somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি হারিয়ে যাওয়া ট্রেনের গল্প

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক দিন খুব বোরিং দিন যাচ্ছে। ক্লাস, এসাইনমেন্ট আর টিউশনি মিলিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত দিন। তো আমরা চার ফ্রেন্ড মিলে ঠিক করলাম চিটাগাং চলে যাব। তার মধ্যে হঠাত করে নীতু এসে বলল সেও তার তিন বান্ধুবী সহ যাবে! সব ঠিক এর মধ্যে নীতু এসে যত্ত ঝামেলা পাকায়! ট্যুরে কোন মেয়ে যাবে না এমনটা ঠিক হলেও নীতুর যেই কথা সেই কাজ। তো আমাদের পালের গোদা আসিফ গম্ভীর স্বরে বলল, ভ্রমণে মেয়েছেলে নিয়ে যাওয়া একটা পেইনফুল কাজ! সারাক্ষণ চিল্লায়ে চিল্লায়ে কান ঝালাপালা করে ফেলবে। এ কথা শুনে নীতু ঘোষণা করল আসিফ বিয়ের পর যদি তার বউকে নিয়ে হানিমুন অথবা অন্য কোথায় যায় তাহলে তাকে খুন করবে। এ কথা বলার পর আর কোন কথা মানায় না। আসিফ খুব মলিন মুখে নীতুর কথা মেনে নিল।

অবশেষে আমাদের ভ্রমণের দিন তারিখ ঠিক হল। অনেক বন্ধুরা মিলে ঘুড়তে যাওয়ার মজাই আলাদা। তো ঠিক হল সামিরের মামার বাসায় আমরা উঠব। আমি বলতে চাইলাম পরিচিত কারও বাসায় উঠলে তো চিল্লাপাল্লা করা যাবে না। আমাকে মাঝপথে সামির থামায়ে দিয়ে বলল, “এই অয়নের জন্যই যত্ত ঝামেলা, গাধা অয়ন!” আমি বললাম, আমাকে গাধা বলছিস যে হাঁদারাম যখন নিজেই চিল্লাপাল্লা করতে পারবি না তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল। যাই হোক, আমার কথা এখানে টিকল না। গন্তব্য ঠিক হল সামিরের চাচার বাসা।

তো যথারীতি ভ্রমণের দিন চলে এল। আমরা দল বেঁধে হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠে গেলাম। নীতুর জীবনে এটা প্রথম ট্রেন জার্নি। বাচ্চারা খেলনা পেলে যতটা আনন্দিত হয় নীতু ঠিক ততটাই আনন্দিত। আনন্দ একটা ভাইরাসের মতন। একজনের আনন্দে অন্যরাও ঠিক সমান আনন্দিত হয়। বলতে গেলে নীতু একাই জার্নিটা জমিয়ে তুলল। সমানে চিৎকার করে ট্রেনের এই বগিটাকে আমারা পাগলের কামড়া বানিয়ে ফেলেছি। এরই মধ্যে সামির গান ধরল। ছেলেটা মারত্মক গিটার বাজায়। গানের তালে তালে ট্রেন ছুটে চলল সব গাছগাছালি আর খাল-বিলকে পিছনে ফেলে। সবার চেয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে ভাবতে লাগলাম এত আনন্দে এক জীবনে ঈশ্বর দিয়ে রেখেছেন। বাড়ি-গাড়ি বা টাকা-পয়সা দিয়ে আনন্দ কেনা যায় না। আনন্দ সত্যিই অন্যরকম একটা জিনিস। কারও অনেক টাকা পয়সা থাকতে পারে, সে যা চায় তাই পেতে পারে কিন্তু এরকম আনন্দ কি সে পাবে? মনে হয় না। টাকা-পয়সা দিয়ে সব কেনা যায় কিন্তু আনন্দ বোধ হয় কেনা যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাত মাহিনের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। “অয়ন, ঐখানে বসে বসে কি ডিম পারতেছিস নাকি। গাধা এদিকে আয়।” ফ্রেন্ড সার্কেলে এমন একজন অতি অবশ্যই থাকতে হবে যাকে পচায়ে সবাই মজা পাবে। আড্ডা জমায়ে তোলার জন্য হলেও তাকে পচতে হয়। আমি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “দোস্ত, আর পচাইস না রে। এখনি এত্ত পচাইলে পরে কেমনে পচাবি বল তো? কিছু পচানো পরের জন্য রেখে দে!” মাহিন হঠাত খুব সিরিয়াস হয়ে বলল, “দোস্ত, বেশি রাগ করেছিস নাকি?? ফান করেছি তো।” আমি হাসতে হাসতে বললাম, “ধুর বেকুব, আমিও তো ফানই করলাম।” মজা করতে করতে আমরা গন্তব্যে চলে আসলাম।

লাইফের সবচেয়ে মজার কিছু সময় চিটাগাং এ কাটালাম। একসাথে কত্ত ঘুড়াঘুড়ি, কত্ত আড্ডা। সামিরের চাচার বাসা শহর থেকে একটু ভেতরে। গ্রামের দিক থাকতে ভালই লাগে। শহুরে একঘেয়ে থেকে মুক্তি। প্রায় চারদিন চিটাগাং থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে আমরা রওনা দিব। এমন সময় সামিরের চাচা হঠাত এক সারপ্রাইজ নিয়ে এলেন। এক বাউলাকে আমাদের সামনে এনে হাজির করালেন। লম্বা লম্বা চুলের এই লোকটার গান শুনে আমরা মুগ্ধ হলাম। কি মায়া নিয়ে ভরাট গলায় লোকটা গান গায়। লোকটার কন্ঠে ভরাট গলার গান শুনে খুব ভাল লাগল। হঠাত করে সে একটা গান ধরল, “বাউলা কে বানাইল রে, হাসন রাজারে বাউলা কে বানাইল রে।” গান শুনতে শুনতে হঠাত ভাবতে লাগলাম আসলেই তো হাসন রাজারে কে বাউলা বানাইল।! হাসন রাজা বাউলা না হলেই বা কি হত। গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে লোকটা উঠে চলে গেল। সামিরের চাচা হাঁক দিয়ে বললেন, “তানভীর, খেয়ে যা।” বুঝলাম ঐ বাউলাটার নাম তানভীর। কিন্তু ওর এভাবে উঠে চলে যাওয়ার কাহিনী কিছুই বুঝলাম না। সামিরের চাচা খুব গম্ভীর গলায় বললেন, লোকটা আসলেই বাউলা। যখন যা মাথায় আসে তাই করে ফেলে। আজীব লোক!


পরদিন সারাদিন ঘুড়ে রাতের ট্রেনে আমাদের ফিরে আসার কথা। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে এসেছি স্টেশনে। বাংলাদেশের ট্রেনের যা অবস্থা। স্টেশনে এসে জানলাম ট্রেন দুই ঘন্টা দেরী হবে। সবাই মিলে আবারো গল্প করা শুরু করল। আমি একটু দূরে গিয়ে একটা বেনসন ধরালাম। ধরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হঠাত করে সেই বাউলাকে দেখলাম উদাস নয়নে একটা বেঞ্চের উপর বসে আছে। হঠাত তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সে একটু বিষম খেয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, অয়ন ভাইয়া, আপনারা চলে যাচ্ছেন বুঝি? আমি একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, হু। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?
সে বলল, কালকে আপনার বন্ধুদের ওই নামে ডাকতে শুনেছি।
তারপর সে খুবই ভরাট গলায় বলল, আচ্ছা ট্রেন গুলো যে যাচ্ছে তার গন্তব্য আমরা জানি কিন্তু মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত কোথায় যাচ্ছে, কোথায় যাবে তা কি আমরা জানি? তাও তো আমরা ছুটে চলি তাই না? আমি একটু বিষম খেলাম। সে বলে চলল, আচ্ছা মানুষ যদি জানত তার গন্তব্য কোথায় তাও কি সে ছুটে চলত? সে বোধ হয় ছুটত না। সে আমার মত থেমে যেত। মানুষ কেবল মাত্র মৃত্যুর আগে একবার জানতে পারে তার গন্তব্য কোথায়। এর আগে একবারও না। আমি তখন তাকে হড়বড় করে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, আপনি কি আপনার গন্তব্য পেয়ে গেছেন? সে আমার দিক উদাস নয়নে তাকাল। তারপর বলে চলল, হু পেয়েছি। আপনি আমার গল্প শুনবেন? আমি মৃদু স্বরে হু বললাম। সে যা বলল তা অনেকটা নিম্নরূপ আসে......


