বাসযোগ্য পৃথিবীতে সবচেয়ে অযোগ্য শহরের নাম ঢাকা। এমন এক কলঙ্কে ঢাকাকে ঢেকে দেয়া হয়েছে যা নাকি শতাধিক পয়েন্টের অগণিত সূচকের মানদন্ডে নির্ধারিত। বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রের তকমা সাঁটাতে ব্যস্ত দ্যা ইকনোমিষ্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সর্বশেষ মেধাবী উদ্যোগ ও আবিস্কার এটি। অথচ কয়েক বছর আগে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এলএসই (লন্ডন স্কুর অব ইকনোমিক্স)’র এক জরিপে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানটি ছিল বাংলাদেশের। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশের রাজধানী সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য শহর হবে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য! জানি এ শহরের অনেক বিচ্যুতি আছে; তবুও ভালোবাসি ঢাকা, এ আমার চারশত বছরের অহংকার। আমি শুধু একটি বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত উপলব্ধি শেয়ার করবো।
যে কোন বিচারে ঢাকা একটি অতি জনঘনত্বের মেট্রোপলিটন শহর। কিন্তু ঢাকাকে কসমোপলিটন শহর বোধহয় বলা যায় না। বড় শহর হলেই মেট্রোপলিটন শহর হয়। নানা দেশের নানা বর্ণ, ধর্ম, সংস্কৃতির মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে বাস করতে পারে তাকেই কসমোপলিটন শহর বলা হয়। সাধারণত মেট্রোপলিটন শহরই সমৃদ্ধির পথে ধীরে ধীরে পরিনত হয় কসমোপলিটনে। ঢাকার মত হাতে গোণা কিছু শহর হেঁটেছে ইতিহাসের উল্টো রথে। ইউরোপের অধকিাংশ মেট্রোপলিটন শহরই একসময় সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ক্রীতদাস, বিধর্মী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিংবা প্রতিদ্বন্দির রক্তে সিক্ত হয়নি পাশ্চত্যে এমন প্রাচীন শহর খুঁজে পাওয়া দুস্কর। উপমহাদেশের সম্পদ লুট করে নিয়ে আজ তারা বিশ্ব সভ্যতার ধারক ও বাহক। সেই তুলনায় বাঙালি বোধহয় পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি জাতির ভিতর একটা যারা কোনদিন পরসম্পদ লোভে অন্যকোন দেশ বা জাতিকে আক্রমন করে নাই। বরং পৃথিবীর ভাগ্যান্বষণী প্রায় সকল জাতিই এখানে এসেছে। কেউ কেউ বাণিজ্যের আড়ালে ধর্মপ্রচার, শাসন-শোষন, নির্যাতনও করেছে। ৪০০ বছরের ইতিহাসে এটি একসময় কসমোপলিটন শহর ছিল বোঝা যায়। পর্তুগীজ, ইংরেজ, গ্রীক, ডাচ, আরব, মোগল, পাঠান, আর্মেনিয়ান..বহু জাতি এখানে দীর্ঘদিন পাশাপাশি ছিল। নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম-সংস্কৃতির নিরবিচ্ছিন্ন চর্চা করে গেছে নিরুপদ্রোপভাবে। ইংরেজ উপ্ত দ্বিজাতি-তত্ত্বে¡র দুষ্ট রাজনীতির বীজ কসমোপলিটন শহরকে উল্টো মেট্রোপলিসে পরিনত করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি প্রতিটি শহরকেই তারা পরিনত করতে চেয়েছে সাম্প্রদায়িক শহরে।
এই শহরে আমি একজন ভাড়াটিয়া। যদিও জীবনের অর্ধ্বেকের বেশী সময় কেটেছে এই শহরে, সেই স্কুল পাশ দিয়ে ঢাকায় আসা..তাই অন্যরকম এক মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে আছে এই শহর। ঢাকা শহরের মোগল সাম্রাজ্য মোহাম্মদপুর ছেড়ে টিকাটুলি এসেছি বছর খানেক হলো। এই এলাকায় থাকার কারণে ইদানিং মনে হয় আমার বসবাস ইতিহাসের সাথে। ঢাকা শহরকে বলা হয় মসজিদের শহর। বাস্তবতাও তাই। পৃথিবীর অন্যকোন শহরে এত মসজিদ রয়েছে বলে মনে হয়না। তবুও শুধু মসজিদের শহর বললে কিছু ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। মনে হয় সবচেয়ে বড় ইসলামী শহর। অথচ একদা এটি বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শহর ছিল। টিকাটুলি আমার কর্ম ও অস্থায়ী বাসস্থান সংলগ্ন কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্তভূমি। