somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঝরা পালক : জীবনানন্দ দাশ

২২ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝরাপালক জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ১৯২৭ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রকাশ : ১৩৩৪ [১৯২৭]
প্রকাশক: শ্রীসুধীরচন্দ্র সরকার, ৯০/২এ হ্যারিসন রোড, কলিকাতা
মূল্য: ১ টাকা
পৃষ্ঠা: ১০+৯৩
উৎসর্গ : ‘ – কল্যাণীয়াসু – ’
কবি রচিত ভূমিকা :
ঝরা পালকের কবিতাগুলি কবিতাপ্রবাসী, বঙ্গবাণী, কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি, বিজলী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। বাকিগুলি নূতন।
কলিকাতা। ১০ই আশ্বিন ১৩৩৪ শ্রীজীবনানন্দ দাশ


কবিতাসমূহ
১. আমি কবি-সেই কবি ২. নীলিমা ৩. নব নবীনের লাগি ৪. কিশোরের প্রতি ৫. মরীচিকার পিছে ৬. জীবন-মরণ দুয়ারে আমার ৭. বেদিয়া ৮. নাবিক ৯. বনের চাতক- মনের চাতক ১০. সাগর-বলাকা ১১. চলছি উধাও ১২. একদিন খুঁজেছিনু যারে ১৩. আলেয়া ১৪. অস্তচাঁদে ১৫. ছায়া-প্রিয়া ১৬. ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল ১৭. কবি ১৮. সিন্ধু ১৯. দেশবন্ধু ২০. বিবেকানন্দ ২১. হিন্দু-মুসলমান ২২. নিখিল আমার ভাই ২৩. পতিতা ২৪. ডাহুকী ২৫. শ্মশান ২৬. মিশর ২৭. পিরামিড ২৮. মরুবালু ২৯. চাঁদিনীতে ৩০. দক্ষিণা ৩১. সে কামনা নিয়ে ৩২. স্মৃতি ৩৩. স্মৃতি ৩৪. সেদিন এ-ধরণীর ৩৫. ওগো দরদিয়া ৩৬. সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়


২২ অক্টোবর ১৯৫৪, শুক্রবার, রাত ১১-৩৫। রূপসী বাংলার কবির মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু কবির চেতনাকে নিভিয়ে দিতে পারে নি। কবিতায় কবি বারবার ফিরে আসেন জলসিড়ি নদীটির তীরে। ৫৭তম মৃত্যুদিবসে কবির প্রতি অনেক শ্রদ্ধাঞ্জলি।

প্রিয় কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থটি অনলাইনে তোলা হলো ।



ঝরা পালক



০১

আমি কবি– সেই কবি

আমি কবি– সেই কবি,–
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্‌মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!
স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক’রে!
জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা–
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ’রে!
ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,–
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!
বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
প’ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!

০২.

নীলিমা

রৌদ্র ঝিল্‌মিল,
উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
-উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
মরীচিকা-ঢাকা!
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল-
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল
তোমার ও মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী।
জনতার কোলাহলে একা ব'সে ভাবি
কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
-শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!

০৩.

