somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম | 07-08-2015



বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তার বিপক্ষ দলীয়রা একে ‘পাকিস্তান ভাঙা’র একটি কৌশল হিসেবে বর্ণনা করে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছিল। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না, এই বিরুদ্ধবাদীরা সব সময় ছিল তার এবং বাংলাদেশের পথের কাঁটা।



তবে যা আমাদের অবাক করে, তা হল, তার সমর্থক কিছু মানুষজনেরও ৬ দফার সাফল্য নিয়ে সংশয়। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র, এর সেনাশাসক ‘লৌহমানব’ আইয়ুব ছিলেন খোদ সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল। এই রাষ্ট্রের নেতৃত্বের রাজনৈতিক শিক্ষা বা সংস্কৃতি ছিল না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো কিছু ভূস্বামী-রাজনীতিবিদ প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, কিন্তু তাদের কোনো সংস্কৃতি ছিল না। তারা ক্ষমতার প্রয়োজনে খুন করতেও পিছপা হতেন না। পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো কার্যকর বিরোধী দল ছিল না, ছিল বাংলাদেশে এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেন পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতেই। তার সাহস আইয়ুব এবং পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতাধরদের বিস্মিত এবং ক্রোধান্বিত করেছিল। তাদের দুঃশাসন যে এরপর আরও তীব্র এবং অসহনীয় হবে, তা তো সহজেই অনুমেয় ছিল।



কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে যাননি। তিনি ভয় পাননি অথবা ৬ দফার কোনো দফাকে একটুখানি কাটছাঁট করেননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ৬ দফার আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত আমাদের একাত্তরে নিয়ে গেছে। পাকিস্তানিদের দমন-পীড়নকে তোয়াক্কা না করে তিনি বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করেছেন। পাকিস্তানিরা তাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে, আগরতলা মামলায় তাকে রাজনীতির মঞ্চ থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে, কিন্তু প্রতিটি ষড়যন্ত্রই তাকে নতুন থেকে নতুনতর উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ১৯৭০-এর নির্বাচন এই সত্য প্রতিষ্ঠা করল, তিনিই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা এবং বাঙালির ভবিষ্যৎ রচনা হবে তারই নেতৃত্বে।

এত বিরোধিতা, কোনো কোনো মহলে সন্দেহ সত্ত্বেও কিভাবে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেলেন ৬ দফা এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নিয়ে? এর কারণ খুঁজতে গেলে বঙ্গবন্ধুর জীবনে, দর্শনে, রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মপরিকল্পনায় আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। তাহলে অনেক বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। এ থেকে তিনটি অগ্রবর্তী বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়।

বঙ্গবন্ধুর প্রথমত ছিল অবিচল আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় প্রত্যয়; তার প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা। দ্বিতীয়ত ছিল তৃণমূলে তার আস্থা, তৃণমূলে তার বিপুল গ্রহণযোগ্যতা, তার বিস্ময়কর সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং তৃতীয়ত ইতিহাস, সংস্কৃতি, গ্রামীণ অর্থনীতি ও মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় তার আস্থা। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আছে- তিনি নানা প্রতিকূলতার মাঝেও এই সত্যকে ধারণ করে এগিয়েছেন যে, উদ্দেশ্য সৎ, জনহিতৈষী হলে এবং তাতে মানুষের সমর্থন থাকলে যে কোনো শক্তিকে অবজ্ঞা করে এগিয়ে যাওয়া যায়। যারা ঢাকা বা শহরকেন্দ্রিক রাজনীতি করতেন, তারা এ বিষয়টি বুঝতে পারতেন না; তারা সরকারের শক্তি ও ক্ষমতাকে উদ্বেগ নিয়ে দেখতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সহযোগীরা জানতেন, এই সত্যটি সংগ্রামের পথটাকে বেঁধে দেয়।

বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা ছিল, দূরদৃষ্টি ছিল। তিনি পরিষ্কার চোখে ভবিষ্যৎকে দেখতে পেতেন। অনেক রাজনীতিবিদ সাময়িক বাধা ও সংকটের গাছের জন্য বৃহত্তর সংগ্রামের বনকে দেখতে পেতেন না। বঙ্গবন্ধু দেখতেন। জাতির জন্য ঠিক যখন যে দিকনির্দেশনা ও কর্মসূচির প্রয়োজন, তা তিনি দিয়েছেন। ১৯৪৬-৪৭-এ পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কিন্তু ১৯৫২-তে পাকাপাকিভাবে তিনি বাঙালির আত্ম-অধিকারের সংগ্রামে নামলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তার অনেক সহকর্মীও তখন তার মতো স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে ইতিহাসকে পড়তে পারেননি; তারা বুঝেছেন আরও পরে, ১৯৫৮-তে সামরিক শাসন জারির পর।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট যখন নির্বাচনে জিতল, পাকিস্তানের রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে বাঙালির নিজস্ব রাজনীতির অভ্যুদয় ঘটল। সেই অভ্যুদয়ের একজন স ষ্টা ও কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার পরের ইতিহাস তো আমাদের জানা। ১৯৫৮ সালের পর বাঙালির রাজনীতি, সংগ্রাম এবং কর্মসূচি ছিল পাকিস্তানের সবকিছু থেকে পৃথক। এজন্য আওয়ামী লীগ একটি সর্ব-পাকিস্তান রাজনৈতিক সংগঠন হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে এর কার্যক্রম ছিল সীমিত। কারণ বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মাঝখানে ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালি।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাঙালিকেন্দ্রিকতা তাকে একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ থেকে বিরত রাখেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনের নয় মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পেছনে তিনি জুগিয়েছেন প্রেরণা ও শক্তি। এটি সম্ভব হয়েছিল সব দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তার দীর্ঘদিন রাজনীতির কারণে। মানুষ তাকে বিশ্বাস করত, তার ডাকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তিনি যে ভাষণ দেন, তাকেই দেশের মানুষ তাদের সংগ্রামের নির্দেশ ও রূপরেখা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর বৈশ্বিক দৃষ্টির কারণে তিনি বাংলাদেশের সম্ভাবনাগুলো এবং সমকালীন বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুচিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি এগোচ্ছিলেন, কিন্তু তার ঘাতকরা সেই সুযোগ তাকে দিল না। তারা দেশটাকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল- এখনও তারা আছে, আছে তাদের পেছনে সক্রিয় নানা শক্তি- কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে বাঙালিকে বিশ্বাস করতেন, সেই বাঙালি আবার জেগেছে এবং তাদের প্রতিহত করছে।

বাঙালি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আশাবাদ ছিল। এই আশাবাদ জিইয়ে রেখে দেশটিকে সামনে নিয়ে এগোলে আমরা তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখাতে পারব। বাংলাদেশ নিয়ে তার স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত করার পথে নিয়ে যেতে পারলে তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ প্রকাশটা দেখাতে পারব।



লেখক: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের নির্বাচন আগে দিয়ে দেখতে দিন কে বাঘ কে বিড়াল?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৬



সব দলের অংশগ্রহণে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের নির্বাচন আগে দিন। কোন দলকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে কি করেনি সেইটাও জাতিকে দেখতে দিন। পিআর পদ্ধতির জাতীয় সংসদের উচ্চ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×