ক্যাম্পাসে বইছে ECORUN ঝড়।ECORUN মানে জাপান থেকে আগত জ্বালানী সাশ্রয়ী বাহন তৈরির গবেষণা প্রস্তাব।এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের জুনিয়ররা নেমেছে তিনচাকা এবং চারচাকার গাড়ি তৈরির অভিযানে।এগুলো নিয়ে বছর শেষে আবার IUT তে প্রতিযোগিতাও হবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে।অসম্ভব ভালো লাগছে তাদের আগ্রহ এবং কর্মচাঞ্চল্য দেখে।গাড়ি তৈরিতে টাকা দরকার,তো ঢালো টাকা!!সবাই যে কি কষ্ট,সংশয় এবং উদ্দীপনা নিয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় অথবা “পিতার কাছে টাকা চাহিয়া S.M.S” করে অর্থ সংস্থান করছে তা দেখে দ্বৈত-ভাবে মুগ্ধ হই আবার ক্ষোভও জাগে।আমি একটা কথা বলতাম গবেষণা অথবা প্রজেক্টের টাকা ভূতে যোগায়।কিন্তু এখনও আশ্চর্য হই এই ভূত কেনো সরকারের কাঁধে সওয়ার হতে পারে না।সরকারের কাঁধ কি এতোই পিচ্ছিল?
যাক আজকে লিখতে বসার উদ্দেশ্য অন্য।তাতে মনোযোগ দেই।ECORUN এর শুভেচ্ছা বার্তা এবং কর্মপরিকল্পনা নিয়ে জাপান থেকে এসেছেন একজন নির্দেশক,তিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এর বিভিন্ন দিক এবং পদ্ধতি।উনার ল্যাপটপটা লাগানো ছিলো প্রজেক্টরে।অবাক হয়ে দেখলাম ল্যাপটপে চলা WINDOWS এর প্রতিটা অপশন,ফোল্ডারের নাম,স্টার্ট মেনুর জঞ্জাল সবকিছুতে জাপানী অক্ষর জ্বলজ্বল করছে।এমনকি ছবিগুলো পর্যন্ত ঐ ভাষায় নামকৃত। একি অবাক কাণ্ড!!এই না হলে ভাষার প্রতি ভালোবাসা!!!আমাদের বিভাগের শিক্ষকরা যারা ওদের দেশে যান তাঁরা সকলেই এই কথা বলেন যে ওখানকার প্রতিটি সেমিনার,প্রেজেন্টেশন সব কিছু হয় জাপানী ভাষায়।নিজের ভাষার গর্ব,শক্তি এবং সর্বোচ্চ ব্যবহারের কারণেই মনে হয় ওদের প্রাযুক্তিক ভীত এতো শক্ত!!!
আমি যখন একটা বাক্য পড়ি বাংলা ছাড়া অন্য যেকোনো ভাষায় তাকে মনে মনে প্রথমে করি বাংলায় অনুবাদ।তারপর আসে বুঝার পালা।প্রতিনিয়ত চালাতে হয় দ্বিমুখী লড়াই।এ লড়াইয়ে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার্থী অথবা প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা যে হেরেই চলেছেন তা এই শিক্ষার দুরবস্থা দেখে সহজেই অনুমেয়।আরে বাবা আমি বুঝব আমার ভাষায় সবথেকে ভালো।‘মোবাইল’ থেকে ‘মুঠোফোন’ শব্দটা আমার কাছে বেশি আপন, ‘MECHANICAL’ কাঠখোট্টা উচ্চারণ থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছে ‘যন্ত্রকৌশল’ শব্দটা।তড়িৎকৌশল,পুরকৌশল শব্দগুলোকে বড় কাছের মনে হয় এর ইংরেজি থেকে।জাফর ইকবাল স্যারের ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ বইটাকে দেখে সাধ জাগে বাংলা উইকিপিডিয়া সমৃদ্ধ হবার।FACEBOOK এ তো বাংরেজি অথবা ইংরেজি STATUS পড়া ছেড়ে দিয়েছি সেই কবে!বাংলা ব্লগের সাফল্য দেখে আশা জাগে সম্পূর্ণ বাংলায় ইন্টারনেট ভ্রমণের।