নব নবীনের লাগি

-নব নবীনের লাগি
প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমার রয়েছি জাগি!
ব্যর্থ পঙ্গু খর্ব প্রাণের বিকল শাসন ভেঙে,
নব আকাঙক্ষা আশার স্বপনে হৃদয় মোদের রেঙে,
দেবতার দ্বারে নবীন বিধান-নতুন ভিক্ষা মেগে
দাঁড়ায়েছি মোরা তরুণ প্রাণের অরুণের অনুরাগী!
ঝড়ের বাতাস চাই।
চারি দিক ঘিরে শীতের কুহেলি, শ্মশানপথের ছাই,
ছড়ায়ে রয়েছে পাহাড় প্রমাণ মৃতের অস্থি খুলি,
কে সাজাবে ঘর-দেউলের পর কঙ্কাল তুলি তুলি?
সূর্যচন্দ্র নিভায়ে কে নেবে জরার চোখের ঠুলি!
মরার ধরায় জ্যান্ত কখনও মাগিতে যাবে কি ঠাঁই!
ঘুমায়ে কে আছে ঘরে!
মৃতুশিশু-বুকে কল্যাণী পুরকামিনী কি আজ মরে!
কে আছে বসিয়া হতাশ উদাস অলস অন্যমনা?
দোদুল আকাশে দুলিয়া উঠিছে রাঙা অশনির ফণা,
বাজে বাদলের রঙ্গমল্লী. ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা!
ফিরিছে বালক-ঘর পলাতক ঝরা পালকের ঝড়ে!
আমরা অশ্বরোহী!-
যাযাবর যুবা, বন্দিনীদের ব্যথা মোরা বুকে বহি,
মানবের মাঝে যে দেবতা আছে আমরা তাহারে বরি ,
মোদের প্রাণের পূজার দেউলে তাহার প্রতিমা গড়ি,
চুয়া-চন্দন-গন্ধ বিলায়ে আমরা ঝরিয়া পড়ি,
সুবাস ছড়াই উশীরের মতো, ধূপের মতন দহি!
গাহি মানবের জয়!
কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়!
সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে-কোটি কোটি শিখা জাগে,
প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে,
আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়!
-জয় মানবের জয়!

০৪.

কিশোরের প্রতি

যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির
ঢালো নি অধরে তব, ধরা-মোহিনীর
উর্ধ্বফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী
আসে নি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি
চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু
বিষবহ্নি ঢালে নিকো বাসনার বধূ
অন্তরের পানপাত্রে তব;
অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উৎসব,
অশ্রুহীন হাসি,
কামনার পিছে ঘুরে সাজো নি উদাসী।
ধবল কাশের দলে, আশ্বিনের গগনের তলে
তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ণা কভু নাহি জ্বলে!
নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরুদ্যান।
অপরূপ রূপ-পরীস্থান
দিগন্তের আগে।
তোমার নির্মেষ চক্ষে কভু নাহি জাগে!
আকাশকুসুবীথি দিয়া
মাল্য তুমি আনো না রচিয়া
ছলাময় গগনের নিচে!
-রূপ-পিপাসায় জ্বলি মৃত্যুর পাথারে
স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে
করো নিকো করাঘাত তুমি
সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি
সাজো নিকো নীলকন্ঠ ব্যাকুল বাউল!
অধরে নাহিকো তৃষ্ণা, চক্ষে নাহি ভুল,
রক্তে তব অলক্ত যে পরে নাই আজও রানী,
রুধির নিঙাড়ি তব আজও দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন!
কারাগার নাহি তব, নাহিকো বন্ধন,
দীঘল পতাকা, বর্শা তন্দ্রাহারা প্রহরীর লও নি তুলিয়া,
-সুকুমার কিশোরের হিয়া!
-জীবনসৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী,
বক্ষে তব নাচে নিকো যৌবনের দুরন্ত জলধি;
শূল-তোলা শম্ভূর মতন
আস্ফালিয়া উঠে নাই মন
মিথ্যা বাধাবিধানের ধ্বংসের উল্লাসে!
তোমার আকাশে
দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠে নিকো জ্বলি
কক্ষচ্যুত, উল্কাসম পড়ে নিকো স্খলি,
কুজ্ঝটিকা আবর্তের মাঝে
অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে!
সব বিঘ্ন সকল আগল
ভাঙিয়া জাগো নি তুমি স্পন্দন-পাগল
অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে
দুরন্ত দুরাশা তুমি জাগাও নি প্রাণে!
নিঃস্ব দুটি অঞ্চলির আকিঞ্চন মাগি
সাজো নিকো দিকভোলা দিওয়ানা বৈরাগী!
পথে পথে ভিক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু
বাজাও নি শ্মশান-ডমরু!
জোছনাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর
চক্ষে তব জাগে নি কিশোর!
আঁধারের নির্বিকল্প রূপ,
স্পন্দহীন বেদনার কূপ
রুদ্ধ তব বুকে;
তোমার সম্মূখে
ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল সুন্দরীর বেশে,
নিত্য বেলাশেষে
যেই পুষ্প ঝরে,
যে বিরহ জাগে চরাচরে,
গোধূলির অবসানে শ্লোকম্লান সাঁঝে,
তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে,
আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া জ্বালো নাই চিতা,
ব্যথার সংহিতা
গাহ নাই তুমি!
দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব-মরুভূমি
জ্বলন্ত নিষ্ঠুর!
নগরীর ক্ষুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃত্যুপ্রেতপুর,
ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি
ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি!
সভ্যতার বীভৎস ভৈরবী
মলিন করে নি তব মানসের ছবি,
ফেনিল করে নি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো,
এ উদভ্রান্ত যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজ ঢালো, বন্ধু, ঢালো!


