somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আফ্রিকার গল্প - ২

০১ লা এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘোবাশি গেরস্থালির একটি ঘটনা

[আলিফা রিফাত(১৯৩০-১৯৯৬) বিতর্কিত মিশরীয় লেখিকা।তার গল্পগুলি অনেক ভাষার অনুদিত হয়েছে। ইংরেজীতে তার শ্রেষ্ঠ কর্ম Distant View of a Minaret]



লাল মোরগটার কর্কষ চিৎকারে জেগে উঠলো জীনাত, তার শোবার জায়গা বরাবর ছাদের উপর থেকে ডেকে উঠেছে ওটা। ঘোবাশি বাড়িটা গ্রামের ঠিক এক প্রান্তে, যেখান থেকে ক্ষেতগুলি নদী আর রেললাইন পর্যন্ত ছড়ানো।

লাল মোরগটার ডাকে আশে পাশে ছাদের উপর থেকেও প্রত্যুত্তর দেয়া শুরু হয়ে গেলো। এদের ডাকাডাকি নীরব হলো মালবেরী গাছগুলির মধ্যকার উচুঁ মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের আওয়াজে, “ঘুমানোর চেয়ে নামাজ উত্তম।”

পাশে ঘুমানো বাচ্চাগুলির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওদের গায়ে পুরনো কাপড়ে সেলানো কিলিমটা ভালোমতো টেনে দিল, এর পর বড় মেয়েটার কাঁধ ধরে ঝাঁকালো।

“ভোর হয়ে গেছে, খোদার দেয়া আরেকটা ভোর। উঠ্‌ নিমা --- আজকে হাটের দিন।”

নিমা চিৎ হয়ে শুয়ে অলসভাবে আড়মোড়া ভাঙছিল। যেন একটা দমকা হাওয়া থাপ্পড় মেরে গেছে এমন ভাবে জীনাত সামনের বিস্রস্ত দেহটার দিকে তাকালো। নিমা উঠে বসে জেলাবাটা তার উরুর উপর টেনে দিয়ে, গোলমত মুখে বসানো সুশ্রী কপোলের উপরের ঘুমে-ভারী চোখ দু’টো কচলাতে লাগলো।

“মা, তুই কি খরিফ নিয়ে হাটে যেতে পারবি, নাকি ওটা তোর জন্য অনেক ভারী হয়ে যাবে?”

“অবশ্যই পারবো মা, তাছাড়া আর কে ই বা আছে যাবার জন্য?”

জীনাত পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে ধীর পদক্ষেপে বাইরের উঠোনে গিয়ে ওজু করে। এর পর নামাজ শেষে বসা অবস্থায়ই হাতের কড়া গুনে আল্লার দয়ার কথা ভাবতে শুরু করে। নিমা ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে এটা বুঝতে পেরে পেছনে ঘুরে তাকায়।

“তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গিয়ে চা বানাচ্ছিস না কেন?”

জীনাত ঘরের কোনাটায় হেটে গেলো ঘোবাশি যেখানে বস্তার মধ্যে ভূট্টার দানা ভরে রেখে গেছে। এগুলি সে তাদের জন্য ব্যবস্থা হিসেবে রেখে চলে গেছে। তার অফিস তাকে বিমানের টিকেটসহ লিবিয়ায় কাজ পাইয়ে দিয়েছে, ওখান থেকে ফিরবে এক বছর পর।

“যতদিন দূরে আছ, খোদা তোমার নিরাপদে রাখুক, ঘোবাশি। ” বিড়বিড় করে বললো।

বস্তার সামনে হাটু গেড়ে বসে, পাল্লাটা উরুর উপর রেখে সে দুই হাতে ভূট্টা ঢালতে লাগলো যতক্ষণ না মাপ শেষ হয়। এর পর একটা ঝুড়িতে ঢেলে দিল। কাশতে কাশতে ধূলা ঝেড়ে উঠে দাড়িয়ে কাজে ফেরত গেলো।

মেয়েটা গেলো বড় মাটির পাত্রটার কাছে, কাঠের ঢাকনিটা উঠিয়ে মগটা ডুবিয়ে উঠালো, আর নিজের মুখে পানির ছিটা দিল। তার আঙুলের ডগাগুলি ভিজিয়ে, চুলের বেনীদুটো আলাদা করে মাথার উপর রুমাল বেঁধে নিল। তার মায়ের দিকে ফিরে,

“যথেষ্ট হয় নি মা? আমাদের এত টাকার দরকার কেন?”

