গ্রামের নাম রাশেদনগর,নবগঙ্গা পাড়ের ছোট্ট একটি গ্রাম। যেখানে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, পথের দুলাশে তাল গাছের সারি। দেশের অন্যান্য গ্রামের মত ছিটেফোঁটা উন্নয়নের ছোয়া এখানেও লেগেছে তবে অন্যান্য এলাকার তুললায় খুবই অপ্রতুল। গ্রামের রাস্তাগুলো পাকা হওয়ায় গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে তা এখন ভটভটি আর ব্যাটারি চালিত ভ্যান গাড়ির দখলে। কিছু অল্প শিক্ষিত ছেলেরা ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালিয়ে রোজগারের একটা পথ তৈরী করেছে আর বিকট হর্ণ বাজিয়ে গ্রামের শান্ত পরিবেশের নিরবতাকে নষ্ট করে চলেছে। গ্রামের উওর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নবগঙ্গা নদী। একটি খেয়া নৌকা গ্রামের সাথে জেলা সদরের সেতুবন্ধন রচনা করে দিয়েছে।গ্রামের লোকেরা অবশ্য এখনো টাকা দিয়ে নৌকা পার হয় না, ফসলের মৌসুমে একবারে মাঝিকে কিছু ফসল দিয়ে তার বিনিময়ে সারাবছর নৌকা পার হয় । গ্রামের শান বাধানো বটের ছায়ায় করিম মিয়ার তেতো চা না খেলে যেন গ্রামের মানুষের তৃষ্ণা মেটে না।গ্রামের সকল শালিস বিচার সহ গ্রামের মানুষের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রস্থল এই বটের ছায়ার করিম মিয়ার চায়ের দোকান।
রহমত মিয়া রাশেদপুর গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন গৃহেস্ত। পড়াশোনা না জানলেও টাকাপয়সা আছে যথেষ্ট তাই রহমত মিয়াকে গ্রামের মানুষ বেশ সমিহ করেই চলে। গ্রামের বিচার শালিসসহ যেকোনো সামাজিক কর্মকান্ডে রহমত মিয়ার ডাক পড়ে।বলা যায় তিনি গ্রামের একজন প্রভাবশালী মাতুব্বর। অশিক্ষিত রহমত মিয়া বিচার সালিশের ব্যাপারে খুবই অভিজ্ঞ, যেকোনো বিচার আচারের ক্ষেত্রে বেশ ভাল সমাধান দিতে পারেন, তাই এসব কাজে গ্রামের সহজসরল মানুষের আস্থার নাম রহমত মিয়া।
রহমত মিয়ার ছেলে কনক, পড়াশোনায় বেশ ভাল তাই ছেলেকে নিয়ে খুব গর্ব তার,সবার কাছে বলে বেড়ান
-আমার ছেলে ক্লাশে ফাস্ট বয়, ও আমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
তাই কনকের কোন আবদারই অপূর্ণ রাখেন না তিনি। এমনকি অন্যায় আবদারও পূরণ করেন। আর ছেলের বিরুদ্ধে যদি কেউ কোন অভিযোগ করেন তবে তার রেহাই নেই।
একবার রহমত মিয়ার কাছে পাড়ার উকিল মুন্সির অভিযোগ ছিল
-তোমার ছেলে আমার বাড়ি থেকে রাতের আধারে দশটা মুরগী চুরি করে বন্ধুদের নিয়ে পিকনিক করেছে।
-কি মুন্সি তোমার এত বড় সাহস আমার ছেলের নামে মিথ্যে অভিযোগ কর!! কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে যে বলছো আমার ছেলে তোমার মুরগি চুরি করেছে?
উকিল মুন্সি তখন কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন না তাই চুপসে যান, আসলে রতমত মিয়ার মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই।
এমনিভাবে গাছের ডাব চুরি, আম কাঠাল চুরিসহ নানারকম সিচকে চুরির অভিযোগ আসতে থাকে রহমত মিয়ার ছেলে কনকের বিরুদ্ধে। তিনি এর কোনটাই আমলে নেন না। রহমত মিয়ার কথা হচ্ছে আমার ছেলে সোনার টুকরো ছেলে ও কোন অপরাধ করতেই পারে না।
দেখতে দেখতে কনক এসএসসি পরিক্ষা দিল এবং জিপিএ ৫ পেয়ে পাশ করলো। রহমত মিয়া মহাখুশি! রহমত মিয়া জেলা সদর থেকে ডেকোরেটর এনে দশটা বড় বড় খাশি জবাই করে গ্রামের মানুষকে বিরিয়ানি রেধে খাওয়ালেন। গ্রামের গরিব মানুষগুলো যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায়, তারা কনকের পাস উপলক্ষ্যে বিরিয়ানি খেতে পেয়ে খুবই খুশি।
অনুষ্ঠানে রহমত মিয়া সকলের উদ্দেশ্যে বললেন
-তোমরা আল্লাহর কাছে একটু দোয়া আমার ছাওয়ালডা যেন ডাক্তার হইবার পারে। আর আমার ছাওয়াল যদি ডাক্তার হইবার পারে তবে চার গ্রামের মুসলমান হিন্দু সবাইরে গরু, খাশি জবাই করে খাওয়াবো।
তিনি কনকের রেজাল্টে খুশি হয়ে ছেলেকে নতুন মোটর সাইকেল উপহার দেন। মোটকথা ছেলে কনক রহমত মিয়ার নয়নের মনি।