প্রথম বর্ষে থাকতে গেছিলাম পাশের রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে।নব্য প্রকৌশলীর একরাশ বিস্ময় নিয়ে দেখেছিলাম নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে চীনা-ইংরেজি অভিধানের ছড়াছড়ি।কর্মরত প্রকৌশলীদের মনে হয়েছিলো যন্ত্র বুঝা থেকে ভাষা বুঝতে বেশি ব্যস্ত।কেন্দ্রের সকল নির্দেশনা,যন্ত্রের বর্ণনা এমনকি বিপদজনক সাবধানতা পর্যন্ত চায়না ভাষায় লেখা যে।তাই এখানকার কর্মকাররা যে যন্ত্রবিদ না হয়ে ভাষাবিদ হবেন তা হলফ করে বলা যায়!!!আর অবশ্যই কুর্ণিশ করতে হয় চীনাদের আপন ভাষা ব্যবহারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাকে।
ক্যাম্পাসে জাপানী ভাষাশিক্ষা কেন্দ্র খুলেছে বেশ আগে,চলছে জার্মান ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর কাজ।আমরা সবাই খুশি,আহারে প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক হচ্ছে!!!এটা ভালো যে জাপানী,জার্মানী বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে আমাদের পরিচয় হচ্ছে,কিন্তু ভেবে ভীত হই তাদের মেধাবিনিময় থেকে মেধা কেড়ে নেওয়ার দুরভিসন্ধি দেখে।প্রতি বছর অগণিত মেধাবী পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে,পিছনে রেখে যাচ্ছে জীর্ণ,শীর্ণ মা জননীরে।বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়/চতুর্থ বর্ষ থেকে শুরু হয় IELTS,জার্মান,জাপানী,কোরিয়ান ভাষা শেখার মহাযুদ্ধ।হায়রে আমরা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়কে যথেষ্ট বৈশ্বিক করেছি কিন্তু স্বদেশী করতে পারি নি।এক্ষেত্রে কি আমাদের আপন ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অভাব একটা কারণ নয়?
প্রথম বর্ষ থেকে দেখে এসেছি আমার অনেক সহপাঠীর অন্য ভাষা বুঝার কষ্টকে।কেনো বাবা বিজ্ঞান যদি বুঝা এবং বুঝানোর চর্চা হয় তবে আমি বুঝি সবথেকে ভালো বাংলায় আর বুঝাতে পারিও বাংলায়।কেনো আমাকে PRESENTATION এর সময় ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ ধরণের ইংরেজি বলতে হবে?বিশ্ববিদ্যালয় যদি হয় দেশ ও মানুষের কল্যাণে তবে কেনো বাংলা ভাষাভাষী ১৬ কোটি ৪৪ লক্ষ মানুষের দেশে এই ইংরেজি সাধনা?নিরন্তর নিজেকে অপভ্রংশ করার ক্ষোভ থেকেই কি শিক্ষার্থীরা দলে দলে পাড়ি জমায় বিদেশে?আমরা কি পারতাম না আপন ভাষায় বিজ্ঞান/প্রকৌশল চর্চা করে শানিত মস্তিষ্কের দেশপ্রেমিক যন্ত্রসৈনিক তৈরি করতে??
তাই মনে হয় এবার সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর ।আমাদের ভাষা বুঝা থেকে যন্ত্র বুঝার দিকে বেশী মনোযোগ দিতে হবে।ভাষার কষ্ট দূর করার জন্য সকল বইকে আস্তে আস্তে বাংলায় অনুবাদ করা দরকার।এজন্য হাত লাগাতে হবে সবাইকে।অন্তত পক্ষে আমাদের PRESENTATION, REPORT,HOMEWORK গুলো বাংলায় করানো যায়।সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে শিক্ষকদের।শিক্ষকদের আমরা অভয়বাণী দিতেই পারি কারণ REPORT,PRESENTATION এর বেশীরভাগই ইন্টারনেট থেকে COPY,PASTE করা!!!আর তা বাংলায় করলে অন্তত পক্ষে বুঝে,পড়ে বাংলায় অনুবাদের কষ্টটুকু প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই করতে হবে!!!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৫৪