০৫.

মরীচিকার পিছে-

ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে
সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে
ছুটে যায় দুটি আঁখি!
-কত দূর হায় বাকি!
উধাও অশ্ব বগ্লাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে
পথে পথে তার বাধা জমে যায়-তবু সে আসে না ফিরে!
দূরে-দূরে আরো দূরে-আরো দূরে,
অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ সীমানা জুড়ে
ভাসিয়াছে মরুতৃষা!
-হিয়া হারায়েছে দিশা!
কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে
কোন্‌ দিগন্তে নির্জন কোন্‌ মৌন মায়াবী-পুরে!
কোন্‌-এক সুনীল দরিয়া সেথায় উত্থলিছে অনিবার!
-কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝঙ্কার,
ছোটে অঞ্জলি পেতে,
তৃষার নেশায় মেতে,
উষর ধূসর মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার!
খুলিয়া দিয়াছে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!
কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি!
যত খুন যত খারাবীর ঘোরে পরান আছিল মাতি,
নিমেষে গিয়েছে ভেঙে
স্বপন-আবেশে রেঙে
আঁখিদুটি তার জৌলস্‌ রাঙা হ’য়ে গেছে রাতারাতি!
কোন্‌ যেন এক জিন্‌-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী।
কোন্‌ যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে!
পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে!
গেঁথে গোলাপের মালা
তাকায়ে রয়েছে বালা,
বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস্‌ কালো পশমিনা চুলে!
বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে।
ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত অশ্ব কশাঘাত জর্জর,
চারি দিকে তার বালুর পাথার-মরুর হাওয়ার ঝড়;
নাহি শ্রান্তির লেশ,
সুদুর নিরুদ্দেশ-
অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকের পর!
পথের তালাসে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!
আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়!
চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়!
ঝড়ের বাতাস মিছে
ছুটছে তাহার পিছে!
মরুভূর প্রেত চকমিয়া তার চক্ষের পানে চায়-
সুরার তালাসে চুমুক দিল কে গরলের পেয়ালায়!


০৬.

