( প্রকাশসত্ব সংরক্ষিত)
১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই জাতীয় সংসদে তৎকালীন আইনমন্ত্রি শ্রী মনোরঞ্জন ধর বলেছিলেন, " আজকে বাংলাদেশে যে সব যুদ্ধাপরাধ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে যদি তারা বিনা বিচারে, বিনা শাস্তিতে রেহাই পেয়ে যান, তাহলে সমস্ত সভ্য জাতির চোখে আমরা পরিহাসের পাত্র হবো। এবং আমরা অত্যন্ত কদর্য নজীর স্থাপন করব। এই বিচার আমাদের পরমতম কর্তব্য।"
১৯৭৩ সালের পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সময়। এই পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে যদি আমি বলি, আমরা সভ্য জাতির চোখে কেমন পরিহাসের পাত্র হয়েছি ? এই কি আমার বাংলাদেশ, যাদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন এই দেশ তাদের হত্যার বিচার আজতক করতে পারে নি যে দেশ ? এই কি বাংলাদেশ, যেখানে স্বাধীনতার এতো বছর পরেও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত সত্যকে কথার তুবড়িতে মিথ্যা বানাতে চান স্বীকৃত কোন যুদ্ধাপরাধী।
যদি সারা বাংলাদেশে গণভোট চাওয়া হয়, কারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান ? তবে এটা দৃঢ়ভাবে বলা যায় প্রায় সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে থাকবেন। এতোকিছুর পরও কেন এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে না ? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাটা কোথায়? যেখানে প্রজাতন্ত্রের বেশিরভাগ লোক এই দাবির পক্ষে।
আইনের ছাত্র হিসেবে আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তার আইনগত দিক নিয়ে পর্যালোচনা করতে চাই।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রথম আইন পাশ করা হয় ১৯৭২ সালে। আইনটির নাম Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 | এটি দালাল আইন নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ঘোষণা দ্বারা প্রবর্তিত দালাল আইনটির প্রয়োগ শুরু হয় ফেব্র"য়ারি মাস থেকে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করার মাধ্যমে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী আইনটির আদেশ জারী হলেও পরবর্তীতে একই বছরের ৬ ফেব্র"য়ারি, ১ জুন এবং ২৯ আগস্ট তারিখে তিনদফা সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটি চুড়ান্ত হয়। পরবর্তীতে দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিভিন্ন আদলতে তাদের বিচার আরম্ভ হয়। এর পাশাপাশি সরকারি চাকুরিতে কর্মরতদের কেউ দালালী এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা তা যাচাই করার জন্য ১৯৭২ সালের ১৩ জুন একটি আদেশ জারি করে যা তখন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যে সকল ব্যক্তিদের বিরোদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ৩৭ হাজারের অধিক ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫নং ধারার (ক) অনুচ্ছেদে যে বিধান রাখা হয় তাতে সত্যিকার অর্থে কোন যুদ্ধাপরাধী মুক্তি পাওয়ার কথা নয়। কারণ ঘোষণার ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে -
" যারা বর্ণিত আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরোদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরোদ্ধে নিম্নোক্ত ধরা মোতাবেক কোনটি অথবা সবকটি অভিযোগ থাকবে
(১) ১২১ (বাংলাদেশের বিরোদ্ধে যুদ্ধ চালানো অথবা চালানোর চেষ্টা), (২) ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরোদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র), (৩) ১২৮ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা), (৪) ৩০২ (হত্য), (৫) ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা), (৬) ৩৬৩ (অপহরণ), (৭) ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ) (৮) ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ), (৯) ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা), (১০) ৩৭৬ (ধর্ষণ), (১১) ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি), (১২) ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত), (১৩) ৩৯৫ (ডাকাতি), (১৪) ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি), (১৫) ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাতœক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি), (১৬) ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধণ), (১৭) ৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার), (১৮) ফৌজদারী দন্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান। এসব অপরাধী কোনভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন।"
এখন প্রশ্ন হলো সুনির্দিষ্টভাবে এই ১৮টি ধারা উল্লেখ করার পরও কি কেই বলতে পারে যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের ছাড়া পেয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে ?
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি এ সকল অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম চলতে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।
সেই প্রসঙ্গে এই রচনায় আলোচনা না করে ফিরে যাই সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে। এই সাধারণ ক্ষমা নিয়ে একটা বিতর্ক থেকেই যায়। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন কিসের ভিত্তিতে ? সাধারণ ক্ষমার বিষয়টি কি শুধুই সহানুভুতিতার বিষয় নাকি সেখানে সাংবিধানিক কোন বৈধতা রয়েছে ? বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমা প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে। লক্ষ করি বর্তমান সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদ (১৯৭২ সালের সংবিধানের ৫৭ নং অনুচ্ছেদ)
" The President shall have power to grant pardons, reprieves and respites and to remit, suspend or commute any sentence passed by any court, tribunal or other authority."
অর্থাৎ " কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন দন্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোন দন্ড মওকুফ স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।"
সুতরাং বলা যায়, শুধুমাত্র শাস্তি এবং দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার আছে রাষ্ট্রপ্রধানের। কিন্তু যারা শাস্তি কিংবা দন্ড পাননি তাদেরকে কি সাধারণ ক্ষমা করা যাবে?
সেই বিতর্কে না গিয়ে ফিরে আসি যুদ্ধরাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে। দালাল আইন বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে না কিংবা বিচার সম্ভব নয় এমনটা মোটেও নয়। কারণ এখনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে খ্যাত সংবিধানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়পি রয়েছে; রয়েছে ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সবচেয়ে কার্যকরী আইন The International crimes (Tribunals) Act 1973 এখনো রয়েছে।
(চলবে)