somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নোরুজ ঘোরাঘুরি – তাবরিয ভ্রমন (শেষ পর্ব)

২৮ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের রাতের ধকলের কারণে রাতের ঘুম একটু দীর্ঘই হল সবার। নাশতা করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। এর মধ্যে মেকানিক আসল। সিদ্ধান্ত হল, গাড়ি ওদের কাছে দিয়ে যাব, বিকেলের মধ্যে গাড়ি ঠিক করে রাখবে। আমরা তিন গাড়ির যাত্রী দুই গাড়িতে করে যাব।

তাবরিয থেকে কান্দুভানের দূরত্ব ৫৫ কি.মি.। পাহাড়ের মধ্যে পাথর কেটে বানানো ৮০০ বছর পুরনো ঐতিহাসিক এক গ্রাম। এটাই আমাদের দ্বিতীয় দিনের প্রথম গন্তব্য। বলা হয়ে থাকে সাহান্দ পর্বতের আগ্নেয়গিরির নিসৃত উপাদানও এই গ্রামের পাথরগুলোকে তৈরী করেছে। এই পাথরগুলোর বিশেষ বৈশিষ্টের কারণে পাথর কেটে বানানো ঘরগুলো গরমের দিনে ঠান্ডা থাকে আর ঠান্ডার দিকে থাকে উষ্ণ!

পার্সিয়ান নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে ঐ দিনটি ছিল “সিসদাহ বেদার” দিন। সিজদাহ বেদার বা রুযে তাবিয়াত বা প্রকৃতির দিন হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। এটির উৎসকাল ইরানের প্রাচীন ধর্মের নবী যারতুস্তের আগমনেরও পূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দে। প্রাচীন ইরানে নওরোজ উৎসব পালনের পর ফারভারদিন মাসের ত্রয়োদশতম দিনটি (যেটি ছিল আমরা যেদিন কান্দুভান যাচ্ছি, ২ এপ্রিল ২০১৫), তখনকার বিশ্বাস মতে বৃষ্টির সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। লোকজন এই দিনে মরুভূমি, উন্মুক্ত প্রান্তর, ঝরনার প্রান্ত, পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্রে অবস্থান করেন এবং অত্যন্ত আনন্দ-উৎফুল্লতা এবং হর্ষধ্বনিতে মেতে উঠতেন। সঙ্গে বৃষ্টির জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় নত হতেন। আবার কোনো কোনো গবেষক ফারভারদিন মাসের ত্রয়োদশতম দিনকে বছরের প্রথম কৃষিকার্যের সূচনা দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নববর্ষের শুরুতে ইরানিরা ছোট ছোট মাটির খন্ডে জন্মানো ঘাস ঘরে নিয়ে সাজায় আর সিসদাহ বেদার দিন সেটাকে আবার প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিয়। যেহেতু রাস্তা ঘাটও প্রকৃতির অংশ বটে তাই রাস্তাতেও প্রচুর ঘাস পড়ে থাকতে দেখা গেল! :)

সিসদা বেদার কারণেই রাস্তায় গাড়ির অভাব নেই। আজকে কেউই ঘরে থাকবে না, সবাই চলে যাবে প্রকৃতির কাছে। মোটামুটি ভীড় ঠেলে আমরা গাড়ি নিয়ে আগাতে থাকলাম।


তাবরিযের উপকন্ঠে গড়ে উঠছে নতুন শহর...

তাবরিয শহর থেকে বের হওয়ার পর রাস্তা ঘাট বেশ ফাকা, দুপুর নাগাদ কান্দুভান পৌছে গেলাম। কান্দুভান পৌছে পাহাড়ের গা কেটে তৈরী ঘরগুলো দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। দূর থেকে দেখলে মানুষের বসতি মনে হয় না, মনে হয় যেন কোন পোকা মাকড়ের ঘর বসতি।


ঐতিহাসিক কান্দুভান গ্রাম

এসব ঘরে কেউ চাইলে টাকা দিয়ে রাত্রিযাপনও করতে পারেন। সময় স্বল্পতার কারণে আমাদের সে সুযোগ ছিল না। তবে আমরা সেখান থেকে মধু কিনলাম। নীচের দোকান থেকে আখরোটও কিনলাম। দুপুরে খাবার সারলাম জুজে, কুবিদে, চেলো গুশত, এই ধরণের ইরানি খাবার দিয়ে।

কান্দুভানের আরো কিছু ছবি দেখুন।


পাথর কেটে তৈরী করা হয়েছে ঘর


চাইলে রাতে থাকতে পারেন ঘর ভাড়া করে


দোকানিরা তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে


এখন অবশ্য বিদ্যুৎ সংযোগও আছে


কান্দুভান থেকে দেখা আশে পাশের নৈসর্গিক দৃশ্য

বিকেল ৪ টা নাগাদ আমরা ফেরা শুরু করলাম, কারণ আরো কয়েকটি জায়গা দেখে যেতে চাই। তাবরিযে ফিরে দেখি বন্ধু হামিদের গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। তাবরিয শহরে একটি কেবল কার আছে যেটি দিয়ে এইনালি পাহাড়ের ওপরে চলে যাওয়া যায় আর পুরো তাবরিয শহর দেখা যায়। এটাও আমাদের দেখার তালিকায় ছিল। বিকেল ৬ টা নাগাদ পুরো বহর নিয়ে আমরা রওনা হলাম কেবল কার স্টেশনের উদ্দেশ্যে। মোটামুটি কাছাকাছি পৌছে গেছি, তখন শুনি বন্ধু হামিদের গাড়ি আবার নষ্ট হয়ে গেছে! :(( ওরা আবার গাড়ি ঠিক করার জন্য রয়ে গেল। মনের দুঃখ মনে নিয়ে আমরা বাকী দুই গাড়ির ভ্রমনকারীরা কেবল কারে উঠলাম। :(


তাবরিয শহর - পাখির চোখে...


মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি


অদ্ভূত সুন্দর প্রকৃতি

ওপরে বেশ ঠান্ডা বাতাস ছিল। তাই আমরা আর ওপরে না থেকে নেমে পড়লাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে, তখনো অনেক আলো ছিল। দেরী না করে আমরা নীল মসজিদ (Blue Masjid) এর দিকে রওনা হলাম। পৌছাতে পৌছাতে পৌনে আটটা বেজে গেল। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। সাধারণতঃ এই মসজিদে ২৫০ টাকা টিকেট কেটে ঢুকতে হয়, কিন্তু নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়াতে বিনে পয়সায় ঢুকে গেলাম। ;) মাগরিবের নামায ওখানেই আদায় করলাম।


নীল মসজিদ বা Blue Masjid


কম্পাউন্ডে কারু কার্য খচিত করিডোর


মসজিদের প্রবেশ দ্বার


মসজিদের ভেতর



আমরা দুই গাড়ি এক সাথে ছিলাম আর হামিদের গাড়ি ঠিক করা হচ্ছিল।

মসজিদ থেকে বের হয়ে পাশের ছোট্ট পার্কে কিছু সময় কাটিয়ে হেটে স’আত টাওয়ারের দিকে গেলাম। এটাও তাবরিযের একটা দর্শনীয় স্থান। ফারসিতে স'আত মানে সময় বা ঘড়ি। স'আত টাওয়ার মানে হল আসলে Clock Tower।



দুই দিনের ঝটিকা সফর, কারণ আর এক দিন পরেই নোরুজের ছুটি শেষে অফিস খুলে যাচ্ছে। তাই তেহরান ফিরতে হবে। রাত প্রায় ৯ টা নাগাদ তেহরানের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শিরাযের ট্যুরে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে রাত বেড়ে গেলে প্রচন্ড ঘুম পায়। ইরানিদের দেখেছি, ওরা রেস্ট কমপ্লেক্স দেখলেই গাড়ি পার্ক করে গাড়িতেই ঘুমিয়ে নেয়। ভাবলাম, এবার আমিও তাই করব। কারণ, শিরায থেকে তেহরান ফিরতে খুব কষ্ট হয়েছিল, মাঝে মাঝে তো মনে হয় ঝিমুনির মধ্যেই কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়েছি যেটা ঝুকিপূর্ণ। তাই রাত তিনটার পর কোন এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ঘুম দিলাম। ভোরে উঠে দেখি, রাস্তায় শত শত গাড়ি! মানে সবাই ঘুম থেকে উঠে আবার রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু আমার যে সমস্যাটা হল, ২/৩ ঘন্টা ঘুমানোর পর ঘুম অপূর্ণ থাকাতে চোখ খোলা রাখতেই পারছিলাম না! ভাগ্যিশ তেহরান থেকে এক দেড়শ কি.মি. দূরে ছিলাম। বহু কষ্টে ঐ পথটুকু পাড়ি দিয়ে বাসায় এলাম। এরপর থেকে শিক্ষা নিলাম, রাতে আর গাড়ি চালানো নয়। পরবর্তী প্রতিটা ভ্রমনে আমি এমনভাবে রওনা দিতাম যাতে রাত সাড়ে বারটা থেকে একটার মধ্যে বাসায় থাকতে পারি। এবং মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই রেস্টুরেন্টে বসে রাতের ডিনার খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ ওটার জন্য থামলেই প্রায় দেড় ঘন্টা চলে যেত আর গভীর রাতে ড্রাইভিং করতে হত।

ইভেন্টফুল ট্রিপের উপসংহারঃ আমার বন্ধু তার মেরামত করা গাড়ি নিয়ে সরাসরি রওনা দিয়ে দিয়েছিল, ওরা আমাদের সাথে নীল মসজিদ বা স’আত টাওয়ারে আসে নি। কিন্তু, ফেরার পথে তেহরানের উপকন্ঠ ক্যারাজে এসে ওদের গাড়ি আবার নষ্ট হয়ে যায়! শেষ পর্যন্ত ও গাড়ি গ্যারেজে দিয়ে ট্যাক্সি করে বাসায় ফিরে আসে। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর সেই গাড়ি নিয়ে আসে। গাড়িটা ভালই ভুগিয়েছিল ওদের। আর এভাবেই আমাদের গত বছরের নোরুজ ঘোরাঘুরির সমাপ্তি হল।

সিসদাহ বেদারের তথ্য সহযোগিতা নিয়েছি মুমিত ভাইয়ের এই লেখা থেকেঃ ইরানের নওরোজ উৎসবে বাংলাদেশ
নোরুজ ঘোরাঘুরি – তাবরিয ভ্রমন (পর্ব - ১)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×