জীবন-মরণ দুয়ারে আমার

সরাইখানার গোলমাল আসে কানে,
ঘরের সার্সি বাজে তাহাদের গানে,
পর্দা যে উড়ে যায়
তাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়!
-মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে!
আজও মন ওঠে রেঙে
দিলদারদের দরাজ গলায় রবে,
সরায়ের উৎসবে!
কোন্‌ কিশোরীর চুড়ির মতন হায়
পেয়ালা তাদের থেকে থেকে বেজে যায়
বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!
সারা জনমের শুষে-নেওয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!
পান্ডুর দুটি ঠোঁটে
ডালিম ফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে!
মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসি ভরা লাল গাল,
ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যত কিছু জঞ্জাল!
আখেরের ভয় ভুলে
দিলওয়ার প্রাণ খুলে
জীবন-রবাবে টানিছে ক্ষিপ্ত ছড়ি!
অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি-
নিভিছে দিনের আলো
জীবন মরণ দুয়ারে আমার করে যে বাসিব ভালো
একা একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন!
পূর্ণ হয় নি পিপাসী প্রাণের একটি আকিঞ্চন,
নি একটি দল,-
যৌবন শতদলে মোর হায় ফোটে নাই পরিমল!
উৎসব-লোভী অলি
আসে নি হেথায়
কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি!
সারাটি জীবন বাতায়নখানি খুলে
তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন্‌ যায় দুলে
আশা-নিরাশার বালু-পারাবার বেয়ে,
সুদূর মরুদ্যানের পানেতে চেয়ে!
সুখদুঃখের দোদুল ঢেউঢের তালে
নেচেছে তাহারা- মায়াবীর জাদুজালে
মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি,
মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি!
মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি!
মস্তানা সেজে ভেঙে গেছ ঘরদোর,
লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর!
কারার ধুলায় লুন্ঠিত হ’য়ে বান্দার মতো হায়
কেঁদেছে বুকের বেদুঈন মোর দুরাশার পিপাসায়!
জীবনপথের তাতার দুস্যুগুলি
হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি
মোর গবাক্ষে কবে!
কন্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্তব্ধ নভে!
আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে,
সারাটি নিশীথ খুন রোশনাই প্রদীপে মনটি রেঙে
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
পাই নি যে তাহা টের!
-দূর দিগনে- চ’লে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!
কোন্‌ সুদুরের তুরাণী-প্রিয়ার তরে,
বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
দীর্ঘ দিবস ব’য়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা
চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের “রোজা”
আমার গগনে ঈদরাত কভু দেয় নি হায় দেখা,
পরানে কখনও জাগে নি রোজা’র ঠেকা!
কী যে মিঠা এই সুখের দুখের ফেনিল জীবনখানা!
এই যে নিষেধ, এই যে বিধান-আইনকানুন, এই যে শাসন মানা,
ঘরদোর ভাঙা তুমুল প্রলয়ধ্বনি
নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি
যুবানবীনের নটনর্তন তালে,
ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে দেশে কালে কালে,
এই যে তৃষ্ণা-দৈন্য-দুরাশা-জয়-সংগ্রাম-ভুল
সফেন সুরার ঝাঝের মতন ক’রে দেয় মজ্‌গুল
দিওয়ানা প্রাণের নেশা!
ভগবান, ভগবান, তুমি যুগ যুগ থেকে ধ’রেছ শুড়ির পেশা!
-লাখো জীবনের শূণ্য পেয়ালা ভরি দিয়া বারবার
জীবন-পান্থশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝঙ্কার-
মাতালের চিৎকার
অনাদি কালের থেকে;
মরণশিয়ারে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে!
হেরিলাম দূরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ প্রায়
জীবনের নদী কলরোলে ব’য়ে যায়!
কোটি শুঁড় দিয়ে দুখের মরুভ নিতেছে তাহারে শুষে,
ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রাণের খেয়াল-খুশে!
মরণ-সাহারা আসি
নিতে চায় তারে গ্রাসি!-
তবু সে হয় না হারা
ব্যথার রুধিরধারা
জীবনমদের পাত্র জুড়িয়া তার
যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গড়িছে মশালাদার!

০৭.

বেদিয়া

চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি!
পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনিবে ডাকি?
উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে,
গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে;
নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী,
ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহপ্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি!
কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে,
ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণচিহ্ন বিনে!
যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে,
কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে
তারই প্রতীক্ষা মেগে ব’সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু!
দিকে দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরিচূড়া-তরু
ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে
কালো মৃত্তিকা ঝরা কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে
ছড়ায়ে পড়িছে দিগ্‌দিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি!
বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি
লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস!
ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস
নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে
বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে!
তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে,
তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দরমূলে।
ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল’য়ে কলরব ক’রে ছুটে
নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে।
তারই লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা,
তাহারই লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা!
চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে
ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে!
যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,
চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল,
-তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সীঁথি,
তার চেয়ে ভালো আলো-ঝল্মল্ শীতল শিশিরবীথি,
তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,
তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!
কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে!
মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে
আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে,
মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!