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের খুব ঐতিহ্যবাহী শীর্ষ স্থানীয় অনেকগুলো ধর্মীয় উপাসনালয়, স্থাপনা কিংবা তীর্থভুমি। সবগুলোর অবস্থান খুবই কাছাকাছি অথচ মৌলবাদীরা অনেকবার চেষ্টা করেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাঁটল ধরাতে পারেনি।
১৭০০ শতকে নির্মিত নারিন্দা খ্রিস্টান কবরস্থানকে যদি কেন্দ্র করি তবে তার দক্ষিণের গা ঘেষে রয়েছে হিন্দু ধর্মীয় গৌড়ীয় মাধব মঠ। নারিন্দায় শ্রী সিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ ১৯২১ সালে এ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এ মন্দিরে রয়েছে কৃষ্ণ মন্দির, নাটমণ্ডপ ও যাত্রীনিবাস। শ্বেতপাথরে নির্মিত কৃষ্ণ মন্দির এবং নাটমণ্ডপটি অত্যন্ত দর্শনীয়। পূবে তার সাথেই লাগোয়া বিখ্যাত নারিন্দার পীর সাহেবের মাজার। দক্ষিণে তার উল্টোদিকে রয়েছে গীর্জা ও সাধু জোসেফের কারিগরি স্কুল। রাস্তার উল্টেদিকে পূবে স্বামীবাগের আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন)। এটি ইসকন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় আশ্রম। এখান থেকে কয়েকশত গজ দক্ষিণে স্বামীবাগ লোকনাথ ব্রহ্মচারী মন্দির। শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠা মথুরামোহন মুখোপাধ্যায় ১৯০৫ সালে এ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এর সামন্য পরেই রয়েছে দুই শতাধিক বছরের পুরনো রাম সাহা মঠ মন্দির ঢাকার সর্বোচ্চ মন্দির হিসেবে পরিচিত। নবরত্ন এ মন্দির জমিদার রাম সাহা নির্মাণ করেন। তাঁর নামানুসারেই এর নাম রাম সাহা মন্দির। এই মন্দিরের বাহ্যিক অলংকরণ এবং ভেতরের কারুকাজ বিস্ময়কর। এ মন্দিরে শিব নিত্য পূজিত হন। এ মন্দিরের একটু উত্তরেই রয়েছে মেথর পট্টির বৈষ্ণব মন্দির। আর একটু পশ্চিমে এগুলেই ৮৪নং বনগ্রাম রোডের রাধা-গোবিন্দ জিউ ঠাকুর মন্দির। এটি নাকি ৫০০ বছরের ঐতিহাসিক মন্দির। এর পাশেই ঠাটারী বাজরে রয়েছে ১৫৯৩ সালে শ্রী তুলসি নারায়ণ ঘোষ এবং শ্রী নব নারায়ণ ঘোষ কর্তৃক নির্মীত জয়কালী মন্দির।
এর উল্টেদিকে টিকাটুলিতে রয়েছে ২৫০ বছরের পুরনো রাম-সীতার মন্দির (সম্ভবতঃ দেশে দুটি মাত্র রাম-সীতার মন্দির রয়েছে)। টিকাটুলিতে রয়েছে হিন্দু ধর্মালম্বীদের অরো কয়েকটি প্রধান মন্দির। গোপীবাগের মুখেই রয়েছে দেশের প্রধান রামকৃষ্ণ মিশন, পাশের অভয় দাস লেনে ভোলাগিরী আশ্রম, টিকাটুলির মোড়ে রয়েছে প্রভু জগদ্বন্ধু মহাপ্রকাশ মঠ। বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির কিংবা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমও এখান থেকে খুব বেশী দূরে নয়। শতশত বছর ধরে খুবই পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ। স্বার্থন্বেষী লুটেরারা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে ফায়দা লোটার। কিন্তু সম্প্রীতি এখানো অটুট রয়েছে। এরকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কয়টি শহরে আছে জানা নেই। সামাজিক স্থিতিশীলতা কিংবা নিরাপত্তা এখানে খুবই কম সত্য কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে এখানে কেউ কাউকে দেখে না। আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে। হাজারো ত্রুটি বিচ্যুতির পরও তাবু ভালোবাসি ঢাকা।