সময়ের নিয়মে সময় চলে যায়,কেউ কারুর জন্য বসে থাকে না।শুধু বাসনা মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে গভীর রাত্রে খাটের উপর জেগে বসে থাকে।এখনও তার আশা,বুঝি হঠাৎ ফিরে আসবে মনোরন্জন।
.....................................................................................
মোটমাট চার-পাঁচটা বাঘ ওঁত পেতে আছে বাসনার দিকে।যে-কোন দিন লাফিয়ে পড়বে,খাবে।জংগলঘেঁষা দেশে এটাই নিয়ম।
বাসনা অবশ্য এ পর্যন্ত কারুকে ধোরা ছোঁয়া দেয়নি।একমাত্র সেই প্রত্যেকদিন এখনও মনোরন্জনের কথা মনে করে অন্তত একবার।প্রায়ই মুচড়ে মুচড়ে কাঁদে।শুধু স্বার্থও নয়,আরও কিছু একটার সম্পর্ক ছিলো মনোরন্জনের সঙ্গে।তার মাত্র আট মাসের বন্ধন,টারপর এক বছর কেটে গেছে,তবু সেই বন্ধন আরও তীব্র মনে হয়।
কিন্তু এই অবস্থা আর কতদিন চলবে?মাত্র একুশ বছরের ডবকা চেহারার মেয়ে বিধবা হলে তারপর বাকি জীবনটা সে নিখুঁতি সন্দেশটি হয়ে থাকবে?কেউ তাকে খাবে না?এই কথা বললে এই জল-জংগল বাদা এলাকার একটা গরুও বিশ্বাস করবেনা।বাসনা নিজেও এই কথা জানে,সে নিজেও তো আর কম দেখেনি।
এক এক দিন বাসনা নিদ্রাহীন চোখে আর খাটে শুয়ে থাকতে পারে না,বাইরে এসে দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে সামনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে।ঐ অন্ধকারের মধ্যে সে তার ভবিষ্যৎটা খোঁজে।মা নেই,তার বাপ আর কোনোদিন তাকে কাছে ডেকে নেবে না।শ্বশুরের অথর্ব হতে আর বেশীদিন বাকি নেই।ননদের বিয়ে দিতে হবে,তাতে কিছুটা জমি চলে যাবে।আধপেটা খেয়ে,মান খুইয়ে,শাশ্বুরড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে কাটাতে হবে সারা জীবন।আর নয়তো........................।
শুধু একজন নেই।অথচ দুনিয়াটা যেমন চলছিল,তেমনি চলছে।মনোরন্জন থাকলে সে তার শক্ত কাঁধ দিয়ে এই সংসারটাকে তুলে ধরতে পারতো।সে নেই,সে আর আসবে না।
হাওয়া নেই,রাতচরা পাখির ডাক নেই,মাঝে মাঝে কিট কিট কিট কিট শব্দ করছে ঘাস ফড়িং,টুপ টাপ করে খসে পড়ছে গাছের পাতা,কোঁয়াক কোঁয়াক করে ডাকছে ব্যাঙ,তাদের ধরবার জন্য সরসর শব্দে এগুচ্ছে সাপ,সামনে খালটা থেকে উঠে আসছে পাট পচানো জলের গন্ধ,চাঁদ ডুবে গেল মেঘের তলায়।চমৎকার,ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার,বনে কোনও এক বুড়ি হুতোম প্যাঁচা গাছের ডাল থেকে উড়াল দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে,চিক চিক চিক চিক শব্দে পালাতে লাগলো ইঁদুর-ছুঁচোরা,দূরে একটা কুকুর অকারনে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কয়েকবার।
জীবন বয়ে চলছে জীবনের নিয়মে..................................................।
মাঝরাতের অন্ধকারে বাসনাকে একলা একলা বসিয়ে রেখেই কাহিনীকারকে বিদায় নিতে হবে।এই মেয়েটির জীবনে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে দেবার মতন কলমের জোর তার নেই।ইচ্ছে মতন শেষ পরিচ্ছেদে সোনালী সুর্য এঁকে দেবার উপায়ও তার নেই।বাস্তবতার দোহাইতে সে লেখকের হাত বাঁধা........................................................................................।
"সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়"-র "জল-জঙ্গলের কাব্য" উপণ্যাস থেকে গৃহীত।