০৮.

নাবিক

কবে তব হৃদয়ের নদী
বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি!
সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে
দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে
বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন!
পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন!
কারাগার-মর্মরের তলে
নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে
ভ’রে যায় বসুধার আহত আকাশ!
অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!
-সহস্রের অঙুলিতর্জন
নিত্য সহিতেছি মোরা-বারিধির বিপ্লব-গর্জন
বরিয়া লয়েছ তুমি, তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;
তোমার পক্ষরতলে টগ্‌বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!-
তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার,
অবগুণ্ঠিতার
হিমকৃষ্ণ অঙুলির কঙ্কাল-পরশ
পরিহরি গেলে তুমি-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস
তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা
চকিতে চূর্ণিয়া গেলে-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা
বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,
তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট
তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!
নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!
প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!
ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,-
অগাধের সাধ
তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ!
মণিময় তোরণের তীরে
মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে
নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে
হে দুরন্ত দুর্নিবার-প্রাণ তব কাঁদে!
ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন,
সমুদ্রের যৌবন-গর্জন
তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর শের!
টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের
হে জলধি পাখি!
পে তব নাচিতেছে ল্যহারা দামিনী-বৈশাখী!
ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রতœচূড় ময়ূখের টিপ,
কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ
করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে!
বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে
সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে!
কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে-
স্তম্ভিত নয়নে
নীল বাতায়নে
তাকায়েছ তুমি!
অতি দূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের
আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি
সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী!
সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি
আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া
হে জল-বেদিয়া!
অল্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন
সিন্ধু বেদুঈন!
নাহি গৃহ, নাহি পান্থশালা-
লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা
তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্যপাতালে-
বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে!
প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!
সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছুডাকা স্বর
ভুলেছ নোঙর!
কোন্ দূর কুহকের কূল
লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল
কে বা তাহা জানে!
অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!

০৯.

বনের চাতক–মনের চাতক

বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়-
মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়!
ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে-
সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের লোভে
বনের চাতক-মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!
পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে!
কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে!
বাদল-বৌয়ের চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে
বনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে,
ঘাটের ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!
ওরে চাতক, বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে
নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে,
“দে জল!” ব’লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল
খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে ছল্‌ছল্ !
মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!
মনের চাতক, হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি
কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি ছাড়ি?
ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে,
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে!
আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, আয় রে তাড়াতাড়ি।
বনের চাতক, মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
সে কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!

১০.

