বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুল তলায় গোল হয়ে বসে গ্রুপ স্টাডিতে ব্যস্ত একদল ছাত্র, এই গ্রুপের মধ্যমনি রাশেদ। গ্রুপের সবাই যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত ঠিক তখনই ওদের পাশেই একটা দামী গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ডিপার্টমেন্টের ডাকসাইটে সুন্দরী লীনা। দূর থেকে রাশেদ ভাইয়া, রাশেদ ভাইয়া বলে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো।
রাশেদ গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল
-ভাইয়া তুমি কি খুবই ব্যস্ত? লীনা জিজ্ঞাসা করলো
-না তেমন কিছু না বন্ধুরা মিলে একটু গ্রুপ স্টাডি করছিলাম।
-এখন কি তোমার কোন ক্লাস আছে?
- না, রাশেদের জবাব।
-তবে আমার সাথে গাড়িতে ওঠো।
বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে লীনার সাথে গাড়িতে উঠে পড়ে রাশেদ।
রাশেদের বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা তাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে।ছেলেবেলা থেকেই রাশেদ ভাল ছাত্র, বাবার রেখে যাওয়া অল্পকিছু জমি ইতিমধ্যেই তার মা বিক্রি করে দিয়েছেন, এত বছর ধরে সেই টাকা দিয়েই চলছিল রাশেদের পড়াশোনা, কিন্তু সেই টাকাও এখন শেষ হয়ে এসেছে। তাই পড়াশোনা শেষ করে দ্রুত একটা জব পাওয়া রাশেদের জন্য খুবই জরুরি। আপাতত দুটো টিউশনিই তার একমাত্র ভরসা।
লীনা রাশেদের দুঃসম্পর্কের চাচাতো বোন। লীনার বাবা ঢাকা শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি রাশেদকে যথেষ্ট স্নেহ করেন, তাই ওদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত রাশেদের। আসলে লীনা আর রাশেদ একই ভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে, রাশেদ চতুর্থ বর্ষে আর লীনা প্রথম বর্ষে। রাশেদ খুবই ভাল স্টুডেন্ট, তাই ভর্তির পর প্রথম দিনই লীনা বলে দিয়েছে
-ভাইয়া তোমার ভরসাই এই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলাম, তুমি হেল্প না করলে আমি কিছুতেই পড়াশোনা করতে পারবো না।
রাশেদ সেদিন লীনাকে অভয় দিয়েছিল,
-আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা নেই।
তারপর থেকে বন্ধুদের ছেড়ে অনেক বেশি সময় দিতে হচ্ছে লীনাকে। পড়াশোনার বাইরেও লীনা মাঝে মধ্যে রাশেদকে নিয়ে কফি সপে একান্ত সময় কাটায়। রাশেদের যতগুলো টি-শার্ট জিন্স প্যান্ট আছে তার সবই লীনার দেওয়া। আসলে অভাবের সংসারে নিত্যনতুন জামা কাপড় কেনার মত অবস্থা তার নেই।
লীনা ক্যাম্পাসে ভর্তি হওয়ার পর থেকে রাশেদের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, একসময় যেসব বন্ধুরা তাকে মনে মনে গ্রাম্য ক্ষ্যাত বলতো তারাই এখন রাশেদকে দেখে অবাক হয়ে তাকায়।একদিকে পড়াশোনায় যেমন ভাল আবার চালচলনেও এই মুহুর্তে দারুণ স্মার্ট রাশেদ। বন্ধুরা কেউ কেউ বলে তোরই তো ভাগ্য রাজ্য রাজকন্যা একসাথে পাবি। বন্ধুদেরকে হালকা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়, আসলে দুটো পরিবারের ব্যবধান বিস্তর তাই ওসব বিষয় কখনোই মনে আনে না।
রাশেদ যতই চায় লীনাকে নিয়ে ভাববে না কিন্তু ক্লাশের সময়টুকু বাদে তার প্রতিমুহূর্তের সঙ্গী ধনীর দুলালী লীনা। এমন সুন্দর মেয়ে যার হাসিতে মুক্ত ঝরে, আর প্রতিটি মুহুর্তে যে রাশেদের খেয়াল রাখে তাকে অবহেলা করা আসলে কোন ছেলের পক্ষেই সম্ভব নয়।
কোন এক বিকেলে প্রাকটিকাল ক্লাস শেষে রাশেদ বাইরে বেরিয়ে দেখে ঝুম বৃষ্টি, লীনাও দাঁড়িয়ে ডিপার্টমেন্টের বারান্দায়। রাশেদকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে লীনা
