মানুষ তার নিজের নামটা সব সময় খুব পছন্দ করে। আমিও আমার নামটা অপছন্দ করি না, ভালই লাগে। কারন আমার আব্বা আমার আগের নাম পাল্টিয়ে যথারীতি আকিকা দিয়ে এ নাম রেখেছেন। শুনেছি তাঁর এ নাম রাখার পেছনে অনেক আকাঙ্খা ছিল। সৌরভের গন্ধ পেয়েছিলেন কিন্তু বাস্তবে তাঁর সুদরপ্রসারী আকাঙ্খা মাঠে মারা পড়েছে। বাবা আমি দুঃখিত। তুমি আকাশের যেখানেই থাকনা কেন পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
সন্ধ্যার পর মাঝে মধ্যে ভিসিডি’র দোকানে আড্ডায় বসি। গ্রামে কখনো ভিসিডি’র দোকানে বসে আড্ডা দিব এটা চিন্তাই করা যায় না। সবাই হৈ হৈ করে বলবে, গেলো ছেলেটা উচ্ছন্নে গেলো কিন্তু এখানে সেটা বলার কেউ নেই। আর আমি নিজেও আজকাল এসব সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামাই না। ফলে আড্ডাটা দিনদিন জম্পেস হয়ে উঠছে। মোটামুটি সবার সাথে পরিচিত হয়ে গেছি। পরিচিত হতে হলে সবাই প্রথমে নামটা জানতে চাই। আমি সানন্দে আমার ডাক নামটা সবাইকে বলি - চন্দন। আমি নামটাকে পছন্দ করি। কিন্তু যেদিন থেকে মকবুল হোসেন ফিদা’র গজগামিনি ছবিতে ‘চন্দন’ নামটা শুনেছি সেদিন থেকে নিজের নামটাকে ভালবেসে ফেলেছি।
ভালবাসার এ নামটা নিয়েই একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আমি সেটাকে বেশ উপভোগ করছি। পরিচয় পর্বে সোহান ভাই হাত মেলাতে গিয়ে কেমন যেন একটু থমকে গেলেন! অল্পক্ষণ পর আমি রুমে চলে এসেছিলাম। সোহেল ভাই আর আমি একসাথে থাকি। রাতে ফিরে সোহেল ভাই জানাল.. আমি চলে আসার পর সোহান ভাই তার কাছে জানতে চেয়েছে, কি করে আমার মত একজন হিন্দুকে নিয়ে একসাথে থাকে! খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হয় কিনা? এসব আরকি।
পরদিন আরেকজনকে আমার কথা জিজ্ঞেস করছিল, সোহেল ভাই চিমটি কাটায় সে বলেছে - আপনি জানেন না? চন্দন ভাইতো হিন্দু! সোহান ভাইয়ের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। তিনি বলছেন, আমার কল্পনা শক্তি ভাল। আমি চেহারা দেখে আগেই ভেবেছিলাম একথা।
সোহান ভাই বললেন, ‘খাওয়া দাওয়া নিয়ে তোদের ঝামেলা হয় না?’
‘আরে নাহ! যেদিন গরুর মাংস রান্না হয় সেদিন দাদার জন্য ডিম রান্না হয়।’ সোহেল ভাই বলল।
‘ও তাহলেতো সমস্যা নাই।’
‘সমস্যা নাই মানে ও ডিমও খাই আবার মাংসও খাই!’
‘কি! তাই নাকি!’
‘হ্যাঁ, দাদা ওসব কিছু মানে না। সে কিন্তু উচ্চ বংশীয় ব্রাক্ষণ।’
তারপর থেকে সোহান ভায়ের মুখোমুখি হলে আমি বুকের কাছে দু’হাত উঠিয়ে প্রণাম করি!
আমার টেবিলের উপর ছোট্ট একটা ঘড়ি আছে। শাড়িপরা এক মেয়ে নৃত্যরত ভঙ্গিতে আঙ্গুল উঁচিয়ে আছে। তার সে আঙ্গুলের ডগায় ঘড়ির ডায়াল। সোহান ভাই ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, এটা তোমাদের কোন দেবী ? দেয়ালে আমার একটা বড় বাঁধানো ছবি আছে। সন্ধ্যার পতেঙ্গা বীচে চাদর পরিহিত অবস্থায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। চাদর পরা এ ছবি দেখে তাঁর কল্পনা আরো পোক্ত হয়েছে।
ইতিমধ্যে সবার কাছে আমি ‘দাদা’ হয়ে গেছি! একদিন মিষ্টি খাবার পর্ব চলছিল, বাউল বলল, ‘দাদা এগুলো কি পুজোর প্রসাদ?’ আমি হাসি দিয়ে সবকিছুকে এড়িয়ে যায়। সবার কাছে ক্রমেই আমি ধোয়াশাছন্ন হয়ে যাচ্ছি! সোহান ভাই ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন কথা আমার কাছে জানতে চাই। যেমন : কি করে নামাজ পড়তে হয়, কোরআন শরীফের প্রথম আয়াত কি এসব... আমি ঠিক ঠিক উত্তর দিলে তাঁর বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
নামাজের বিষয় জানতে চাওয়ার কারন হল, এক শুক্রবারে মসজিদে তাঁর মুখোমুখি হয়ে গেলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরে জুবায়েরকে বলেছে, জানো আজ এক অলৌকিক দৃশ্য দেখেছি! চন্দনকে দেখলাম নামাজ পড়তে!
‘ওর ঠিক নাই। কোন ধর্মই ঠিকমত পালন করে না। মন্দিরেও যাই আবার মসজিদেও যাই।’ জুবায়েরর বলল।
‘কি আশ্চর্য ! কি আশ্চর্য!’
‘জানেন ও রোজাও করে।’
ভাগ্যিস কেউ আমাকে কখনো হিন্দু ধর্মের কোন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেনি। তাহলে খেলা সেখানেই শেষ হয়ে আমি ধরা পড়তাম।
আড্ডায় গিয়ে একদিন বুকে হাত উঠিয়ে সবাইকে প্রণাম জানালাম। সোহান ভাই বলল, কি মিয়া ফাইজলামি পাইছো?
আমি বললাম, কেন দাদা কি হয়েছে?
‘কি হয়েছে সেটাকি প্যান্ট খুলে চেক করতে হবে নাকি!’
‘রাম নাম, রাম নাম - কি বলেন দাদা!’
কামরুল ভাই সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছেন।
**
রচনা সময় # ফেব্রুয়ারী’ ২০০৪
লেখাটি "ছুটির দিনে / প্রথম আলো" - ১৫ মে ২০০৪ সংখ্যায় প্রকাশিত