সাগর - বলাকা

ওরে কিশোর, বেঘোর ঘুমের বেহুঁশ হাওয়া ঠেলে
পাতলা পাখা দিলি রে তোর দূর-দুরাশায় মেলে!
ফেনার বৌয়ের নোন্‌তা মৌয়ের মদের গেলাস লুটে,
ভোর-সাগরের শরাবখানায়–মুসল্লাতে জুটে
হিমের ঘুণে বেড়াস খুনের আগুনদানা জ্বেলে!
ওরে কিশোর, অস্তরাগের মেঘের চুমায় রেঙে
নীল নহরের স্বপন দেখে চৈতি চাঁদে জেগে
ছুটছ তুমি চ্ছল চ্ছল জলের কোলাহলের সাথে কই!
উছলে ওঠে বুকে তোমার আল্‌তো ফেনা-সই
ঢেউয়ের ছিটায় মিঠা আঙুল যাচ্ছে ঠোঁটে লেগে!
রে মুসাফের, পাতাল-প্রেতপুরের মরীচিকা
সাগরজলের তলে বুঝি জ্বালিয়ে দেছে শিখা!
তাই কি গেলে ভেঙে হেথায় বালিয়াড়ির বাড়ি!
দিচ্ছ যাযাবরের মতো সাগর-মরু-পাড়ি-
ডাইনে তোমার ডাইনীমায়া, পিছের আকাশ ফিকা!
বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে!
ফুটছে ভাষা কেউটে ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে!
প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে
বরুণরানি ফিরছে যেথা, মুক্তপ্রদীপ জ্বলে
যেথায় মৌন মীনকুমারীর শঙ্খ ওঠে ফুঁকে।
যেই খানে মূক মায়াবিনীর কাঁকন শুধু বাজে
সাঁজ সকালে, ঢেউয়ের তালে, মাঝসাগরের মাঝে!
যায় না জাহাজ যেথায়- নাবিক, পায় না নাগাল যার,
লুঘ উদাস পাখায় ভেসে আঁখির তলে তার
ঘুরছে অবুজ সে কোন সবুজ স্বপন-খোজার কাজে!
ওরে কিশোর, দূর-সোহাগী ঘর- বিরাগী সুখ!
টুকটুকে কোন্‌ মেঘের পারে ফুটেফুটে কার মুখ
ডাকছে তোদের ডাগর কাঁচা চোখের কাছে তার!
-শাদা শকুনপাখায় যে তাই তুলছে হাহাকার
ফাঁপা ঢেউয়ের চাপা কাঁদন-ফাঁপর ফাটা বুক!

১১.

