View this link
News Details - Full Banner_Above
গ্রেপ্তারের আগে এক কারখানার মালিকের লিখিত বক্তব্য
কারখানা খুলতে বাধ্য করেছিলেন সোহেল রানা
পোশাকশিল্প মালিক সমিতি বিজিএমইএর মাধ্যমে সমঝোতা করে আরও এক কারখানার মালিক পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে পুলিশ দাবি করেছে, গতকাল রোববার রাতে বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে ইথার টেক্সের মালিক আনিসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধসে পড়া রানা প্লাজার ষষ্ঠ তলায় তাঁর কারখানা ছিল।
পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মিজানুর রহমান ইথার টেক্সের মালিক আনিসুর রহমানের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আনিসুর রহমান গতকাল রাত নয়টার দিকে বিজিএমইএ ভবনে যান। সেখান থেকে টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। বিজিএমইএ ভবনে যাওয়ার আগে নিজ হাতে তিনি একটি বিবৃতি লিখে রাখেন। বিবৃতিতে তিনি ভবনধসের বিস্তারিত লিখেছেন। প্রথম আলোর হাতে তাঁর লেখা বিবৃতিটি রয়েছে। আনিসুর রহমান ভবনধসের জন্য ভবনমালিক সোহেল রানাকেই মূলত দায়ী করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভবনমালিক সোহেল রানা পোশাক কারখানার মালিকদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিলেন যে ভবনটি ১০০ বছরেও কিছু হবে না। তিনি মালিকদের কাছে আরও দাবি করেছিলেন, প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দিয়ে তিনি ভবনটি পরীক্ষা করিয়েছেন। যদিও লিখিতভাবে কোনো কিছু ভবনমালিকের কাছে ছিল না।
আনিসুর রহমানের লিখিত বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ ছাপা হলো তাঁরই ভাষায়।
২৩ এপ্রিল কী ঘটেছিল: মঙ্গলবার সকালে তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ কারখানায় একটি পিলারের পলেস্তারা খসে পড়ার সংবাদ পেয়ে কারখানা তৎক্ষণাৎ ছুটি দিয়ে ফ্লোরটি খালি করে দেওয়া হয়। তারপর পরিচালনা পর্ষদের জরুরি বৈঠক ডেকে একটি নোটিশ জারি করা হয়।
নোটিশে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে উপমহাব্যবস্থাপক কামরুজ্জামান এবং সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের ইনচার্জদের ভবনের প্রতি নজর রাখার আদেশ দেওয়া হয়।
ওই দিনই একাধিকবার ভবনমালিক সোহেল রানা, তাঁর ফুফা আবদুস সালাম, ব্যবস্থাপক আতাউরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়টি অবহিত করে প্রকোশলী দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুরোধ জানানো হয়। আমরা তাঁদের জানাই, প্রকৌশলীদের অনুমোদন পেলেই কারাখানা পুনরায় পরিচালনা করব। কিন্তু সোহেল রানা আমাদের নিশ্চয়তা প্রদান করেন, তাঁর অভিজ্ঞ প্রকৌশলী এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আগামী ১০০ বছরেও ভবনের কিছু হবে না। তবে এর পক্ষে তিনি কোনো সনদ দেখাতে পারেননি।
এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইথারের পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, যতক্ষণ না নির্ভরযোগ্য প্রকৌশলীরা ভবনটি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্তই বলবৎ থাকবে।
ঘটনা যেভাবে ঘটে: কারখানা বন্ধ থাকার পরিকল্পনা সত্ত্বেও বুধবার সকালে ইথারের প্রধান ফটকটি জোরপূর্বক খুলতে বাধ্য করেন ভবনমালিক। তারপর কারখানা চালু করতে বললে উপমহাব্যবস্থাপক কামরুজ্জামান আপত্তি জানান। এ সময় সোহেল রানা ভবনের অন্য তলায় অবস্থিত নিউ ওয়েভ কারখানা চালু থাকার কথা জানান।
কামরুজ্জামান সকাল আটটা ১২ মিনিটে আমাকে ফোন করলে আমি কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিই। ততক্ষণে কিছু শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করেন এবং তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন সেকশন ইনচার্জরা কারখানায় প্রবেশ করেন।
এর মধ্যেই অন্যান্য ফ্লোরে পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গেলে গোটা ভবনে কর্মময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ষষ্ঠ তলার ইথার টেক্সের শ্রমিক-কর্মচারীরা তখন দোটানায় পড়ে যান। এ সময় যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তা নিয়ন্ত্রণ করতে কামরুজ্জামান উপস্থিত সবাইকে নিজ নিজ বিভাগে অবস্থানের অনুরোধ জানান। তারপর সারিবদ্ধভাবে কারখানা ত্যাগের আদেশ দেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ঘটে যায় বিরাট দুর্ঘটনা।
কে দায়ী: দুর্ঘটনার জন্য পোশাক কারখানার মালিকেরা দায়ী কি না, সে প্রশ্ন তোলেন মো. আনিসুর রহমান। তিনি এ বিষয়ে বিবৃতিতে লেখেন, ‘আমরা যখন ভবন ভাড়ার চুক্তি করি, তখন মালিক আমাদের ষষ্ঠ তলার অনুমোদনপত্র দেন। পরবর্তী সময়ে তা লঙ্ঘন করে ভবনটি নয়তলা করা হয়। এর বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই অভিযোগ জানাই। ইথার টেক্স এবং ফ্যানটমের তিনটি ফ্লোরের জেনারেটর বেজমেন্টে স্থাপন করা হয়। তবে নিউ ওয়েভ নিজেদের তৃতীয়, সপ্তম ও অষ্টম তলায় পৃথকভাবে তিনটি জেনারেটর স্থাপন করতে ভবনমালিককে সম্মত করায়। এ বিষয়েও আমাদের অভিযোগ ছিল। কিন্তু সেটা আমলে নেননি তাঁরা। সোহেল রানা তাঁর সুনাম ও জনপ্রিয়তা প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন কারণে কারখানা থেকে শ্রমিকদের মিছিলে অংশ নিতে বাধ্য করতেন। অনৈতিক চাঁদা আদায় করতেন। আপত্তি জানালে তাঁর সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ব্যবসা ও জানমালের ক্ষতি করার হুমকি দিতেন।’
চৌদ্দ পৃষ্ঠার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আনিসুর রহমান বলেন, সকল পোশাকশিল্প কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা প্রত্যেকেই জানে যে একটি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য দুই ডজনেরও বেশি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভবনের নকশা ও প্রকৌশলীদের প্রত্যয়নপত্র চাওয়া হয়। এতগুলো দপ্তরের পর্যবেক্ষণের পরও ভবন ধসে পড়ার দায়দায়িত্ব শুধুই কারখানার মালিকের কি না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সবশেষে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজেকে আইনের হাতে সোপর্দ করেছেন বলে জানান তিনি।