“আমার জন্মের সময় আমার মা মারা যান। পরে আমার বাবা আমাকে অন্য এক পরিবারের কাছে দত্তক দিয়ে বিদেশ চলে যান। নতুন পরিবার আমাকে খুব যত্নের সাথে লালন পালন করতে লাগল। কোনদিন বুঝতেও দেয় নি যে উনারা আমার সত্যিকারের বাবা মা না। তারপর একদিন আমি হুট করে জেনে ফেলি সব সত্য ঘটনা। তারপর এক সময় হুট করেই পড়ালেখা ছেড়ে দিই। সব কিছু অসহ্য লাগা শুরু হয়। সমগ্র পৃথিবীটাই। একটা সময় হুট করেই একজনের প্রেমে পড়ে যাই। যখন তার প্রেমে পড়ি তখনই জানতাম আমাদের কোন কিছু হবে না। মেয়েটা আমাকে পছন্দ করবে না। তাও প্রেমে কি কেউ আর এতকিছু ভেবে পরে। আমি পড়লাম এবং খুব ভালভাবেই পড়লাম। যখন বুঝলাম মেয়েটা আমাকে একদমই পছন্দ করে না তখন আর কি করার। মন খারাপ করে একসময় লিখালিখি শুরু করে দিলাম। সাপ্তাহিক পত্রিকায় গল্প বেরুতে লাগল। এর মধ্যে ওই মেয়েটাকে সরাসরি প্রপোজ করে ফেললাম এবং মেয়েটা মানাও করে দিল। যখন মেয়েটা আমাকে ফিরিয়ে দিল তখন খুব কষ্ট পেলেও সব মেনে নিয়েছি। রাগের চোটে লেখালেখিও বন্ধ করে দিলাম। পড়ালেখার অবস্থা খারাপ, বাসায় ঝামেলা, মন খারাপ থাকলে আগে লিখালিখি করতাম সেটাও বন্ধ। অদ্ভুত কষ্ট নিয়ে বহুটা দিন পার করে ফেললাম। এর মধ্যে এক ঘটনা ঘটে গেল। আমার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে যেদিন শেষ একটা গল্প লিখে ফেললাম তার কদিন পর হঠাত একটা ম্যাসেজ দেখতে পেলাম। তেমন কিছু না। গল্পকারকে শুভকামনা জানিয়ে ম্যাসেজ। এরকম ম্যাসেজ মাঝে মাঝেই আসত। এগুলো দেখার বিষয় না। যাকে নিয়ে লিখতাম সেই যখন দেখত না বাকি সবকিছুই অর্থহীন। সাধারণত এসব ম্যাসেজের রিপ্লাই দেওয়া হয় না। তারপরেও ঐ ম্যাসেজটার ভেতর অদ্ভুত একটা কিছু ছিল যেটা আমাকে রিপ্লাই দিতে বাধ্য করেছিল। কিসের টানে আমি ছুটে গিয়েছি আমি জানি না তবুও আমি ছুটে গিয়েছি। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল মানুষটার যেন আর কোন কষ্ট না থাকে। তারপর বহুটা দিন এই মানুষটার সাথে কথা হয় না। একদিন ভুল করেই ম্যাসেজ দিলাম। সেই ভুল যেন ফুল হয়ে ফুটে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে কথা হতে লাগল। দিনের পর দিন ফোনালাপ। হঠাত করেই জীবনটা ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়ে উঠতে লাগল। সেই সকাল আটটায় ক্লাস করতে যাওয়া, ক্লাস শেষ করে ফেরা, আরও কিছু কাজ করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে রাত দশটা এগারটায় রুমে ফেরা। তারপর কিছুটা রেস্ট নিয়ে সেই বন্ধুটার সাথে কথা বলা। তার নাম অবন্তী। কি সুন্দর নাম। যখন সে জীবনে প্রথমবার তার পুরো নাম বলল আমি ভয়ানক বিষম খেলাম। এ কি! তার নামের বাংলা অর্থ সৌভাগ্যবান আবার আমার নামের বাংলা অর্থও সৌভাগ্যবান! কেমনে কি!

প্রত্যেকটা দিন এত্ত সুন্দর কাটতে লাগল যে আমি মনে মনে প্রচন্ড ভয় পেতে লাগলাম কবে ঝড় এসে সব উলটে পালটে যায়। এত্ত সুন্দর জীবনটা কি আমার? সত্যিই ঈশ্বর তার সমস্ত করুণা আমার উপর বর্ষণ করছেন? কিভাবে সম্ভব আমার মত মানুষের জীবন এতটা ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর হওয়া? সারা দিনের সমস্ত কাজ করতে আমার বিন্দুমাত্র ক্লান্তি লাগত না কারণ আমি জানতাম আমার জীবনে একজন আছে যার সাথে কথা বললে সমস্ত ক্লান্তি চলে যাবে। সারাটা দিন প্রচন্ড ব্যস্ত থেকে শুধুমাত্র রাত এগারটার পরে কিছুটা অসম্ভব সুন্দর সময় আসবে এটা ভেবেই সব কাজ যেন খুব খুব ভালভাবে করতে পারতাম। তখনও আমরা কেউ কাউকে বলি নি “আই লাভ ইউ!” এইসব ছাইপাশ আই লাভ ইউ এর কি শক্তি আছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভালবাসাকে বোঝাবে? তারপর একদিন সত্যি সত্যি মেয়েটাকে সব খুলে বললাম। অবন্তী নামের মেয়েটাও কিভাবে কিভাবে যেন রাজী হয়ে গেল।