চলছি উধাও

চলছি উধাও, বল্গাহারা- ঝড়ের বেগে ছুটে
শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে!
কোন্‌ সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি!
-আঁধার আলোর সাগরশেষে
প্রেতের মতো আসছে ভেসে!
আমার দেহের ছায়ার মতো, জড়িয়ে আছে মনের সনে,
যেদিন আমি জেগেছিলাম, সেও জেগেছে আমার মনে!
আমার মনের অন্ধকারে
ত্রিশূলমূলে, দেউলদ্বারে
কাটিয়েছে সে দুরন্ত কাল ব্যর্থ পূজার পুষ্প ঢেলে!
স্বপন তাহার সফল হবে আমায় পেলে, আমায় পেলে!
রাত্রিদিবার জোয়ার স্রোতে
নোঙরছেঁড়া হৃদয় হ’তে
জেগেছে সে হালের নাবিক
চোখের ধাধায় ঝড়ের ঝাঁঝে
মনের মাঝে মানের মাঝে
আমার চুমোর অন্বেষণে
প্রিয়ার মতো আমার মনে
অঙ্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে,
চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রুপাথার-কূলে!
ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে
হাতটি রেখে হাতে!
দেখিনি তার মুখখানি তো,
পাইনি তারে টের,
জানি নি হায় আমার বুকে আশেক-অসীমের
জেগে আছে জনমভোরের সূতিকাগার থেকে!
কত নতুন শরাবশালায় নাবনু একে একে!
সরাইখানার দিলপিয়ালায় মাতি
কাটিয়ে দিলাম কত খুশির রাতি!
জীবন-বীণার তারে তারে আগুন-ছড়ি টানি
গুঞ্জরিয়া এল-গেল কত গানের রানি,
নাশপাতি-গাল গালে রাখি কানে কানে করলে কানাকানি
শরাব-নেশায় রাঙিয়ে দিল আঁখি!
-ফুলের ফাগে বেহুঁশ হোলি নাকি!
হঠাৎ কখন স্বপন-ফানুস কোথায় গেল উড়ে!
-জীবন মরু- মরীচিকার পিছে ঘুরে ঘুরে
ঘায়েল হয়ে ফিরল আমার বুকের কেরাভেন-
আকাশ-চরা শ্যেন!
মরুঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি
প্রাণ যে তাহার রইল তবু জাগি
ইবলিশেরই সঙ্গে তাহার লড়াই-হল শুরু!
দরাজ বুকে দিল্‌ যে উড়–উড়-!
ধূসর ধু ধু দিগন্তরে হারিয়ে যাওয়া নার্গিসেই শোভা
থরে থরে উঠল ফুটে রঙিন-মনোলোভা!
অলীক আশার, দূর-দুরশার দুয়ার ভাঙার তরে
যৌবন মোর উঠল নেচে রক্তমুঠি, ঝড়ের ঝুঁটির পরে!
পিছে ফেলে টিকে থাকার ফাটকে কারাগারে
ভেঙে শিকল ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার
চলল সে যে ছুটে!
শৃঙ্খল কে বাধল তাহার পায়ে-
চুলের ঝুটি ধরল কে তার মুঠে!
বর্শা আমার উঠল ক্ষেপে খুনে,
হুমকি আমার উঠল বুকে রুখে!
দুশমন কে পথের সুমুখে
-কোথায় কে বা!
এ কোন মায়া
মোহ এমন কার!
বুকে আমার বাঘের মতো গর্জাল হুঙ্কার!
মনের মাঝের পিছুডাকা উঠল বুঝি হেঁকে-
সে কোন সুদূরে তারার আলোরে থেকে
মাথার পরের খা খা মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে
নেমে এল রাত্রিদিবার যাত্রাপথে কে রে!
কী তৃষা তার!
কী নিবেদন!
মাগছে কিসের ভিখ্‌!
উদ্যত পথিক
হঠাৎ কেন যাচ্ছে থেমে-
আজকে হঠাৎ থামতে কেন হয়!
-এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়!
পথ- আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি
আজকে নিল ডাকি
হালভাঙা এই ভুতের জাহাজটারে!
মড়ার খুলি-পাহাড়প্রমাণ হাড়ে
বুকে তাহার জ’মে গেছে কত শ্মশান-বোঝা!
আক্রোশে হা ছুটছিল সে একরোখা, এক সোজা
চুম্বকেরই ধ্বংসগিরির পানে,
নোঙরহারা মাস্তুলেরই টানে!
প্রেতের দলে ঘুরেছিল প্রেমের আসন পাতি,
জানে কি সে বুকের মাঝে আছে তাহার সাথী!
জানে কি সে ভোরের আকাশ, লক্ষ তারার আলো
তাহার মনের দূয়ারপথেই নিরিখ হারালো!
জানি নি সে তোহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে
কোন্‌ দিওয়ানার সারেং কাঁদে
নয়নে নীর ঝরে!
কপোত-ব্যথা ফাটে রে কার অপার গগন ভেদি!
তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদি
কোন্‌ সে অসীম আসি!
লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকের পাশাপাশি
প্রেমের খবর পুছে
কবের থেকে কাঁদতে আছে-
‘পেয়ালা দে রে মুঝে!’

১২.

একদিন খুঁজেছিনু যারে

একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে, কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে-কেয়াফুল, শেফালীর দলে!
-যাহারে খুজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুজিয়াছিনু ঝরঝর
কামিনীর ব্যথার শিয়রে
যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়-
আজ মনে হয়
পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা@
-শুধু শেষ নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা
দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ
গাগরীর কোলে তার উত্থলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকা পথের চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি, আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো আধো কথা!
আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!
পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর, ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ, শুধু অবসাদ!
মাহুয়ার, ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায় না তৃষা মোর, জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ-আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,
পথে পথে কালো যবণিকা!
কাতর ক্রন্দন,-
কামনার কবর-বন্ধন!
কাফনের অভিযান, অঙ্গার সমাধি!
মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!
মর্‌মর্‌ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন-
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!-
কোন্‌ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো
মোর কেঁদে মরে মন!

(বাকি কবিতাগুলো কমেন্ট অংশে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ১০:৫৫
২৬টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×