জীনাত হাটুর উপর হাত রেখে মাথা পেছনে নিল।

“আমাদের কি হামদানের মজুরী দিতে হবে না? – নাকি সে শিমের চাষ করে দিয়েছে এমনি এমনি? না কি খাটা খাটনির করতে পারবে এই খুশিতে?”

নিমা ঘুরে গিয়ে জানালার তাক থেকে চুলাটা নিয়ে এলো, শুকনো ভুট্টার ছোবড়াগুলি পিরামিডের মত করে সাজিয়ে জ্বাল ধরাল। এটাকে তার মায়ের পাশে রেখে কেটলীটা পানিতে ভরে আগুনে চাপিয়ে দিয়ে হাটু গেরে বসলো। দুজনেই নীরব। হঠাৎ জীনাত বললো,

“মহিষটা কতদিনের জোয়ান?”

“আব্বা যাবার পরপরই।”

“তার মানে বড় ভোজের ঠিক পর পর?”

নিমা স্বীকৃতিতে মাথা নাড়ালো। এর পর মাথা নামিয়ে ধুলোর মধ্যে দাগ কাটতে লাগলো।

“চা হতে হতে দেখে আয় না কতগুলি ডিম পেড়েছে?”

জীনাত আগুনের শিখার দিকে তাকালো। লাফিয়ে উঠা স্ফুলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে সে শান্তি অনুভব করছিল। ঘোবাশি চলে গেছে তার কাধে সমস্ত ভার চাপিয়ে। বাচ্চাগুলি, দুই কীরাত৩ জমি আর মহিষটা। “নিমার খেয়াল রেখো” যাবার আগের দিন রাতে বলেছিল। “মেয়েটার শরীর বাড়ন্ত।” এর পর তার দু’হাতের তালু বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “হে খোদা, রাসুলের দোহাই, এই মেয়েটার জন্য যেন আমি একটা বিয়ের জন্য সিল্কের কাপড় নিয়ে আসতে পারি।” জীনাত বলেছিল, “ঘোবাশি, তোমার কথাগুলি যেন তোমার মুখ থেকে সোজা খোদার দরবারে পৌছে যায়।” ঘোবাশি পরবর্তী বড় ভোজের আগে আর ফিরছে না। কি হবে সে ফিরে এসে এই অবস্থা দেখলে? সে তার হাতের তালুর মধ্যে মুখ গুঁজে দিল, আগুনের দিকে ঝুঁকে ছাই সরাতে লাগলো। “কি আজব”, সে ভাবছিল, “আজকের দিনের মেয়েরা। এই ছোট ব্যাপারটা প্রতি মাসে তার মাসিকের সময়গুলিতে চলছিল, যেন কিছুই ঘটেনি, আর এখন তার চার মাস চলছে, অথচ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”

নিমা ফিরে আসলো। কাপড়ের পুটুলি থেকে ডিমগুলি বের করে, দুটো আগুনে ছুড়ে দিয়ে বাকিগুলো পাত্রের মধ্যে রাখলো। এর পর দুটো গ্লাস আর একটা চিনির কৌটা এনে তার মায়ের পাশে এসে বসলো। সে তখনো তার চিন্তায় মগ্ন।

“কিছু উপায় বের করতে পারলি?”

নিমা অসহায়ভাবে তার ঘাড় নোয়ালো।

“তোর আব্বা গেছে চার মাস হলো। এখনো কি যথেষ্ট সময় আছে না?”

“কী লাভ? এক মাত্র খোদাই পারে আমাকে নিয়ে এই বিপদ থেকে তোমায় উদ্ধার করতে । সবচেয়ে ভাল হত না মা, পানি আনতে গিয়ে পিছলিয়ে যদি আমি খালে পড়ে যেতাম? আমাদের সব সমস্যার সমাধান হত।”

জীনাত মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিল।

“এরকম খারাপ কথা বলবি না। এগুলো শয়তানের কথা। এসবে কান দিবি না। শান্ত হ। দেখি তোর আব্বার আসার আগে কোন সমাধান বের করা যায় নাকি।”

জীনাত চা ঢালে। নীরবে চুমুক দেয়, গ্লাসটা সামনে রেখে ডিমের খোসা ছাড়িয়ে কামড় দেয়। নিমা তাকে দেখতে থাকে, তার আঙুলগুলি তপ্ত গ্লাসে। বাইরে থেকে হাটের অবস্থা নিয়ে মহিলাদের কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছিলো, পুরুষগুলি ক্ষেতে যাবার পথে পরস্পরের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করছিল যার মধ্যে শোনা যাচ্ছিল হামদানের হাস্য, সে মহিষটাকে নিয়ে মাঠের দিকেই যাচ্ছিল, বাড়ির পাশের সেই দুই কীরাত জমি।

“তার হিসাব আল্লার সাথে”, বিড়বিড়িয়ে উঠলো জীনাত, “সে ভালই আছে, দুনিয়ায় তার আর কোন চিন্তা নাই।”

নিমা উঠে গিয়ে তার মাথার কাপড় পেচাতে আরম্ভ করল যেন একটা পট্টি তৈরী করছে। জীনাত ঘুরে তাকিয়ে দেখলো সে হাটে যাবার জন্য নিজেকে তৈরী করছে। সে জেলাবা ধরে তাকে টানলো আর ছোট্ট মেয়েটা আবার বসে পড়লো। ঠিক সে মুহুর্তে তারা দরজার কড়া নাড়ার শব্দ পেলো, তাদের প্রতিবেশী উম্মে আল খায়ের এর গলা,

“আপনাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করি। জীনাত খালা, নিমা কি আজকে প্রত্যেক দিনের মতো আমার সাথে যাবে না? না কি ঘুম থেকেই উঠে নি?”

“বোন, ও তো আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছে।”

“আল্লা ওকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে আনুন।”

নিমা তার মায়ের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকালো। জীনাত মুখে আঙুল দিল। উম্মে আল খায়েরের পায়ের শব্দ দূরে চলে গেলে, নিমা ফিসফিস করে বললো,

“কি করতে চাইছ মা? কোন আত্মীয়ের কথা বলছ?”

জীনাত উঠে দাড়ালো এবং তার কাপড়ের বাক্স থেকে হাতড়িয়ে একটা রুমাল বের করে কিছু টাকা গুঁজে দিল, আর পুরনো কিছু কাপড় বের করে আনলো। রুমালটা নিমার হাতের তালুতে রেখে মুষ্টিবদ্ধ করিয়ে বললো,

“এটা নিয়ে যা, আমার সারা জীবনের সঞ্চয়।”

নিমা চুপ করে রইল। ওর মা বলে চলল,

“তোর জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে সোজা স্টেশনে যা। একটা কায়রোর টিকেট কাট। কায়রো অনেক বড়ো জায়গা মা। তুই একটা আশ্রয় পাবি, আর আল্লা যে কোন একটা উপায় করে নিরাপদেই তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবেন। আর তার পর তুই রাতের গভীরে ওটাকে আমার কাছে নিয়ে আসবি যাতে কেউ না দেখে বা না বুঝতে পারে।”

জীনাত তার জেলাবার প্রান্তটা তার দাতে কামড়ে ধরে পুরনো কাপড়গুলি কোমরের চারপাশে পেচাতে থাকে। এর পর জেলাবাটা ছেড়ে দেয়। নিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেসে করে,

“আর তুমি আব্বাকে কি বলবে?”

“এটা কথা বলার সময় না। স্টেশনে যাবার আগে এই ঝুড়িটা নিতে আমাকে সাহায্য কর, যাতে হাটের মধ্যে লোকজন আমাকে এভাবে দেখতে পায়। এটা সবচেয়ে ভালো না যে তোর আব্বা ফিরে এসে অবৈধ নাতির বদলে নিজের বৈধ ছেলেকে দেখবে?”
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২০ রাত ১২:৪২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×