-চল ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজি।
-আরে না এই অবেলায় বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত ঠান্ডা লেগে যাবে, বলে রাশেদ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা লীনা নেমে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে, রাশেদকেও আহবান করতে থাকে। এই আহবানে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই, রাশেদও নেমে পড়ে। সেদিনের বৃষ্টিভেজা বিকেলটা আর দশটা বিকেল থেকে রাশেদের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা মনে হয়।লীনার সেই দিনের বৃষ্টি ভেজার উচ্ছ্বাস রাশেদের বড্ড ভাললাগে।
পরের দিন ডিপার্টমেন্টে লীনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে রাশেদ কিন্তু তার পাত্তা নেই ।বুকের ভিতর অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করে সে, লীনাদের ইয়ারের একজন মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারে সেদিন লীনা ক্লাশে আসেনি। আসলে রাশেদ কখনোই লীনাকে ফোন দিতো না, লীনাই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাকে ফোন দিতো,আজ ভাবলো ওর একটু খোঁজ নেওয়া দরকার।
রাশেদের ফোন লীনার মা আন্টি রিসিভ করলো
-ও রাশেদ, লীনারতো খুব জ্বর।
রাশেদ ভাবলো লীনাকেতো দেখতে যাওয়া উচিত তার, কিন্তু কি নিয়ে যাবে লীনার জন্য? তার হাততো একেবারেই খালি। অনেক ভাবনা চিন্তা করে দুটো লাল টকটকে গোলাপ নিয়ে লীনাকে দেখতে যায়।
লীনাদের বাসার কলিং বেল বাজাতেই লীনার মা দরজা খুলে দেন,
-ও রাশেদ তুমি এসেছো? যাও লীনা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে,ও ভাল কথা আমি রান্না করতে গেলাম তুমি না খেয়ে যাবে না কিন্তু।
-ও ভাইয়া তুমি এসেছো? লীনা বলে
রাশেদের দেওয়া দুটো লাল গোলাপ পেয়ে লীনা বেশ উচ্ছ্বসিত। বিছানা থেকে উঠে বসে লীনা, রাজ্যের গল্প হয় দুজনের মধ্যে।
খাবার টেবিলে লীনার বাবা জামান আংকেল রাশেদের কাছ থেকে গ্রামের পরিচিতজনদের খোঁজ খবর নিতে থাকেন,এবং বলেন
-তুমিতো ইদানীং আসোই না মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসবে জমিয়ে গল্প করা যাবে।
-জি আসবো আংকেল।
এতদিন রাশেদ লীনাকে শুধুমাত্র চাচাতো বোনই ভাবতো কিন্তু লীনার অতিরিক্ত কেয়ার,বৃষ্টিতে ভেজা, কফি সপে কটানো একান্ত সময়গুলো যেন ভিন্ন কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
লীনাদের বাসায় যাওয়ার জন্য রাশেদের কোন অজুহাত খোজার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু তবুও সেদিন হাতে লীনার জন্য কয়েকটা হ্যান্ডনোট নিয়ে বাসার কলিংবেলের সুইচে টিপ দেয় । বাসার কাজের বুয়া দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে দেখে এলাহি কান্ড, পুরুষ মহিলা বাচ্চাসহ আট দশজন মানুষ। বাসায় কোন একটা অনুষ্ঠান চলছে সেটা বুঝতে বাকী রইলো না, এরমধ্যে লীনার বাবা জামান আংকেলের চোখ পড়লো রাশেদের উপর।
-ও রাশেদ, তুমি এসে ভালোই করেছে, আজ লীনার এনগেজমেন্ট, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার দেশের বাইরে থাকে, এত ঝামেলা একা কিভাবে সামলাই বল, তুমি আসাতে একটু ভরসা পেলাম।
কথাগুলো রাশেদের বুকের ভিতর তীরের ফলার মত বিধে গেল,মনে হয় ধরণী তুমি দ্বিধা হও আমি তোমার চরণে আশ্রয় নেই । নিজেকে সামলে নিয়ে অতিথি আপ্যায়নে মনোযোগ দিল রাশেদ, হাজার হোক লীনাতো তার কাজিন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৭