প্রথম আলো পত্রিকায় শুক্রবার (১৩ মে) তাজমহল নিয়ে ভারতের একটি সংবাদ প্রকাশ করে প্রথম পাতায়। সেখানে বলা হয়েছে, তাজমহলের ২২টি বন্ধ ঘরে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে আন্দাজ করে দায়ের করা মামলাটি খারিজ করে দেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চ। এমনকি মামলার বাদীকে ভর্ৎসনাও করেন আদালত।
কিন্তু খটকার জায়গা হলো সংবাদের শেষের অংশে প্রতিবেদক যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে।
প্রতিবেদক যুক্ত করেছেন, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন বিখ্যাত স্থাপনা নিয়ে কট্টর ধর্মবাদীদের অনুসন্ধানের একটি চিত্র। হিন্দু সাধুসন্ত বিশ্বাস করে তাজমহলের স্থানে তেজো মহালয় নামে শিবমন্দির ছিল। যা ১২১২ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা পরমর্দি দেব। এরআগে ২০১৫ সালে উত্তর প্রদেশের আইনজীবীরাও তাজমহলের স্থানে শিবমন্দির ছিল দাবী করে মামলা করেছিলেন। যদিও ইতিহাস বলছে, ১৬৩১ সালে শুরু করে ২২ বছর ধরে ২২ হাজার শ্রমিকের পরিশ্রমে তাজমহল গড়ে তুলেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। এছাড়া ২০১৭ সালে এক মন্ত্রী দাবী করেন তাজমহলের ভিতরে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি থাকতে পারে। ২০১৯ সালে কর্ণাটকের এক নেতা দাবি করেন, শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেননি। ওটা তিনি কিনেছিলেন রাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে।
হয়তো তাজমহলের বৈশ্বিক প্রভাবের কারনে এখনো কট্টররা কব্জ করতে পারেনি। তবে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন শহর, জেলা, জনপদ, রাস্তার নাম বদলের একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ইসলামি নামের সঙ্গে যা কিছু যুক্ত, ভারতীয়করণের নামে তার হিন্দুত্বকরণ করছে। এলাহাবাদের নাম বদলে করা হয়েছে প্রয়াগরাজ। ফৈজাবাদ জেলার নাম বদলে করা হয়েছে অযোধ্যা।মুজাফফরনগরের নাম বদলে লক্ষ্মীনগর, আহমেদাবাদের নাম বদলে ‘কর্ণাবতী’, আগ্রার নাম পাল্টে ‘অগ্রবন’ কুতুব মিনারের নাম বদলে বিষ্ণু স্তম্ভ করার চেষ্টা চলছে। তাছাড়া রাজধানীর ছয়টি রাস্তার মধ্যে শাহজাহান রোডের নাম বদলে জেনারেল বিপিন রাওয়াত রোড, হুমায়ুন রোডের নাম বদলে মহর্ষি বাল্মীকি রোড, আওরঙ্গজেব লেনের নাম বদলে ড. এপিজে আবদুল কালাম লেন, তুঘলক রোডের নাম বদলে গুরু গোবিন্দ সিং রোড, আকবর রোডের রোডের নাম বদলে মহারাণা প্রতাপ রোড এবং বাবর লেনের রোডের নাম বদলে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বোস লেন করার দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।
ভারতের অভ্যান্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা বাস্তবিক সাজে না। যেহেতু বাংলাদেশী পত্রিকায় সংবাদটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করেছে, এজন্য মন্তব্য করার যুক্তি সিঁকি হলেও আছে। সে অনুসারে বলতে হয়, স্থাপনা, সড়কের নাম বদলে ফেলে কখনোই ইতিহাস মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বিশ্বের মধ্যে যে কয়টি রাষ্ট্র আছে তারমধ্যে আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে একটি ভারত। সেখানে মানুষের ভোটের অধিকার যদি নিশ্চিত করা হয় তাহলে ইতিহাসও ইতিহাসের মত বয়ে চলার অধিকার রয়েছে। বাবরি মসজিদ নিয়ে যে কাণ্ড হলো তার আলোচনা-সমালোচনা এখনো থামেনি। তাই সাম্যক রাজনৈতিক বা ধর্মীয় তুষ্টির জন্য ইতিহাস মুছে ফেলার চর্চা একটি জাতিকে বিপন্ন করে। ইতিহাস মুছে ফেলে গণতন্ত্র চর্চা হয় না।
ভারতে দীর্ঘদিন ধরে নাম বদলের যে চেষ্টা চলে আসছে তা নিঃসন্দেহে একটি গোষ্ঠি করছেন। যারা রাজনৈতিক বিবেচনা ও ধর্মীয় বিবেচনা পুঁজি করে জনসমর্থন আদায় করতে চান। কিন্তু এটি মনে রাখা জরুরী, ভারতে বসবাস করা হিন্দু, মুসলমান বা অন্য ধর্মের মানুষ যেমন ভারতের সম্পদ। তেমনি ওখানকার ইতিহাসও তাদের সম্পদ। শুধু সম্প্রদায়ের বিবেচনায় ইতিহাস মুছে ফেলা আর জাতীয়তার সাথে বেঈমানী করা সমান কথা। আদালতের কঠোর অবস্থানে এখন পর্যন্ত ভারতে নাম বদলের মৌসুম শুরু না হলেও এই চেষ্টা একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্টের জন্য অশনি সংকেত বটে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:০৫