‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ একটু অশ্লীল শোনালেও বহুল ব্যবহৃত ব্যাকরণসিদ্ধ একটি খাঁটি বাংলা প্রবাদ, যার যথার্থ উপমা পটুয়াখালীর শহুরে মধ্যবিত্তের লঞ্চ যাত্রায় কেবিন প্রীতি বা কেবিন নির্ভরতা। শহরটি যেহেতু ছোট সবাই সবার পরিচিত, সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় তাই সামর্থের বাইরে হলেও হাজার টাকা ব্যয়ে তাকে লঞ্চের কেবিনেই যেতে হয়। হোক সে ছাত্র, চাকুরিজীবি বা ব্যবসায়ী, সক্ষমতা যতই সীমিত হোক পৌর এলাকার স্থায়ী মধ্যবিত্ত হলেই এই বাবুগিরিতে সে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়।
অথচ এই শহরে অন্তত কয়েক ডজন পুরোধা ব্যক্তির নাম বলতে পারি সক্ষমতায় তারা শহরের শীর্ষ স্থানীয় হলেও সারা জীবন তারা ডেকেই চড়েছে, যাপন করেছেন এক মিতব্যয়ী জীবন। এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ী, আমাদের বন্ধু নান্নুর বাবা ইদ্রিস সাহেব, জনতা বস্ত্রালয়ের বাবু পাল, রায়বিপনীর শ্যাম লাল রায়, বস্ত্র ব্যবসায়ী যতীন সাহা, দিপকদার বাবা অনীল দাস, গৌরাঙ্গ বস্ত্রালয়ের মালিক,স্টাইলিষ্ট ম্যান জনপ্রিয় কমিশনার গৌরাঙ্গ সাহা, মানিক ভাইর বাবা, জনতা মেডিকেলের মালিক, বাজিতার জমিদার পরিবারের সন্তান আলতাফ মজুমদার, চিত্ত রায়, ফণি দাস, করিম মৃধা এমনকি চিরকুমার বলরাম বণিক..আমার জানা মতে সারা জীবন তারা ডেকের যাত্রী ছিলেন, কখনোই আমাদের মত কেবিন রিজার্ভেশন করার প্রয়োজন বোধ করেননি। বাবু হয়েও বাবুগিরি দেখাননি কোনদিন।
আমরা এই প্রজন্ম যদি সিদ্ধান্ত নেই (পরিবার না থাকলে) এখন থেকে আমরা ডেকেই যাতায়ত করবো, তবে নতুন প্রজন্ম উৎসাহী হবে অহেতুক বাবুগিরি বন্ধ করতে। অস্বীকার করবো শহরের সন্তান যারা তরুন কর্মজিীবি অধিকাংশের ক্ষেত্রেই হয়তো কেবিনে যাওয়ার উপযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটা ক্ষয়িষ্ণু পরিবার ছাড়া শহরের সকল পরিবারের সক্ষমতা অতীতের চেয়ে বেশী হলেও তার মানে এই নয় কেবিনে যাওয়ার মত যথার্থ উপযোগিতা তৈরি হয়েছে। এটি এখনও আমাদের জন্য ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’। তাই আসুন আমরা ডেকের যাত্রী হই; সবান্ধব বাড়তি বিনোদনের জন্য নয় বাস্তব চাহিদা পুরণে কেবিন বিলাসিতা ত্যাগ করা খুবই প্রয়োজন। আমরা শুরু করলেই হয়।
একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ১৯৮৯ সালে আমি যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই আমার বাবা তখন বরিশাল জেলা পরিষদে চাকুরী করে। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের সংসারে আমার চাচা, চাচাতো ভাই-বোনরা, মামা, খালা অর্থাৎ নিকটতম আত্মীয় প্রায় সকলেই পটুয়াখালীতে আমাদের বাসায় থেকে, আমার মায়ের হাতের ভাত খেয়েই স্কুল, কলেজ পাশ করেছে (আজকের বউদের কাছ থেকে যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা!)। বাড়তি খরচ হিসেবে নতুন যোগ হলো আমার ঢাকায় পড়াশোনার বাড়তি শিক্ষাব্যয়। অবশ্য আমাদের চার ভাই বোনেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যয় নিভৃতচারী বাবাকেই যথাবিহীত বহন করতে হয়েছে। নতুন লেপ তোষক নিয়ে বাবা এলেন বরিশাল সদরঘাটে তার অবাধ্য মধ্য ছেলেকে লঞ্চে তুলে দিতে। নতুন বেডিংয়ে বিছানা হলো লঞ্চের ডেকে। অশ্রু সজল চোখে বাবা বিদায় নেয়ার আগে বললেন ‘আব্বু, মনে রাখিস-শুধু পড়াশোনা করার জন্যই যাচ্ছিস, সো নো ফরমালিটিস, একটু কম খরচে চলার চেষ্টা করিস-তুইতো এখন আর ছোট না সবই বুঝ’! আমি আসলে বুঝি নাই, সেই শেষ কৈশরেও বাবাকে কৃপনই মনে হলো। যথারীতি বাবার কথা আমি রাখিনি। একা বা সদলবল যাই হোক কেবিনেই চড়েছি সেই ছাত্র জীবন থেকেই, বাবাকে বোকা বানিয়ে। বাপের টাকায়ই ফুটানি করেছি শুধু ভাউচারটা দিয়েছি অভিনব সব অতীব প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র তৈরি করে। আজ যখন আমি কর্মজীবি তখন প্রতি পদক্ষেপে বাবার কথাই মনে পড়ে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি সামান্য আট আনার জন্য সব্জিওয়ালার সাথে বাবা কেন ঝগড়া করতেন। ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন, বনষ্পতির ছায়া দিলেন গাছেরই মতন’। তারপর একদিন মরেও গেলেন। বাবাকে হারানোর ১৫ বছর পর আজ উপলব্ধি করি একদিন আমার সন্তানওতো এমনি আচরণ করবে আমার সাথে যা করেছি আমরা আমাদের পিতাদের সাথে।... ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাহিনী কথনের জন্য মাফ করবেন। তবে সবারই মাথায় থাকা উচিত আমরা যদি মিতব্যয়ী না হই অনাগত প্রজন্মের ভবিষ্যত নির্মাণ অনেকটাই কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে।