somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরিনত মোহ কিংবা অপরিনত ভালোবাসা (দশম পর্ব)

২০ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কিছু প্রয়োজনীয় বই কিনতে মার্কেটে গেলাম। পাশেই সিনেমা হলের দেয়ালজুড়ে নতুন সিনেমার পোস্টার। উৎসুক লোকজনেরা বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। ছবির পোস্টার দেখেই হয়তো কেউ কেউ পুরো কাহিনী বুঝে ফেলার চেষ্টা করছে। পোস্টার দেখার ধরণ এমনটাই বলে। বই কেনা হয়ে গেল খুব কম সময়ের মধ্যেই। হাতে অনেক সময়। ভাবলাম একটা সিনেমা দেখেই যাই। টিকেট কেটে সিনেমা হলের ভিতরে চলে গেলাম। ধৈর্য্য ধরে সিনেমা দেখা শেষ করলাম। কাহিনী চলনসই, তবে পুরো সিনেমাজুড়ে নায়িকার অতিরিক্ত আহ্লাদ চোখে পড়ার মতো। অনেকদিন পর সিনেমাহলে বসে সিনেমা দেখলাম। মনে পড়ে গেল শৈশবে সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখার বিষয়টিকে বাজে ছেলেদের কাজ মনে করতাম। হয়তো এর জন্য আমার বড় হয়ে উঠার পরিবেশটা দায়ী। বেশ রক্ষণশীল পরিবেশে বেড়ে উঠেছি আমি। সবসময় ভালো ছেলে সেজে থাকার চেষ্টা থাকতো। একবার নবম শ্রেনীতে পড়ার সময় সব বন্ধুরা প্ল্যান করলো সিনেমা দেখতে যাবে। আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোনভাবেই তারা আমাকে সিনেমা হলে নিয়ে যেতে পারলো না। বুঝতে পারলাম,চিন্তাভাবনার পরিবর্তনের সাথে চারপাশের অবস্থানের ভুমিকা অনেক।


বাসায় ফিরে খেয়ে দেয়ে ভাতঘুম দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো কাজের বুয়ার প্যানপ্যানানী। ঘুম থেকে জেগে গেলাম।সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে; এইসব বিষয় নিজে নিজেই জোরে জোরে বলছে। আসলে আমাকে শোনাবে এমনটাই লক্ষ্য। আমিও ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকলাম। একটা পর্যায়ে বুঝতে পারলাম কথার মাত্রা বেড়েই চলছে, লক্ষণ সুবিধার না। এই কথাবার্তা শেষ পর্যন্ত বুয়ার বিল বাড়ানো পর্যন্ত গড়াতে পারে। আমি শার্ট চাপিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।