এতদিন কনকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ছিচকে চুরির, যেগুলো ম্যানেজ করা খুব একটা কঠিন ছিল না রহমত মিয়ার। কিন্তু এবারের অভিযোগ গুরুতর। গ্রামের ফসলের মাঠের এককোনে বাস করত গরিব বিধবা মর্জিনা এবং তার মেয়ে মোমেনা। একদিন সন্ধ্যায় মর্জিনা গিয়েছিল গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়ি কাজ করতে, ফাকা বাড়িতে একা পেয়ে কনক এবং তার বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করে মোমেনাকে এবং রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে রহমত মিয়ার ছেলে কনক। অন্যান্য চুরির ঘটনার মত এই ঘটনাকেও প্রথমে ধমক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন রহমত মিয়া। কিন্তু যখন বুঝতে পারে জল অনেকদূর গড়িয়েছে আর থানা পুলিশ হলে মহা বিপদে পড়ে যাবেন তিনি।গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে বিচার দেন মর্জিনা, চেয়ারম্যান সাহেব গ্রামের বটতলায় শালিসের ডাক দেন। রহমত মিয়ার বদ্ধমুল ধারণা এই কাজে তার ছেলে জড়িত নয়, গ্রামের কিছু মানুষ তার ছেলেকে ষড়যন্ত্র করে ফাসানোর চেষ্টা করছে এবং তিনি যেকোনো মুল্যে নিজের ছেলেকে রক্ষা করবেন। অবশ্য এই কাজের জন্য তিনি গোপনে গ্রামের অন্যান্য মাতুব্বরদের হাতে পাচ হাজার করে টাকা দিয়েছেন আর চেয়ারম্যান সাহেবকে স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন গত ইউপি নির্বাচনে তাকে জেতাতে নিজের অবদান কতটুকু।
গ্রামের সব মানুষ করিম মিয়ার চায়ের দোকানে জড় হয়েছে, করিম মিয়ার ব্যবসা আজ রমরমা। তেতো চায়ের সাথে বিস্কুট পাউরুটি কলা দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। নির্ধারিত সময় পার হয়েছে তবু্ও চেয়ারম্যান সাহেবের দেখা নাই, তার চ্যালাদের তাগাদা দেওয়া হচ্ছে চেয়ারম্যান সাহেবকে ফোন করার। একজন জানালেন আর পাচ মিনিটের মধ্যে চেয়ারম্যান সাহেব চলে আসবেন। অতঃপর মটর সাইকেলের পিছনে বসে পনেরো মিনিট পর চেয়ারম্যান সাহেব হাজির।
বিচারের কাজ শুরু হল, প্রথমে মর্জিনা বর্ণনা করলেন তার মেয়ের উপর অমানুষিক নির্যাতনের কথা। মজলিসে তখন পিনপতন নিরাবতা। সবাই খুবই আগ্রহ নিয়ে গল্পটা শুনছে, কেউ কেউ মাঝে মাঝে 'ইসস' শব্দ করছে। গ্রামের যুবকরা এমনকি কিছু মাঝ বয়সি কিছু মানুষও গল্পটা বেশ উপভোগ করছে। মর্জিনা একে একে অভিযুক্তদের নাম বললেন,
-রতন, মোমিন, সেলিম, মিন্টু। গ্রামের মানুষ বিস্ময়ের সাথে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো। আসলে তারা এতদিন জেনে এসেছে ঘটনাটা ঘটেছে কনকের নেতৃত্ব কিন্তু আজ কনকের নামই নাই।
রব মিয়া মোমেনাকে জিজ্ঞাসা করলেন
-মোমেনা তুমি ঠিক করে কও সেদিন কে কে ছিল?
মোমেনাও মায়ের সুরে সুর মেলালো।
অতঃপর চেয়ারম্যান সাহেব রায় দিলেন, অভিযুক্তদের প্রত্যেককে জরিমানা করা হল দশ হাজার টাকা ও ১০০ জুতার বাড়ি। কনককে বেকসুর খালাস প্রদান করা হল।
একেএকে অভিযুক্ত সবাইকে জুতার বাড়িটা নগদে প্রদান করা হল,এই মহান দায়িত্বটা পালন করলেন গ্রামের পালোয়ান ফিরোজ শেখ। দশ হাজার করে মোট চল্লিশ হাজার টাকা এক সপ্তাহের মধ্যে প্রদানের আদেশ দেওয়া হল।
রহমত মিয়া দাড়িয়ে পড়লেন,
-আমার একখান কথা আছে? সবাই জিজ্ঞেস করলেন
-কি কথা কইয়্যা ফেলাও মিয়া।
-মর্জিনা একজন অসহায় বিধবা, মানুষের বাড়িতে কাম করে ওর দিন চলে। তার মেয়ে মোমেনার উপর যে অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে সেটা ভাষায় প্রকাশের মত নয়।
মহব্বত মেম্বার বলে উঠলেন
-কি কইতে চাইছো তাড়াতাড়ি কও, আমাগো ম্যালা কাম পইড়া আছে।
-একটু সবর কর মিয়া, কইতেছি তো। আবার শুরু করলেন রহমত মিয়া
-'আমি অসহায় মর্জিনা আর তার মেয়েকে বিশ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য করতে চাই।
উপস্থিত সকলে এক সাথে তালি দিয়ে উঠলো। গ্রামের দু একজন বলতে লাগলো
-আসলেই মনে হয় কনক কাজটা করেনি।
আবার দুএকজন বলতে লাগলো
'টাকা যার শালিসও তার।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:১৭