এক সময় আমি পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় থাকতাম। চতুর্থ তলায়। মুখোমুখি লাল একটা তিন তলা বাসা। দুই বিল্ডিং এর মাঝে সরু রাস্তা ছিল। ফলে দুরত্বটা বেশী ছিল না। চারতলা থেকে তাকালে সামনের তিনতলার রুমের ভেতর পর্যন্ত সব দেখা যেত। অকারনে সেদিকে চোখ চলে যায়। সন্ধ্যার পর সামনের বারান্দায় বসে চা খেতাম। বেশীরভাগ সময়ে লাইট অফ করে রাখতাম। এভাবে অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকা আমার অভ্যাস! দুলাভাই চা নিয়ে অনেক সময় পাশে বসে বলতেন, কি শালা একা একা কি কর? আমি কাপটা তাঁর কাপে হালকা ছুঁয়ে বলতাম, চির্য়াস! এভাবে চলতে চলতে একদিন আবিস্কার করলাম, সামনের রুমটাতে একটা মেয়ে থাকে। সুন্দরী। হালকা পাতলা ছোটখাট মেয়েটি চশমা পরে। চুল বেণী করে। বিছানায় শুয়ে বই পড়ে। যেদিন থেকে ওকে দেখলাম সেদিন থেকে আমার চলাফেরা আমার নিজের কাছেই সন্দেহজনক হয়ে উঠল। বারান্দায় বসে থাকলে মনে হয় ওর জন্য অপো করছি। আমি নিঃশব্দে নিশ্চুপ বসে থাকি। আগের মত অকারনে ওর রুমের দিকে দৃষ্টি যায় না। তাকানোয় ওকে দেখার তীব্র আকাঙ্খা থাকে। দুলাভাই একদিন বললেন, কি ব্যপার এভাবে একা একা বসে থাক কেন? কিছু হয়েছে? নাকি ডুবে ডুবে... আমি হাসলাম।
অল্প সময়ে জেনে গেলাম কোন কোন সময় মেয়েটিকে দেখতে পাওয়া যাবে। আমি সে সময়গুলোর অপো করি। শেষবার দেখা যায় রাত এগারটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে। সে সাদা টি সার্ট, কালো স্কাট পরে আর মুখে ব্রাশ নিয়ে ছাদে উঠে। দাঁত ব্রাশের ফোরাইড যুক্ত ফেনা মুখে নিয়ে মেয়েদের বিচ্ছিরি লাগে। আর ফেনা নিয়ে তোতলা উচ্চারন করলে অসহ্য ঠেকে কিন্তু তার সাথে আমার সেরকম কোন অভিজ্ঞতা নেই। ব্রাশ করতে করতে চাঁদের আলোয় কিছুন হাঁটাহাঁটি করে। তারপর ডিসের রিসিভারটা খুলে নিয়ে চলে যায়। আমাকে আগামী দিনের অপোয় থাকতে হয়।
আজ জোৎস্না তীব্র হয়ে উঠেছে। আমার অপো তীব্রতর হচ্ছে। লাইট অফ করে জানালায় দাঁড়িয়ে আছি। বিকেল থেকে মনটা বেশ ফুরফুরে। সে আজ শাড়ি পরে অনেকণ দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েকবার চোখে চোখ পড়েছে! তার ঠোঁটের কোনে ছিল ঝুলন্ত একটা হাসি। বারটা বেজে গেল। তবু সে এল না! আমার ঘুম আসছে না। রাত একটার দিকে নীচে কান্না আর হৈচৈ শোনা গেল। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এক রিক্সাওয়ালা কান্নাকাটি করছে। আশপাশের বিল্ডিং থেকে অনেকে বের হয়েছে। কান্নার কারন জানতে চাইছে। কাঁদতে কাঁদতে রিক্সাওয়ালা বলছে, এক লোক রিক্সা ভাড়া করে সন্ধ্যা থেকে এতন ঘোরাঘুরি করেছে। ভাড়া হয়েছিল চারশ টাকার মত। রাতে তাকে শাহবাগের এক হোটেলে ভাত খাইয়েছে। রিক্সায় বসে লোকটি অনবরত সিগারেট খাচ্ছিল। তাকেও দিয়েছে দামী সিগারেট। তারপর এখানে জলবিয়োগের নাম করে নেমে পালিয়ে গেছে। রিক্সাওয়ালা বুক চাপড়ে কাঁদছে। সন্ধ্যায় রিক্সা গ্যারেজে জমা দেয়ার কথা ছিল। এখন সে কিভাবে জরিমানা দিবে আর বউ বাচ্চাদেরই বা কি খাওয়াবে। উপর থেকে টাকা ফেলে সবাই রিক্সাওয়ালাকে সাহায্যে করছে। পালিয়ে যাওয়া 'রোমান্টিক' লোকটির উপর আমার খুব রাগ হচ্ছে।
কিছুক্ষন পর আবার চোর চোর বলে হৈচৈ শোনা গেল। আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচেই চিৎকার করছে। দরজা খুলে বের হলাম। তিন তলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে মুখোমুখি হওয়াতে দুজন দুজনকে জিজ্ঞেস করছি কোথাই চোর? ভেতরে ঢুকে সে একটা রড নিয়ে আসলো। আমরা দু'জন নিচে নামলাম। নিচে অনেকে জমা হয়েছে।
অবাক কান্ড। চোর বাইরে আর জানালা দিয়ে চোরের হাত ধরে ওয়ালে পা লাগিয়ে একজন টেনে ধরে আছে। এখন চোরকে বাইরে থেকে ধরে ভেতরে নিয়ে আসতে হবে! কেউ যেতে সাহস করছে না। সবার ভয় ওর সাথে যদি আরও কেউ থাকে আর আক্রমন করে বসে। ব্যাপার হয়েছে গরমের দিন বলে নিচের দু’জন ভাড়াটিয়া জানালা খুলে ঘুমাচ্ছিল। এক সময় লোকটির উপর সার্ট পড়লে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে চিৎকার না করে শুয়ে ছিল চোর ধরার আশায়। প্রথমবার সার্টটি বের করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়বার যখন চোর হাত ঢুকিয়েছে অমনি লোকটি খপ করে ধরে ফেলে চিৎকার আরম্ভ করেছে। চোর হাতছাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। হাত ছাড়ানোর জন্য চোর লোকটির মুখে নাকি দু তিনবার থুথু ছিটিয়েছে! ওর সাথের চোরটি সাথে সাথে পালিয়ে গেছে।
চোরকে বাইরে থেকে উদ্ধার করে আনা হল। বাড়িওয়ালা গালে থাপ্পড় দিয়ে বলল, বল তোর সাথে আর কে ছিল? মারতে গিয়ে চোরের লুঙ্গি খুলে পড়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়িওয়ালা বলল, ব্যাটা আবার হাফপ্যান্ট পরে এসেছে! চোর বলল, স্যার আপনের ছেলেওতো হাফপ্যান্ট পরে আছে! তিনি বললেন, ব্যাটা আবার মুখে মুখে কথা বলে।
দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো।
চোরকে রাস্তায় পোলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকজন দেখছে। একজন এসে বলল, ওই হারামি- তুই নাকি বলেছিস গতরাতে আমি তোর সাথে ছিলাম? তারপর দু চার ঘা বসিয়ে দিল। লোকজন কানাঘুসা করছে .. একেই বলে, চোরের মা'র বড় গলা!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ১১:৫২