সময় নৌকার পালে বেয়ে বেয়ে কেটে যেতে লাগল। সারাদিনের খুনসুটি, মান-অভিমান, ঝগড়া সব শেষে কি মিষ্টি ভালবাসা। পৃথিবীর প্রত্যেক কাপলই বোধহয় নিজেদের ভালবাসাটাকে শ্রেষ্ঠ ভালবাসা বলে ধরে নেয়। ঠিক তেমনি আমরাও। আমরা দুই জন যোজন যোজন মাইল দূরে থাকতাম। তাই বলে দূরত্বের সাধ্যি নেই ভালবাসাটাকে উপেক্ষা করবে। তো বেশ কিছুদিন পর যেদিন আমরা প্রথম দেখা করব সেদিন আমার বেশ টেনশন বোধ হচ্ছিল। আমার মত নিতান্ত আনস্মার্ট একটা ছেলেকে দেখে ওর হয়ত ভাল লাগবে না যদিও আমরা একে অপরের ছবি বহু আগেই দেখেছিলাম। তারপর সেই দিনটা আসল। আমাদের প্রথম দেখা। অবন্তীর হাতে স্পর্শ। স্বর্গ মাঝে মধ্যে মাটিতে নেমে আসে। সেদিন এসেছিল। অবন্তী আমার জন্য নিজ হাতে পরোটা বানিয়ে এনেছিল। একসাথে খাওয়া, হেঁটে বেড়ানো সব কিছু। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম আমার পছন্দ নীল তাই সে নীলে সেজে এসেছিল। তারপর এসেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কিছু সময়। এক ঘন্টার রিকশা ভাড়া। পাশাপাশি দুজন রিকশায় বসে ঘুড়ছি। অবন্তীর হাত আমার হাতে। ও ঘুড়ে ঘুড়ে ওর ক্যাম্পাসের সব কিছু আমাকে দেখাচ্ছে। আমি ঈশ্বরের নামে বাজী ধরে বলতে পারি স্বর্গেও এমন আনন্দ পাওয়া যাবে না। কখনই না।

তারপর সময় উড়ে উড়ে চলতে লাগল। একদিন ও আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ঢাকায় চলে আসল! জীবনে সর্বশেষ কবে এতটা অবাক হয়েছি জানি না। বাচ্চাদের মত সেদিন আনন্দে চিল্লাপাল্লা করছিলাম। তারপরও অনেকটা সময় গেছে। পাখির পালকে ভেসে, শঙ্খচিলের ডানায় উড়ে। চোখ বন্ধ করলেই মনে হত জীবন এত ছোট কেন? এত্ত ছোট??

আমি ওকে পাগলের মত ভালবাসতাম বলেই পৃথিবীর সব এক্সপেক্টেশন ওই একটা মানুষের উপরই ছিল। খুব স্বাভাবিক সব এক্সপেক্টেশন কারও পক্ষেই পূর্ণ করা সম্ভব না। আমি হয়ত ওকে যতটা ভালবাসতাম ঠিক ততটাই কষ্ট দিতাম। এত কষ্ট হয়ত ওর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই আস্তে আস্তে আমাদের ভালবাসার সুর কেটে যেতে লাগল। ও নিজেও অনেক ঝামেলার মধ্যে পড়ল। খুব ভয়ঙ্কর টাইপের ঝামেলা। এদিকে বিয়ে নিয়ে বাসার সবার সাথে কথা কাটাকাটি। সব কিছু মিলিয়ে অনেক বেশি ঝামেলা। এইসব ঝামেলার মাঝে বোধ করি আমার কষ্টগুলো মিলে তীব্র কষ্টের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে ফাটল ধরতে লাগল।
আমাদের মধ্যে শেষ অনেক সুন্দর করে কথা হয়েছিল অবন্তীর ফাইনাল এক্সামের আগের রাতে। সব পড়া শেষ করে ও আমাকে ফোন দিল। আমি ধরলাম। সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। সাধারণত আশ্বিনের পূর্ণিমা সবচেয়ে গাঢ় হয় কিন্তু আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জ্যোৎস্না ছিল সেই রাতে। এক সাথে কত্ত তারাই না আমরা খুব অল্প সময়ের জন্য গুনেছিলাম। যখন ফোনটা রেখে দিতে চাইলাম, বললাম তোমার পরীক্ষা এখন ঘুমাতে যাও ঠিক তখন অবন্তী কতটা মায়া নিয়ে বলল, যদি আর কখনও আমাদের এভাবে কথা না হয়? আমার তো পড়া শেষ পরীক্ষাও ভাল হবে আরেকটু থাকি...

অবন্তী মেয়েটা পৃথিবীর অসম্ভব মায়াবতী একটা মেয়ে ছিল। আমার সাথে সে নেই কাজেই সে বেঁচে গেছে। কি লাভ রে বাপ আমার মত নিঃস্ব একটা মানুষের কাছে পূর্ণ একটা মানুষের চলে আসা? আমি তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি সত্য কিন্তু অল্প হলেও ভালবেসেছি। সেই ভালবাসা সত্য হলে আমার অবন্তী কখনও কষ্টে থাকবে না। কখনই না।


আমি আমার অবন্তীর জন্য কল্পনায় আলাদা একটা জগত তৈরী করে নিয়েছি। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন আমি তার পাশে বসে থাকি। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারে। কবিতা আবৃতিও অপূর্ব করে। সে আমাকে বাস্তবে বাঁশি বাজানো শোনায় নি। কবিতা আবৃতিও না। আমি কল্পনার জগতে মন খারাপ হলেই তার আবৃতি শুনি। বাঁশি শুনি। মন ভাল হয়ে যায়। সে আমাকে একটা পারফিউম দিয়েছিল। তার গায়ের গন্ধের মতই পারফিউমটার গন্ধ। ওটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আর পারফিউমটার সাথে একটা কাগজ ছিল যেটাতে অবন্তী খুব যত্ন নিয়ে লিখেছিল,
“ধন্যবাদ তানভীর, আমার জীবনে আসার জন্য।”

আমি খুব যত্ন করে কাগজটা রেখে দিয়েছি। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে কাগজটা দেখি। একটু পরিষ্কার করে মানিব্যাগে রেখে দিই। মন ভাল হয়ে যায়। আমরা একে অন্যের জীবনে নেই কিন্তু আমার জগতে সে আছে, থাকবে চিরকাল।”


--- গল্পটা কেমন লাগল অয়ন ভাই? তারাশঙ্কর একটা বেকুব তাই না?
আমি হঠাত চমকে বলে উঠলাম, হ্যা ইয়ে না মানে হ্যাঁ। ইয়ে ভাল। ইয়ে উনি বেকুব কেন?
আরে ভাই তার উপন্যাসের নায়ক বলে, জীবন এত ছোট কেনে? কি হাস্যকর কি হাস্যকর! আসলে হবে জীবন এত বড় কেনে!
আমি তানভীর পাগলাটার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম, আপনার গল্পটা গল্প হলেও পারত...


এই অয়ন, এই গাধা তুই কই। তোকে খুঁজে হয়রান আমারা সবাই। ট্রেন তো চলে যাচ্ছে। আমরা তোকে খুঁজে হয়রান। নীতুর গলা শুনে গেল। এই তোর চোখে পানি কেন? কি হয়েছে রে?? আমি গম্ভীর গলায় উত্তর দিলাম আর বলিস না রে, চোখে ধূলা পড়েছে। কি যে ধূলা রে বাপ। চোখ থেকে পানি বের হয়ে যাচ্ছে!!
আমি নীতুদের সাথে ট্রেনে উঠতে যাচ্ছি। পিছন থেকে পাগলা সঞ্জীবদার গান ধরেছে,

চোখটা এত পোড়ায় কেন
ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও
সমুদ্র কি তোমার ছেলে
আদর দিয়ে চোখে মাখাও।
বুক জুড়ে এই বেজান শহর
হা হা শূন্য আকাশ কাপাও
আকাশ ঘিরে শংখচিলের
শরীর চেরা কান্না থামাও
সমুদ্র কি তোমার ছেলে
আদর দিয়ে চোখে মাখাও।



আমি ট্রেনে উঠেছি। ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের জীবনই একেকটা ট্রেন। ট্রেনের মত ছুটে চলে অবিরাম...
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১২:৪১
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×