম। মাছ কোন কিছু ছাড়াই সিম্পলি ভেজে নিয়ে এসেছে। টেবিলে কিছু মসলা রাখা আছে, সব মিলিয়ে নিলাম, খেতে খুব একটা খারাপ লাগল না। আর আমার প্রিয় জয়তুন তো আছেই।



কাস্পিয়ান সাগর সৈকত...

পরদিন সকালে উঠে চলে গেলাম চালুস শহরেই অবস্থিত নামাকাব্রুদ টুরিস্ট পার্কে। যাওয়ার পথে এক দোকান থেকে রুটি কিনলাম, মেশিনে বড় বড় রুটি তৈরী হচ্ছে। আর সাথে নিলাম ক্রিম, পনির, চকোলেট দুধ। গাড়ীতে বসেই নাস্তা সেরে নিলাম। এদের রুটির দোকানগুলোও দেখার মত। স্তুপ করা আটার বস্তা, আর মেশিনে তৈরী হচ্ছে বিশাল বিশাল রুটি। লোকজন লাইন দিয়ে সেই রুটি কিনছে।

যাহোক, নামাকাব্রুদ পার্কে ওরা যেটা করেছে, মাটি থেকে পাশের পাহাড়েরর চূড়া পর্যন্ত দু’টো ক্যাবল কার তৈরী করেছে। এছাড়াও পাহাড়ের কোলে কিছু রাইড তৈরী করেছে। সব মিলিয়ে ভালই আয়োজন। ছুটির দিনে ইরানিরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি, এরা তাবুর বেশ ভাল ব্যবহার করে। সমুদ্রের সৈকতে একটা ফ্যামিলি সাইজ তাবু খাটায়, সাথে গাড়ীতে করে চুলা নিয়ে আসে, বাজার নিয়ে আসে, সৈকতেই রান্না করে। তারমানে থাকা, খাওয়ার জন্য কোন বাড়তি খরচই করতে হয় না। সিস্টেমটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

কেবল কার থেকে তোলা এবং পাহাড়ের চূড়ায় কিছু ছবি দেখুন। পাহাড়ের চূড়ায় আবহাওয়াটা ছিল চমৎকার।









পাহাড় থেকে নেমে একটা রাইডে চড়লাম। মান দিয়েছে এলপাইন কোস্টার। অনেকটা রোলার কোস্টারের মতই, তবে এতে রাইডারের হাতেও কন্ট্রোল থাকে, এক্সেলারেট এবং ব্রেক করার। সব মিলিয়ে ভালই লাগল।

আমাদের হাতে সময় কম। তেহরান ফিরতে হবে, কারণ তেহরানে ফেরার পথে যানযটে পড়তে হতে পারে। চালুস থেকে বের হতে গিয়ে কিছু যানযটে পড়েছিলামও। কিন্তু পরে আর সমস্যা হয় নি।


চালুস থেকে তেহরান ফেরার পথে...


পথে এক হোটেলের ব্যালকনি থেকে...

এদের কিছু ভাল ব্যবস্থা আছে। যেখানে প্রচুর ট্যুরিস্ট যায়, সেসব জায়গায় দুপুরের পরেই তেহরান থেকে যাওয়া বন্ধ করে রাস্তা একমুখি করে দেয় যাতে লোকজন্য নির্বিঘ্নে ফিরতে পারে। আর সপ্তাহ শেষ হলেই তেহরানের আশে পাশে ঘুরতে চলে যাওয়াটা ইরানিদের জন্য খুব কমন একটা ব্যাপার। সূর্য ডোবার আগেই আমরা তেহরান ফিরে এসেছিলাম। খুব স্বল্প সময়ের ভ্রমন হলেও খুব উপভোগ্য একটা যাত্রা ছিল। পাহাড়ের সৌন্দর্য পুরো পথেই আমাদের মোহিত করেছে...

আমার যত ভ্রমন ব্লগ...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:০৬
৪০টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×