রাস্তায় বের হয়ে হাটতে লাগলাম। হাটতে হাটতে অভ্যাস অনুযায়ী চলে গেলাম অবন্তীদের বাসার সামনে।তখন খেয়াল হলো অবন্তী বাসায় নেই। বেশ কিছুদিন হলো সে বিদেশে। ফ্যামিলি ট্যুরে হয়তো সে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইংল্যান্ডে। কেন জানি মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।মন খারাপ করে চলে গেলাম ছাত্রীর বাসায়। ভাবনাটা এমন যে আজকে বেশি সময় পড়াবো। তারপর রাত করে বাসায় ফিরবো। ছাত্রীর বাসায় গিয়ে দেখি সে সেজেগুজে বসে আছে।
‘তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘ না কোথাও যাবো না। তবে আজকে পড়তে ইচ্ছা করছে না।’
কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আসল ঘটনা। ছাত্রীর মা বাসায় নেই। বাসায় কেবল তাদের কাজের বুয়া। তাই ছাত্রী না পড়ার ফাকিবাজি করতে পারছে। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম-
‘ পড়বে না কেন? সমস্যা কি?’
‘সমস্যা কিছুই না। পড়তে ইচ্ছা করছে না। আপনি একটু বসেন আমি ভিতর থেকে আসছি।’
বলেই ভিতরের রুমে চলে গেল। কার পাল্লায় যে পড়লাম, মনে মনে ভাবছি। হাতে দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো ছাত্রী। আমার দিকে এককাপ চা বাড়িয়ে দিল।
‘আপনার কাপে বেশি চিনি দিয়েছি’।
‘ কেন!’
‘ সেদিন আমার বার্থডে কেকের যে অংশটুকু আপনাকে দেওয়া হয়েছিল তার পুরোটাই আপনি খেয়ে ফেলেছেন। তার মানে আপনি মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশ পছন্দ করেন। এজন্যই ভাবলাম আপনি চায়ে বেশি চিনি পছন্দ করেন।’
ছাত্রীর কথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম। আমি আসলেই চায়ে একটু বেশি চিনি পছন্দ করি।
‘ আজকে পড়বো না। চলেন গল্প করি।’
‘ নাহ! গল্প করার মুড নেই আমার।’ গম্ভীর হয়ে বললাম।
ছাত্রী চুপ করে বসে থাকলো। চা’টা চমৎকার হয়েছে। চা শেষ করে বাসা থেকে বের আসবো এমন সময় সে বললো, ‘খুব ইচ্ছা আপনার সঙ্গে দীর্ঘ সময় গল্প করবো। ঠিক আছে আপনার যখন গল্প করার মুড থাকবে তখন আমরা দীর্ঘসময় গল্প করবো।’ কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম।


ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। পশ্চিমের আকাশে লাল হয়ে উঠেছে সূর্য। যে রাস্তা ধরে হাটছি তার পাশেই একটা লেক। বেশ স্বচ্ছ পানি। পানি ধারণ করে আছে শেষ বিকালের আকাশের রং। চারপাশে অনেক মানুষ। হঠাৎ সামনে দিয়ে একটা রিক্সা চলে গেল। খুব স্বল্প সময়ের জন্য দেখলাম মেয়েটি পরম নিশ্চয়তায় মাথা দিয়ে আছে ছেলেটির কাঁধে। খানিক দুরে দুজন ভালোবাসার মানুষ হাত ধরে ধরে হাটছে। এই দৃশ্যগুলো একসময় খুব বিরক্তিকর লাগতো। নিছকই ন্যাকামি মনে হতো। কিন্তু এখন কেন জানি দৃশ্যগুলোর মধ্যে রোমান্টিকতা খুঁজে পাই। পরিবর্তনটা ভাবনা হয়ে ধরা পড়লো মনের ভিতর। এই ভাবনাই অনেকের ভিতর আমাকে একা করে দিল। বাসায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা হলো না। ছন্নছাড়ার মতো হাটছি এ রাস্তা সে রাস্তা জুড়ে। এভাবে রাত নামিয়ে দিলাম।


শীতের রাত। ঠান্ডা পড়ছে রাত বাড়ার সাথে সাথে। সাথে শীতের কাপড় নেই। কেবল ভারী একটা শার্ট। তারপরেও বাসায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা হলো না। হাটতে হাটতে পার্কটার পাশে চলে গেলাম। রাত ৯টা বাজে। খুব বেশি রাত নয়। তারপরেও শীতের রাত বলেই হয়তো রাতটাকে বেশ সৌমত্ত মনে হচ্ছে।ভয়ে ভয়ে হাটছি। কখন আবার ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়ি কে জানে। এখন ছিনতাইকারীরা নানা কৌশলে টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে। পার্কের পাশের জায়গাটা একদম নিরব। দুয়েকটা করে মানুষ মাঝেমধ্যে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম ছোট্ট একটা ছেলে আমার পিছু পিছু হাটছে। কতোইবা বয়স হবে! এই দশ বারো। মনে হলো কিছু একটা বলতে চায় ছেলেটা।
‘ স্যার , দুইডা টেহা দিবেন?’
‘ দুই টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?’
‘ এহনো রাতের খাওন খাইনি। দুপুরেও খাওন হয়নি ঠিকমতো।’
‘কিন্তু দুই টাকা দিয়ে তুমি কি খাবে?’
‘আরো কয়েকজনের কাছ থন দুই টেহা কইরা নিলে মেলা টেহা হইব। তহন ভাত খাইমু।’
এবার ছেলেটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। পরনে ময়লা কাপড়। শীতের রাতেও ভালো একটা শীতের কাপড় নেই। করুন চাহনী নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো ছেলেটা।কথা বলতে বলতে হাটছি আর ছেলেটা আমার পিছু পিছু আসছে।
‘ তুমি কিছু করো না?’
‘কে আমারে কাজ দিব স্যার?’
‘কেন তোমাকে কাজ দিবে না কেন? ছোটখাটো কাজতো করতে পারো।’
‘ স্যার আপনে আমার বিষয়ডা জানেন না বইলা এইরহম বলতে পারলেন। কাজ করতে গেলেই আশেপাশের লোকেরা বলে আমার নাকি মা বাবার পরিচয় নাই। আপনেই বলেন স্যার মা বাবার পরিচয় এর সাথে কাজের কোন সম্পর্ক আছে?’
‘তুমি তাহলে বেড়ে উঠেছো কিভাবে? এই পার্কেই থাকো নাকি?’
‘হ স্যার এই পার্কেই থাকি। পার্কের একজন আমারে বড় কইরা তুলছে। হেরে আমি খালাম্মা কইয়া ডাকি। হেয় কইছে ছুডু থাকতে আমারে নাকি পার্কের পাশে কুড়ায়া পাইছে। খুব কানতে ছিলাম আমি। তারপর থাইক্যা খালাম্মা আমারে বড় কইরা তুলছে। কিন্তু খালাম্মার আয়রোজগার তেমুন নাই। হেয় নিজেই খাইতে পারে না ঠিকমতন, আমারে কি খাওয়াইব?’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল ছেলেটি।
কি বলবো ছেলেটাকে বুঝতে পারছিলাম না। নিজেও অসহায় হয়ে তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আবার সেই শুরু করলো।
‘স্যার মাঝে মধ্যে খুব ইচ্ছা হয় মা কইরা কাউরে ডাকতে। যহন খুব খাওনের ভোগ লাগে তহন কাউর গলা জড়ায়া ধইরা খাওন চাইতে ইচ্ছা হয়। স্যার আপনেতো অনেকেরই চিনেন। হুনছি পেপারে লেখলে নাকি খুঁইজা পাওয়া যাইবো। আমার মায়রে খু্ঁইজা দেন স্যার। গলা জড়ায়া ধইরা একবার মায়রে ডাকতে চাই।’

ছেলেটার কথা শুনে চোখে পানি চলে আসলো । কি বলবো মোটেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ছেলেটার হাতে খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিয়ে চলে আসলাম। ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম, দশ বারো বছর আগে ছোট্ট একটি বাচ্চাকে পার্কের পাশে রেখে মা চলে যায়। এর পিছনে হয়তো অনেক কারণ আছে। হয়তো অর্থনৈতিক কারন; সামাজিক কিংবা নৈতিক কারণ। এতোবছর পরে ছেলেটি তার মাকে একবার মা ডাকতে চায়। সন্তান তার মাকে মা ডাকবে এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু অদ্ভুত সীমাবদ্ধতা এই ছেলেটি তার মাকে মা ডাকতে পারছে না। হয়তো তার মা এখন শহরের অন্য কোন প্রান্তে হেটে বেড়াচ্ছে। মানুষের সীমাবদ্ধতা আর শূণ্যতাগুলো বড্ড বেশি অদ্ভুত।

(চলবে......)

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

সপ্তম পর্ব

অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ১০:১১
৬১টি মন্তব্য ৬১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×